বাংলাদেশ ছাড়াও যে দেশে সরকারি ভাষা বাংলা

বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা। বাংলা ভাষার জন্য আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে। বিশ্বের আর কোন জাতিকে তাদের মুখের বুলির জন্য প্রাণ বলি দিতে হয় নি। তাই এই ভাষা নিয়ে আমাদের অনেক গর্ব। মাতৃভাষার প্রতি বাঙালি জাতির এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের বিপুল সংখ্যক মানুষ বাংলায় কথা বলে। এছাড়াও বাংলাদেশ ছাড়াও যে দেশে সরকারি ভাষা তা নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, আন্দামান-নিকোবর, মেঘালয় সহ বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যের প্রধান ভাষা বাংলা। জনসংখ্যা বিচারে হিন্দির পর ভারতের সবচেয়ে বড় ভাষা হওয়া সত্ত্বেও দেশটিতে সরকারিভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয় নি। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন যে, বিশ্বে এমন একটি দেশ রয়েছে যেখানে বাংলায় কথা বলার মতো লোক খুব একটা নেই, অথচ দেশটিতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দেশটির নাম সিয়েরা লিওন। পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলবর্তী একটি দেশ এই সিয়েরা লিওন। ৭১,৭৪০ বার্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে বাস করে প্রায় ৭৬ লাখ মানুষ। ১৬টি ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্ত্বার এই দেশটির ২য় সরকারি ভাষা বাংলা।

২০০২ সালে ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয় বাংলাদেশে। আর ওই বছরই সিয়েরা লিওনের সরকার বাংলাকে তাদের সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়। সিয়েরা লিওন ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের সাথে কোন মিল না থাকলেও তারা বাংলা ভাষাকে আপন করে নিয়েছে। তবে বাংলা ভাষার এই অর্জনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবহিনীর।

সিয়েরা লিওনে সোনা ও হীরার মতো মূল্যবান খনি থাকলেও এখানকার মানুষজন অত্যন্ত দরিদ্র। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে সিয়েরা লিওন স্বাধীনতা লাভ করলেও দেশটির মানুষ শান্তি পায়নি। অভ্যন্তরীণ কলহ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্তিরতা লেগেই থাকতো। এতে করে সাধারণ মানুষের মাঝে বাড়তে থাকে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। যার ফলে দেশটির স্বাধীনতার ত্রিশ বছরের মাথায় ১৯৯১ সালে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধ আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম। যুদ্ধের ফলে দেশিটির ৫০ হাজার মানুষ মারা যায় এবং ৫ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
ওই সময় সিয়েরা লিওনে শান্তি ফেরাতে বিপুল সংখ্যক শান্তি বাহিনী নিয়োগ করে জাতিসংঘ। এই মিশনের বড় একটি অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা। যুদ্ধ শেষ হওয়া অবধি বাংলাদেশের সর্বমোট ১২ হাজার সেনা সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করেন এবং তাদের এই ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেখানে কেবল যুদ্ধ বা সামরিক ক্ষেত্রেই নয় বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক শান্তি শৃঙ্খলা ফেরাতেও অবদান রাখে। এসকল কাজ করতে গিয়ে সাধারণ জনগণের সাথে তাদের গড়ে ওঠে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৩১টি দেশের সেনাদল কর্মরত ছিল। তবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি মন জয় করার চেষ্টায় সবসময়ই এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাই বাংলাদেশ সেনাদলের মাধ্যমে সেখানকার মানুষজন বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করে এবং এর পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরও প্রসার ঘটে। এভাবে ইংরেজি ও আঞ্চলিক ভাষার দেশটিতে বাংলা ভাষা হয়ে ওঠে যোগাযোগের অন্যতম বড় মাধ্যম।

শান্তি কমিশনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০০২ সালে অর্থাৎ প্রায় ১০ বছর পর সিয়েরা লিওনে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বন্ধুসুলভ আচরণ ও সম্প্রীতির জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভোলেনি সিয়েরা লিওন। সে বছর ১২ ডিসেম্বর সিয়েরা লিওনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বা বাংলা ভাষাকে দেশটির অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

আমাদের দেশের সেনারা শান্তি কমিশনের সদস্য হয়ে সিয়েরা লিওনে বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষার যে প্রসার ঘটিয়োছিলেন, তা অবশ্য পরবর্তীতে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। কেননা, দেশটির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পথ এখনও ঝাপসা। তাদের হৃদয়ে বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রতি যে আবেগ ও অনন্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা যেন কমে না আসে সে ব্যাপারে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

Comments (0)
Add Comment