প্রকৃতির বিরুপ প্রভাবে পাল্টে যাচ্ছে বেদেদের জীবন যাত্রা ও সংস্কৃতি

জিয়ানগরে বেদেদের অস্থায়ী আবাস্থল। ছবি: কেফায়েত উল্লাহ, জিয়ানগর(পিরোজপুর)প্রতিনিধি।

কেফায়েত উল্লাহ
পরিবেশ প্রকৃতির বিরুপ প্রভাবে পাল্টে যাচ্ছে বেদেদের জীবন যাত্রা ও সংস্কৃতি। বিভিন্ন নদীর তীরে ভাসমান নৌকায় যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় বাস করে আসছে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে গতি হারাচ্ছে নদী। আবার দিন দিন কমে যাচ্ছে নদীর সংখ্যা।
সাপ খেলা ও কবিরাজি বেদেদের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু বর্তমানে আগের মত সাপ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার গ্রাম্য লোকজন অনেকটা সচেতন হওয়ায় বেদেদের চিকিতসা গ্রহন করছেন না। তাই বাধ্য হয়ে বেদেরা অনেকে পেশা পরিবর্তন করছেন।
এখন আর আগের মত বেদেদের নৌ বহর চোখে পড়ে না। কারন তারা নদীর তীরবর্তী এলাকা বা খোলা মাঠে পলিথিনের তাবু টানিয়ে অস্থায়ী ঘর নির্মান করে বসবাস করছেন বিভিন্ন এলাকায়। বিশেষ করে আগে তারা উপকুলীয় এলাকায় নৌ বহরে এসে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। কিন্তু বর্তমানে তারা নৌকা তৈরীর কাঠের অভাব এবং সড়ক পথে যাতায়াতের সুবিধা বৃদ্ধি ও নদী কমে যাওয়ায় তাদের আবাসস্থলের পরিবর্তন করেছেন। নৌকা বাদ দিয়ে স্থলেই অস্থায়ী ভাবে বাস করে ব্যবসা করছেন তারা। আগের তুলনায় বর্তমানে নৌকার ব্যবহার অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে বেদে বহর সূত্রে জানা গেছে। জিয়ানগরে বেদেদের অস্থায়ী আবাস্থল। ছবি: কেফায়েত উল্লাহ, জিয়ানগর (পিরোজপুর)প্রতিনিধি।

বর্তমানে জিয়ানগরের শহীদ ফজলুল হক মনি সেতুর উভয় প্রান্তে বিক্রমপুর ও সুনামগঞ্জ থেকে আসা দুটি বেদে বহর অবস্থান করছেন। সেতুর নিচেই তারা ঘাটি গেড়েছেন। আগে চাড়াখালী খালে ও বলেশ্বর নদে বেদেরা নৌ বহর নিয়ে এসে দীর্ঘ দিন থেকে ব্যবসা করতেন। কিন্তু এখন তারা ঠিকই এই এলাকায় ব্যবসা করছেন তবে নৌ বহর নিয়ে নয়। থাকছেন পলিথিনের অস্থায়ী কুরে ঘর বানিয়ে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বেলায়েত হোসেন হাওলাদার জানান, আগে এক সময় এই বলেশ্বর নদের বিভিন্ন স্থানে বেদেদের নৌ বহর দেখা যেত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সেই নৌ বহর আর দেখা যাচ্ছে না। এই এলাকায় তারা পলিথিন দিয়ে কুরে ঘর বানিয়ে থাকছে।
সুনামগঞ্জ থেকে জিয়ানগরে আসা বেদে বহরের করিম (৩৫) জানান, আমাদের অবস্থা আর আগের মত নাই। বেদেদের যে ব্যবসা ছিল তা এখন পরিবর্তন করতে হচ্ছে। আগের মত এখন আর গ্রামে ব্যবসা হচ্ছে না। সাপও পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের চিকিৎসা গ্রাম্য লোকজন আগের মত নেয় না। তাই বাধ্য হয়েই পেশা পরিবর্তন করতে হচ্ছে। ঢাকায় অধিকাংশ বেদেরা বিভিন্ন ব্যবসার সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। আগে সাপ খেলা দেখিয়ে অনেক টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু এখনতো সাপই পাওয়া যাচ্ছে না।
বেদে বিল্টু (৩০) জানান, আগে সাপ খেলা দেখাতাম। এখন আর আগের মত সাপ নাই, তাই বানরের খেলা দেখাই। আর টুকিটাকি কবিরাজি করে যা পাই তা দিয়ে কোন মতে সংসার চলে।
বক্রমপুর থেকে আসা বেদে সর্দার ছাত্তার মোল্লা (৫৫) বলেন, নৌকা তৈরীর কাঠের অভাবেই দিন দিন নৌকার ব্যবহার কমে যাচ্ছে। আগের মত নদী নালা না থাকায় এবং আর রাস্তা ঘাট ভাল হয়ে যাওয়ায় স্থল পথে যাতায়াত ও বসবাস করতে হচ্ছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে যাযাবরের সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ; যার মধ্যে দলিত ৪০ লাখ, বেদে ৮ লাখ এবং হরজিন ১৫ লাখ।
১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানরাজ বল্লার রাজার সাথে বেদেরা প্রথম ঢাকায় আসে। সেসময় তারা বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে। তারপরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।
সাভারের পোড়াবাড়ি, নোয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠি, বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, তিনটুরী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, এনায়তেগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজীসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় এসব বেদের আবাস। সুনামগঞ্জের সোনাপুরে বাস করে বেদে সমাজের বৃহত্তর একটি অংশ।

Comments (0)
Add Comment