মাদারীপুরে জেএসসি প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও মিথ্যাচার


নিজস্ব প্রতিনিধি:
পাঠ্যপুস্তকে বিকৃত ইতিহাস, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দর্শন প্রচারের অভিযোগ নতুন নয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার আহ্বান জানালেও খোদ শিক্ষাব্যবস্থাতেই চলছে এসব সাম্প্রদায়িকতার চর্চা। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করে  এমন সব উদ্ভট প্রশ্ন করা হচ্ছে যা প্রশ্নবিদ্ধ করছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই। কিছুদিন আগেই ঢাকায় অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশন হাইস্কুলের প্রশ্নপত্রে দুজন পর্নতারকার নাম অবান্তরভাবে যুক্ত করার পর শিক্ষামন্ত্রী দিপুমনি এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন। ফলে শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়।
কোমলমতি শিশুদের মনে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বা ভ্রান্ত ধারণা প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হিসাবে প্রশ্নপত্রকে ব্যবহার করছেন কতিপয় প্রশ্নপ্রণেতা। শিশুদের মধ্যে এই প্রশ্নের মাধ্যমে ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। কচি মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বিশ্লেষকদের মতে, এটি নতুন প্রজন্মকে দিকভ্রষ্ট করার এক সুগভীর চক্রান্ত। এ নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষাবিদগণ বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ সমালোচনা করলেও বন্ধ হচ্ছে না সৃজনশীল প্রশ্নের উদ্দেশ্যমূলক অপব্যবহার।
সম্প্রতি মাদারীপুরে অষ্টম শ্রেণির জেএসসি মডেল টেস্ট ২০১৯ এর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন জেলার প্রশ্ন প্রণয়ন কর্তৃপক্ষ। উক্ত প্রশ্নপত্রের তিন নম্বর প্রশ্নে একটি উদ্দীপকে লেখা হয়েছে, “বায়াজীদ খান পন্নীর কিছু অনুসারী মনে করে নবুয়তের দরজা এখনও খোলা আছে। তাই তারা বায়াজীদ খান পন্নীকে একজন নবী বলে দাবী করে।” এরপর এ সংক্রান্ত চারটি প্রশ্ন করা হয়েছে। পন্নী পরিবারের পক্ষ থেকে এই ধরনের প্রশ্নপত্র প্রণয়নের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর সন্তান দৈনিক দেশেরপত্র পত্রিকার সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী ও বিশিষ্ট চিকিৎসক উম্মুত তিজান মাখদুমা পন্নী। তারা বলেছেন, এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি কখনো নিজেকে নবী দাবী করেন নি। তার প্রতিষ্ঠিত হেযবুত তওহীদের সদস্যরাও এমনটি বিশ্বাস করেন না। কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল ধর্মীয় উসকানি দিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তারা এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবী করেছেন।
এ বিষয়ে মাদারীপুর আলগী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, “এ বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করছে। এভাবে প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি।” বিদ্যালয়টির সহকারী প্রধান শিক্ষক দাবির হোসেন মাতুব্বর বলেন, “এ ধরণের প্রশ্নপত্র কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্তিকর। এটা জাতির জন্য লজ্জাষ্কর বিষয়। যারা কয়েকটি সেট প্রশ্ন তৈরি করে এবং যারা সেখান থেকে নির্দিষ্ট সেট প্রশ্ন বাছাই করে মূলত তারাই এ ঘটনার জন্য দায়ী।” বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (আজিজুল) মাদারীপুর শাখার সভাপতি মো: হুমায়ুন কবির বলেন, “এই প্রশ্নের সাথে যারা সম্পৃক্ত, যিনি প্রশ্ন করেন, যিনি মডারেট করেন এবং ওই কমিটি যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন তারাই এরজন্য দায়ী।”
বিষয়টি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, “প্রশ্নপত্রে এ ধরনের মিথ্যাচার শিক্ষাব্যবস্থার কলঙ্ক। আরো দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এটা যে শুধু শিক্ষক সমিতির প্রশ্নপত্র প্রণয়নেই হয় তা নয়। বরং বিভিন্ন সময় এসব বিদ্যালয়ের জন্য বাজার থেকে কেজি দরে প্রশ্ন কেনা হয়। তাহলে এসব প্রশ্নের মান কীভাবে থাকবে।”
এ ব্যাপারে মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর কন্যা ও দৈনিক দেশেরপত্রের সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী বলেন, “শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারে হাজার বছরের পুরোনো পন্নী পরিবারের অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও এ পরিবারের সদস্যরা এবং আমার বাবাও অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি ১৯৯৫ সনে অরাজনৈতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদ প্রতিষ্ঠা করেন। বিগত ২৪ বছর থেকে বাংলাদেশে ধর্মব্যবসা, জঙ্গিবাদ, ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সাহসী ভূমিকা রেখে চলেছে আমার বাবার প্রতিষ্ঠিত আন্দোলন হেযবুত তওহীদ। এমন একজন মানুষের বিরুদ্ধে কী করে এমন জঘন্য মিথ্যা কথা প্রচার করে দিল ভাবতেও অবাক লাগে। বাবা তার বক্তব্যে ও লেখায় শত শত বার তিনি নিজে বলেছেন যে, হযরত মোহাম্মদ (সা.) শেষ নবী ও রসুল। এও বলেছেন যে, তিনি নবী-রসুল নন। তাঁর সেসব বক্তব্যের ভিডিও আমাদের কাছে আছে। আমি মনে করি, তাঁর উপর এই অপবাদ আরোপ মূলত সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতিকে হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে সহিংসতা সৃষ্টির পাঁয়তারা। এমন অপপ্রচার ধর্মব্যবসায়ী একটা গোষ্ঠী তাদের ওয়াজে খোতবায় এতদিন করে এসেছে যার জন্য আমরা বহু স্থানে জানমালের ক্ষতির শিকার হয়েছি। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার মতো এমন একটি দায়িত্বপূর্ণ জায়গায় সেই ধর্মব্যবসায়ী গুজব সৃষ্টিকারীদের এজেন্টরা ঘাপটি মেরে আছে এটা সত্যিই বিস্ময়কর। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি করছি।”
তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা উম্মুত তিজান মাখদুমা পন্নী বলেন, “আমাদের পারিবারিক সুনাম ক্ষুণœ করার জন্য এবং হেযবুত তওহীদের বিষয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বাবা তাঁর বই ‘দ্যা লস্ট ইসলাম’- এর ৩০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, তিনি কোন নবী রসুল নন, তিনি কেবল প্রকৃত ইসলাম মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। হেযবুত তওহীদের একজন অনুসারীও এমন বিশ্বাস লালন করেন না যে, আমার বাবা নবী-রসুল ছিলেন। সুতরাং তার বিষয়ে যারা এমন মিথ্যাচার করেছে আমরা তাদের বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সাবেক বিচারপতি সিকদার মকবুল হক বলেন, “আমার জানা মতে বায়াজিদ খান পন্নী কখনো তার লেখা বা বক্তব্যে নিজেকে নবী বলে দাবি করেন নি। এমনকি তার অনুসারীদের কোন বক্তব্যেও আমি এধরনের কিছু পাই নি।” তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের কথা না বলা সত্ত্বেও প্রশ্নপত্রে এ ধরনের উদ্ধৃতি দেওয়া নি:সন্দেহে আইনত দ-ণীয় অপরাধ। এটি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অপরাধের মধ্যে পড়ে।”  
প্রশ্নপত্রে সেলেবাস বহির্ভূত প্রশ্ন করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষয়ে জড়িতদের আইনানুগভাবে শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে জানান মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: সাইফুদ্দিন গিয়াস।

Comments (0)
Add Comment