স্বাস্থ্য ডেস্ক:
ব্যথায় আক্রান্ত হননি এমন কাউকে যেমন খুঁজে পাওয়া যাবে না, তেমনি কারো কারো ক্ষেত্রে ব্যথা যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের অনেকে শীতকালের শুরুতেই ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যান। কারণ শীতকালে তাঁদের ব্যথার সমস্যাটি গভীর হয় এবং কষ্ট বেড়ে যায়।
বেড়ে যায় অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ব্যথা
শীতকালে কয়েকটি কারণে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ব্যথা বেড়ে যায়। শীতকালে একদিকে যেমন বিভিন্ন জয়েন্টের ভেতরে থাকা তরল পদার্থ বা সাইনোভিয়াল ফ্লুইডের ঘনত্ব বেড়ে যায়, অন্যদিকে আমাদের বায়ুমণ্ডলের চাপ কমে যায়; যে কারণে বিশেষ করে হাঁটুর জয়েন্টে আমাদের শরীরের ওজন বেশি অনুভূত হয়। যাঁদের শরীরের ওজন বেশি, তাঁদের এ অবস্থায় বেশি সমস্যা তৈরি হয়। যাঁদের ওজন নিয়ন্ত্রণে আছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও যদি আগে থেকে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের সমস্যা থাকে, তাহলে শীতকালে সমস্যাটি আরো বেশি অনুভূত হয়। তাই যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি অস্টিওআর্থ্রাইটিস সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ওজন নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ ওজন যত বেশি থাকবে, হাঁটুর জয়েন্টের ওপরে চাপ তত বেশি হবে এবং জয়েন্টের ভেতরের পাতলা আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের প্রবণতা বেড়ে যাবে।
বাতের ব্যথা-
শীতকালে বাতজাতীয় সমস্যাগুলো বেড়ে যেতে পারে। বাতের সমস্যায় মূলত আমাদের শরীরের ছোট-বড় বিভিন্ন জয়েন্টে প্রদাহজনিত সমস্যা বেড়ে যায়। এই সময়ে জয়েন্টের তরল পদার্থ কমে জয়েন্টগুলো শক্ত হয়ে যায়, যে কারণে নাড়াচাড়া করতে গেলেই ব্যথা অনুভূত হয়।
বয়সজনিত সমস্যা-
শীতকালে বয়স্করা একটু বেশি আড়ষ্ট থাকেন। তখন তেমন একটা নড়াচড়া না করায় শরীরের জয়েন্টগুলোর মুভমেন্ট হয় কম। ফলে তাঁদের জয়েন্টগুলো স্টিফ বা শক্ত হয়ে যায়। আর এ কারণেই যখনই তাঁরা মুভমেন্ট করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন, তখন ব্যথা অনুভব করেন। যাঁদের ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, উচ্চ রক্তচাপ ও অন্য কোনো হরমোনজনিত সমস্যা রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে যদি এসব অবস্থার নিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে না থাকলে ব্যথার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। অস্বাভাবিক অবস্থায় ঘুমানো মেরুদণ্ড ও কোমর ব্যথার একটি অন্যতম কারণ। চেয়ারে, সোফায় অথবা অস্বাভাবিক অবস্থায় বিছানায় ঘুমানোর কারণে মেরুদণ্ডের ও পেছনের মাংসপেশির রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হয়ে কোমরে ব্যথা হতে পারে।
সতর্কতার সঙ্গে ব্যায়াম করুন-
যাঁরা শীতকালে ব্যায়াম শুরু করবেন, তাঁদের একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে-শুরুতেই যেন অতিরিক্ত প্রেসারের ব্যায়াম না করেন। শুরুতেই অতিরিক্ত প্রেসারের ব্যায়াম করলে অনেক সময় মাংসপেশিতে ইনজুরি হয়ে ব্যথা হতে পারে। তবে স্বাভাবিক ব্যায়াম করার সময় মাংসপেশিতে কিছুটা ব্যথা অনুভূত হলেও পরবর্তী দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। আঘাতজনিত কারণে যেকোনো সময়ই ব্যথা হতে পারে। তবে শীতকালে অল্প আঘাতেই যেন কঠিন ব্যথা অনুভূত হয়।
শীতে ব্যথামুক্ত থাকতে যে অভ্যাসগুলো নিয়মিতভাবে করা উচিত,
♦ প্রথমত, নিজেকে সক্রিয় বা কর্মক্ষম রাখতে হবে। এর মাধ্যমে আমাদের শরীরের রক্ত চলাচল সঠিক থাকবে এবং ব্যথামুক্ত থাকতে পারব।
♦ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েডজনিত সমস্যা বা অন্য যেকোনো হরমোনজনিত সমস্যা থাকলে সেগুলোর জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
♦ নিয়মিত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করতে পারি। হাঁটার সময় এ ক্ষেত্রে সকালে নাশতার আগে অথবা রাতে খাওয়ার পরে সময়টিকে বেছে নিতে পারেন। হাঁটার ক্ষেত্রে প্রথম ১০ মিনিট ধীরে, পরবর্তী ১০ মিনিট মধ্যম গতিতে এবং শেষের ১০ মিনিট ধরে ঘাম ঝরানো হাঁটার মাধ্যমে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
♦ ব্যথামুক্ত থাকতে আমাদের দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মে বসে কাজ করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদি বসে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে একটানা আধাঘণ্টা বসার পরে নূন্যতম তিন থেকে পাঁচ মিনিটের একটি ব্রেক নিতে পারেন। বসার ক্ষেত্রে শুধু কাঠের চেয়ার ব্যবহার বিজ্ঞানসম্মত নয়, বরং হালকা কুশন ব্যবহার করে বসতে পারেন। এর মাধ্যমে কোমরে ব্যথার খুবই কমন সমস্যা সায়াটিকা থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন।
♦ বাসায় যাঁরা বৃদ্ধ রয়েছেন, শীতের সময় যত্নসহকারে তাঁদের জয়েন্টগুলোকে নড়াচড়া করিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে লোশন বা তেলজাতীয় মালিশ ব্যবহার করা যেতে পারে, যা তাঁদের ত্বককে রুক্ষতা থেকে রক্ষা করে এবং একই সঙ্গে তাঁদের মাংসপেশির রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রাখে।
♦ শীতকালীন ব্যথায় গরম সেঁক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে আমাদের মাংসপেশির রক্ত চলাচল বাড়ে এবং জয়েন্টগুলোর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গরম সেঁকের ক্ষেত্রে গরম পানি বা গরম কাপড় যেকোনোটা ব্যাবহার করা যায়। তবে বরিক পাউডার ব্যবহার করে সেঁক দেওয়ায় বিশেষ কিছু নেই। এতে শুধু গরমের স্থায়িত্ব বাড়তে পারে।
♦ শীতকালে ঠাণ্ডা লেগে বাচ্চাদের অনেকেই কানে ব্যথার সমস্যায় ভুগতে পারে। কানের সঙ্গে গলার মাধ্যমে মুখের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাচ্চাদের যাতে ঠাণ্ডা লেগে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঠাণ্ডা লাগলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
♦ স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস প্রতিনিয়তই আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও ব্যথামুক্ত রাখতে ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ খাবার (দুধ, পনির, মাশরুম) আমাদের হাড়ের গঠন এবং ক্যালসিয়ামের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভূমিকা পালন করে। একই সঙ্গে শর্করাজাতীয় খাবার কম খেয়ে আমিষ ও ফাইবার জাতীয় খাবার বেশি খেয়ে আমরা আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি।
♦ সঠিক ঘুমের পদ্ধতি আমাদের সব ধরনের ব্যথা থেকে মুক্ত রাখতে ভূমিকা পালন করে। ঘুমানোর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শক্ত বিছানা যেমন বিজ্ঞানসম্মত নয়, তেমনি ফোমের বা অতিরিক্ত নরম বিছানাও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক তোশকের বিছানা ব্যবহার করতে পারেন। মাথা ও ঘাড়ের রক্ত চলাচল ঠিক রাখতে শুধু মাথার নিচে বালিশ না দিয়ে ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত বালিশ ব্যবহার করলে দীর্ঘমেয়াদি মাথা ও ঘাড় ব্যথার সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যেতে পারে।
♦ যাঁরা অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বক্স ব্রিদিং নামে একটি এক্সারসাইজ রয়েছে। এই এক্সারসাইজটি সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট করতে পারলে আমরা আমাদের মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব।
লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস, এমডি (বিএসএমএমইউ) এফআইপিএম (ইন্ডিয়া) কনসালট্যান্ট ও ব্যথা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন, কাটাবন, ঢাকা।