আন্তর্জাতিক ডেস্ক : তালেবান আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিলেও দেশটিতে এখনো গৃহযুদ্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে। সেই পরিস্থিতি এড়াতেই প্রভাবশালী আফগান নেতাদের পাশে পেতে মরিয়া তালেবান। তাই সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে আফগানিস্তানে সরকার গঠন করাটা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই কাজে আটজন আফগান নেতাকে তালেবানের প্রয়োজন। নিচে তাদের পরিচয় ও ভূমিকা তুলে ধরা হলো-
সাবেক প্রধানমন্ত্রী গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার :
সাবেক আফগান প্রধানমন্ত্রী এবং এক সময়ের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল হিজব-ই-ইসলামির প্রভাবশালী নেতা তিনি। দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গির তালিকাতেও ছিলেন।
১৯৮০’র দশকে শীতল যুদ্ধের যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মার্কিন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজাহিদিন যোদ্ধাদের একজন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার গত ২৫ বছর ধরে কট্টর ইসলামপন্থী সশস্ত্রগোষ্ঠী তালেবানদের মিত্র এবং শত্রু উভয়ই ছিলেন।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্যরা আফগানিস্তানে আসার পর তিনি জোটের সৈন্যদের উপর আত্মঘাতী হামলার সমর্থক ছিলেন এবং মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার।
তালেবানের নেতৃত্বে সরকার গঠনের জন্য সংলাপ এবং নির্বাচনের সমর্থক হেকমতিয়ার এখন তালেবান নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তাকে আফগান রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত করেছে।
হামিদ কারজাই, সাবেক প্রেসিডেন্ট :
হামিদ কারজাই এখন সেইসব লোকের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসেছেন, যারা একসময় তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। তালেবানরা যখন কাবুলে ঢুকলো এবং তার উত্তরসূরি গনি পালিয়ে গেল, তখন কারজাই এক ভিডিও বার্তায় তার দেশে থাকার সংকল্পের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
যদিও কাবুলের বিশৃঙ্খলার মধ্যে তার ওই বার্তার প্রভাব ছিল সামান্য। তবে এটা বিশেষ কারণে শক্তিশালী ছিল এই কারণে যে, তিনি তার অল্পবয়সী মেয়েদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত সেই ভিডিও বার্তায় হাজির হয়েছিলেন। সরকার গঠনের আলোচনায় তিনি এখন সবচেয়ে সক্রিয় মুখ।
ভারতে পড়াশোনা করা হামিদ কারজাই আফগান প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ড্রোন ব্যবহার ও ২০১৪ সাল পর্যন্ত মার্কিন সেনাদের আফগানিস্তানে রাখতে চুক্তি স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এরপর ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট পদ হারান তিনি।
আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ, আফগানিস্তানের সাবেক প্রধান নির্বাহী :
নর্দান অ্যালায়েন্সের প্রধান আহমদ শাহ মাসুদের উপদেষ্টা আবদুল্লাহ পেশায় চিকিৎসক এবং একজন রাজনীতিক। একসময় তালেবান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তাজিক গোষ্ঠীর নেতা আবদুল্লাহ এখন তালেবানের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসেছেন।
আফগানিস্তানের জন্য শান্তি চুক্তি সহজ নয়, এটা হয়তো আবদুল্লাহর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। তিনি ‘আফগান হাই কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশনের’ নেতৃত্বে ছিলেন। প্রত্যাশা ছিল এই কাউন্সিলই বর্তমানে মৃত আন্তঃআফগান শান্তি আলোচনার নেতৃত্ব দেবে।
আবদুল্লাহ দুইবার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ের খুব কাছাকাছিও চলে যান। ফলাফল নিয়ে বিরোধের ফলে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির মধ্যস্থতায় আশরাফ গনি এবং আবদুল্লাহর মধ্যে তখন ক্ষমতার ভাগাভাগি চুক্তি হয়।
আব্দুল রশিদ দস্তুম, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট :
উজবেক নেতা আব্দুল রশিদ দস্তুম আফগান রাজনীতির আরেক অভিজ্ঞ ব্যক্তি, যিনি চার দশকের লড়াইয়ে বেশ কয়েকবার দলবদল করেছেন। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নর্দান অ্যালায়েন্সের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন তিনি।
দস্তুম সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত আশরাফ গনি সরকারের সমর্থক ছিলেন এবং ২০১৩ সাল থেকে ৬ বছর আফগানিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধর্ষণের আদেশ দেওয়ার মতো অভিযোগ রয়েছে, যা তিনি অস্বীকার করে থাকেন।
স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে তুরস্কে বেশ কয়েকবছর ছিলেন রশিদ দস্তুম। আফগানিস্তানে থাকলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এমন ভয় থেকেই তিনি তুরস্কে পালিয়ে ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে বিরোধীদের। বিরোধীরা তাকে দেশে এনে বিচারের দাবিও জানিয়েছিলেন।
তালেবানের দ্রুতগতিতে একের পর এক প্রদেশের দখলের মধ্যে আফগানিস্তানে ফেরেন দস্তুম। ধারণা করা হয়েছিল, তিনি তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়বেন কিন্তু তালেবান সহজে মাজার-ই-শরীফ দখলে নেয়। বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়েন দস্তুম। তবে কোথায় আছেন জানা যায়নি।
আমরুল্লাহ সালেহ, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও গোয়েন্দাপ্রধান :
তালেবান রাজধানী কাবুলের দখল নিয়ে নিলে আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে পালান। এরপর গনি সরকারে এই ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দেশটির সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান আমরুল্লাহ সালেহ নিজেকে আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন।
আমরুল্লাহ সালেহ ২০১৭ সালে গনি সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন। তিনি আফগানিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার নেতৃত্বও দিয়েছেন। গত সেপ্টেম্বরে সহ তালেবানদের একাধিক হত্যাচেষ্টার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া আমরুল্লাহ এখন পঞ্জশির উপত্যকায় রয়েছেন।
আফগানিস্তানে এখনও পর্যন্ত পঞ্জশির উপত্যকা একমাত্র ঘাঁটি যেখানে তালেবান যোদ্ধাদের প্রতিরোধ করা হয়েছে। সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা ও ভুমিপুত্র আহমেদ মাসুদের সঙ্গে মিলে আমরুল্লাহ সালেহ তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
আহমেদ মাসুদ, তালেবান বিরোধী নেতা :
নিহত তাজিক মুজাহিদিন কমান্ডার আহমদ শাহ মাসুদের পুত্র তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মুখ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন। কিন্তু এটা নির্ভর করছে তিনি বিদেশ থেকে যথেষ্ট সাহায্য পান কিনা তার ওপর। তবে পঞ্জশিরে এখনো তালেবানকে ঢুকতে দেয়নি মাসুদ বাহিনী।
গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা কলামে যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করা মাসুদ লিখেছিলেন তার যোদ্ধারা ‘আবারও তালেবান মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। আর যদি পশ্চিমা বন্ধুরা আমাদের অস্ত্র না পাঠায় তাহলে আমাদের হাতে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে।’
আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে পঞ্জশির উপত্যকাই একমাত্র প্রদেশ, তালেবানের হাতে যার এখনও পতন হয়নি। কিন্তু তালেবান বলছে, বিদ্রোহীদের দখলে থাকা ওই এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য সেখানে তাদের যোদ্ধাদের পাঠানো হচ্ছে।
পঞ্জশির উপত্যকায় তালেবান-বিরোধীদের নিয়ে গঠিত একটি জোটের প্রধান আহমেদ মাসুদ। জোটটির নাম এনআরএফ বা ন্যাশনাল রেজিসটেন্স ফ্রন্ট অব আফগানিস্তান। যদিও মাসুদ বর্তমানে তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতার ইঙ্গিত দিয়ে আলোচনা করছেন।
আতা মোহাম্মদ নূর, প্রভাবশালী নেতা :
তাজিক নেতা আতা মোহাম্মদ নূর সোভিয়েত আক্রমণের পর থেকে আফগানিস্তানের যুদ্ধে জড়িত ছিলেন এবং তালেবানের বড় শত্রুদের একজন। তিনি আফগানিস্তানের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী প্রদেশ উত্তর বালখের গভর্নর ছিলেন। ২০১৮ সালে গনি তাকে বরখাস্ত করেন।
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের মধ্যে আগস্টের শুরুতে তালেবানের হাতে একের পর এক প্রদেশের পতনের মধ্যে প্রাদেশিক রাজধানী শহর মাজার-ই-শরীফ তালেবানের দখলে যাওয়ার সাথে সাথে আতা মোহাম্মদ নূর তার এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী দোস্তুমকে নিয়ে পালিয়ে যান।
এই বছরের শুরুর দিকে তালেবানের গতি বাড়ার সাথে সাথে নূর প্রথম ব্যক্তি যিনি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নতুন মিলিশিয়া গঠন এবং গণঅভ্যুত্থানের আহ্বান জানান। তালেবানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন তিনি।
তালেবানের হাতে আফগানিস্তানের পতনের পর টুইটারে আতা নূর অভিযোগ করেন, আফগান বাহিনীর এমন আত্মসমর্পণ বৃহত্তর একটি ‘সংগঠিত এবং কাপুরুষোচিত চক্রান্তের অংশ’ এবং তিনি লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বর্তমানে উজবেকিস্তানে আছেন তিনি।
মোহাম্মদ করিম খলিলি, হাজারা সম্প্রদায়ের নেতা :
আফাগনিস্তানের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ করিম খলিলি হাজারা সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী নেতা। গত ১৫ আগস্ট তালেবানদের হাতে কাবুলের পতনের পর জ্যেষ্ঠ আফগান রাজনীতিবিদের যে দলটি পাকিস্তানে গিয়েছিল তাদের একজন ছিলেন করিম খলিলি।
গত সপ্তাহে একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেছেন যে, তিনি আশা করেন তালেবানদের শীর্ষ নেতৃত্ব একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক শৃঙ্খলা তৈরি করবে। তিনি এর উপর গুরুত্বারোপ করে আরও বলেন, ‘আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এর উপর।’