গত শুক্রবার সন্ধ্যায় অরাজনীতিক আন্দোলন হেযবুত তওহীদের উদ্যোগে ঢাকার তেজগাঁও কলেজ মিলনায়তনে ‘মানবতার কল্যাণে ধর্ম – শান্তির জন্য সংস্কৃতি’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক বিচারপতি জনাব তাফাজ্জল ইসলাম। অনুষ্ঠানে আগত আলোচকদের আলোচনা শেষে তিনি সকলের উদ্দেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যের মধ্যে উঠে আসে মানবতার কথা, মনুষ্যত্বের কথা। তিনি বলেন, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইহুদিসহ সকল ধর্মের মূলমন্ত্র একটাই, সেটা হলো মানুষের কল্যাণ, মানবতার কল্যাণ। কিন্তু যারাই মানবতার কথা বলে এক শ্রেণির ফতোয়াবাজ তাদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের কথা স্মরণ করে বলেন, বিদ্রোহী কবিও ফতোয়াবাজদের প্রচণ্ড বিরোধিতার শিকার হয়েছিলেন মানবতার কথা বলতে গিয়ে, তার বিরুদ্ধে হিন্দু, মুসলিম সব ফতোয়াবাজরা উঠে পড়ে লেগেছিল। অথচ তার গানের মর্মবাণী কোনো ধর্মের সাথেই সাংঘর্ষিক নয় বরং তার সেই কথার মধ্য দিয়ে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাই ফুটে ওঠে। “রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করোনা বিচার, বিচার চাহি না তোমার দয়া চাহে এ গুনাহগার।… বিচার যদি করবে কেন রহমান নাম নিলে, ঐ নামের গুনে তরে যাব কেন এ জ্ঞান দিলে।” ধর্মকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এত সুন্দর কথা বললেন, অথচ সেই কাজী নজরুল ইসলামই ফতোয়াবাজদের বিরোধিতার শিকার হলেন। তবুও তিনি হার মানেন নি, ধর্মকে ফতোয়াাবজদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে গেছেন, বহু কাজ করে গেছেন।
তিনি বক্তব্যের এক পর্যায়ে রসুলাল্লাহর মদীনা সনদের কথা উল্লেখ করে বলেন সেখানে রসুলাল্লাহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দিলেন। আজকে ম্যাগনাকার্টাসহ অনেক কিছু হয়েছে, কিন্তু প্রথম হলো মদীনা সনদ। সেখানে বলা হলো যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে, রাষ্ট্র থেকে তোমাদেরকে বাধা দেওয়া হবে না।
“সংস্কৃতি, শিল্প আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ছাড়া সভ্যতার প্রকাশ করা যায় না।” -মুখ্য আলোচক রুপায়দাহ পন্নীর এই উক্তিটি উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, এই কথার সাথে আমি যোগ করবো যে, আসলে একটা দেশ কতটুকু সভ্য সেটা যেরকম যান্ত্রিক উন্নতির সাথে বা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে বিচার করা হয় একইভাবে সাংস্কৃতি বা শিল্পকলার মাধ্যমেও বিচার করা হয়। মুসলিমদের সংগীত অনুরাগ ও সংগীতে তাদের অবদান সম্পর্কে তিনি বলেন, এই উপমহাদেশে মুসলমান শিল্পিরা ছিলেন সংগীতের শীর্ষে, ওস্তাদ আলা উদ্দিন খান, বড়ে গোলাম আলী তাদের মধ্যে অন্যতম। তারা সংগীতকে সৃষ্টিকর্তার আরাধনা হিসাবে কল্পনা করতেন, আসলে হয়ও তাই। তারা সারাদিন সংগীতের মধ্যে ডুবে থাকতেন, সংগীতের মধ্যেই ইশ্বরের খুঁজ পেতেন। রবীন্দ্রনাথের কথা ধরা হোক, তার বিরুদ্ধেও গোড়া হিন্দুরা লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথ একটা গানে বলছিলেন যে, “চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে, অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহিরে।” আসলে আমার অন্তরে কী, আমি কী, যদি এটা মানুষ দেখতে পারে, অনুধাবন করতে পারে তাহলে মানুষ অনেক উপরে উঠে যায়। তখন তার দ্বারা কোনো নোংরা কাজ সম্ভবপর হয় না। সে-ই তখন ইশ্বর, আল্লাহ, ভগবানকে খুঁজে পায়।
বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলাম তার পুরোনো দিনের একটি স্মৃতি চারণ করেন। তিনি বলেন, তখনও আমি আপিল বিভাগের বিচারক, প্রধান বিচারপতি হই নি। কুমিল্লা দাউদকান্দিতে আমার গ্রামের বাগান বাড়ির পাশে একটা মাদ্রাসায় ওয়াজ মাহফিল হচ্ছিল। লোকজনের অনেক অনুরোধে আমিও সেখানে গেলাম। দেখলাম যিনি ওয়াজ করবেন তিনি ১২/১৪টা মাইক্রোবাস নিয়ে আসলেন, তার সাথে অনেক শিষ্য। শুরু হলো জ্বালাময়ী ওয়াজ, দশমিনিটের মধ্যেই মানুষ কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। ওয়াজের মধ্যে বলা হচ্ছে যে, কালকের মধ্যেই আপনারা আপনাদের ছেলে মেয়েদেরকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে মাদ্রসায় ভর্তি করাবেন। আমি সহ্য করতে না পেরে উঠে চলে আসলাম, পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, যিনি ওয়াজ করছেন তার ছেলে মেয়ে পড়ে বিলেতে। এখন চার দিকে এটাই ছড়িয়ে আছে, এটা আসলে কি মোনাফেকী, না অন্য কিছু? এখন মানবতার স্খলন চূড়ান্ত পর্যায়ে, নৈতিকতার স্খলনও চূড়ান্ত পর্যায়ে, দুটোই ভুলুণ্ঠিত। এখন আমার মনে পড়ছে সেই কবিতাটা, “ আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও। আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও।”