মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দুরে গাংনী উপজেলার হোগলবাড়িয়া গ্রামের মাঠপাড়ায় বাছিরণের বাড়ি। তিনি গ্রামের রহিল উদ্দিনের (মৃত) স্ত্রী। ৩৫ বছর আগে স্বামী মারা যায়। বাসিরণের রয়েছে এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে মহির উদ্দিনের সাথে থাকেন তিনি। বাসিরনের নাতি-নাতনিরা কলেজে ও বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থেকে বাসিরণ ২০১১ সালে বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে হোগলবাড়িয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় প্রথম শ্রেণিতে। ২০১৬ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন।
বাসিরণ জানায়, অর্থসংকটের কারণে শৈশবে তার পড়াশোনা হয়নি। চেষ্টা করেছিলেন ছেলে-মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে। এর মধ্যেই মারা যায় তার স্বামী। ফলে সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেননি। পরে যখন নাতি নাতনিরা লেখাপড়া শুরু করলো তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজে লেখাপড়া করার।
আজ বৃহস্পতিবার বাসিরণ তার বয়োবৃদ্ধ ভাই আকবর আলী ও ছেলে মহিরুদ্দিনকে সাথে করে বিদ্যালয়ে এসেছিলেন পরীক্ষার ফলাফল জানতে। সেখানে বাসিরণ জানায়, খুব ভয়ে ছিলাম ফলাফল কী জানি কী হয় বলে। বাছিরণ জানায়, এবার তিনি গ্রামের এমএইচএ মহাম্মদপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন।
দুপুর দুইটার দিকে মেহেরপুরের সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি সেলিনা আখতার বানু ফলাফল ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন বিদ্যালয়ে। এসময় তিনি বাছিরণের কারণে বিদ্যালয়টি পাকা করণের ঘোষণা দেন এবং বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছেন বলেও জানান। তিনি আশা করছেন আগামী ছয়মাসের মধ্যে বিদ্যালয় পাকাকরণের কাজ শুরু হবে বলে। পরে তিনি বাছিরণের বাড়িতেও যান।
প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিন বলেন, বাসিরন নেছা ২০১০ সালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য কয়েকবার এসেছিলেন। বয়স্ক মানুষ ভেবে সে বছর তাকে ভর্তি করানো হয়নি। পরবর্তীতে যখন সে আবার আসে ২০১১ সালে তাকে ভর্তি করি। ভর্তি করার পর থেকে তার আগ্রহ দেখে অবাক হয়েছি। প্রতিদিন সে ক্লাস করেছে। ক্লাসের সহপাঠীদের সাথে তার শিশুদের মতোই আচরণ শিক্ষকদের মুগ্ধ করতো।
দাদীর বয়সী বাসিরণের নিয়মিত স্কুলে আসা দেখে তার সহপাঠীরাও অনুপ্রাণিত হয়। সহপাঠী মৌ জানায়, বাসিরণ তার দাদীর বয়সী হলেও তাকে বান্ধবীর মত করে দেখতে হয়। লেখাপড়া নিয়ে কোনো সমস্যা মনে হলে একে অপরকে সহযোগীতা করেন। সে আরও বলে, বাসিরণকে স্যাররা পড়া ধরতে দেরি করলে মন খারাপ করে স্যারদের বলতেন আমার পড়া ধরেন।
ছেলের বউ জাহানারা বেগম বলেন, আমার আর দুটি সন্তানের সাথে শাশুড়িও লেখাপড়া করে। লেখাপড়ার সাথে সাংসারিক কাজেও সহযোগিতা করনি। বৌমাকে নিয়েও খুশি বাসিরণ। ছেলে বউকে দেখিয়ে তিনি বলেন, আমার মেয়ে দুটি পরের বাড়িতে গেছে। পরের মেয়ে আমার বাড়িতে এসেছে। তাকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমারই।
বাসিরনের মেয়ের ছেলে জসিম উদ্দিন বলেন, নানীর লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ আমাদের অনুপ্রাণিত করে লেখাপড়ায়।
মটমুড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সোহেল আহমেদ বলেন, আমার ইউনিয়ন এলাকায় এ ধরনের বয়সের কেউ লেখাপড়া করতে চাইলে তাকে পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। বাসিরণ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে মডেল।
গাংনী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আকবর আলী জানান, শিক্ষার কোনো বয়স নাই। এ বয়সের একজন পিএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছে। যা নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়তে সবাইকে অনুপ্রাণিত করবে।