সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপিত হবে কিভাবে?

রাকীব আল হাসান
সম্প্রতি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর হামলা, বিদেশিদের জিম্মি করে হত্যা ইত্যাদি নিয়ে সরকার প্রধান, রাজনীতিক দলগুলো এবং দেশের সাধারণ মানুষ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। এসব ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। একইসাথে এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনায় বহির্বিশ্বে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, শান্তির ধর্ম ইসলাকে নিয়ে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে।
অবহমান কাল থেকে এ উপমহাদেশসহ আমাদের দেশে সম্প্রীতির সাথে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে আসছেন। তারা সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে আত্মীয়ের মতো। ফলে ধর্মীয় সম্প্রীদের দেশ হিসাবে বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর বুকে এক অনন্য উদাহারণ। কিন্তু জঙ্গিবাদের ভয়াবহ চক্রান্তের জালে আটকে সেই সম্প্রীতি আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় সেই সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারের টেকসই পথ কেউ বাতলাতে পারছেন না। কিন্তু সকল ধর্মের মধ্যে যে সকল বিষয়ে মিল রয়েছে তা মানুষের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলে শুধু সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনস্থাপন হবে না, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনও সহজতর হবে।
পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মীয় জাতিগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে যতগুলো অমিল লক্ষ্য করা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি মিল পরিদৃষ্ট হয়। অথচ রাজনৈতিক কারণসহ দেশি-বিদেশী স্বার্থান্বেষী মহলের এবং একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়িদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে কেবলমাত্র জাতিগুলোর অমিল বা মতদ্বৈততা আছে এমন বিষয়গুলোকেই বারবার সামনে আনা হয়, আর মিলগুলোকে সুচতুরভাবে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। ফলে এই কপটতার বলি হতে হয় সকল ধর্মের সাধারণ মানুষকে।
সনাতন ধর্ম ও ইসলাম?
ভারত উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রায় ১১০ কোটি সনাতন ধর্মের অনুসারী রয়েছেন। ধর্মীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধর্মগ্রন্থের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ এই জাতিটি বরাবরই ধর্মানুরাগী হিসেবে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। এই ভারতবর্ষে যেসকল অবতারগণের আগমণ ঘটেছে তারা সকলেই ছিলেন সনাতন ধর্মের ধারক।
সনাতন শব্দের অর্থ যা নিত্য, চিরসত্য, স্বতঃসিদ্ধ, শাশ্বত। আল কোর’আনে ইসলামকে বলা হোয়েছে ‘দীনুল কাইয়্যেমা’। এই কাইয়্যেমাহ শব্দের অর্থও নিত্য, শাশ্বত অর্থাৎ যা সনাতন। সে হিসেবে সনাতন ধর্মাবলম্বী আর মুসলিমরা ভাই হতে বাধা কোথায়? কিন্তু অতি সুচতুরভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বী থেকে মুসলিমদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্য ‘হিন্দু’ শব্দটিকে সনাতন ধর্মের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৮৩০ সালের আগে এই এলাকার মানুষের ধর্মকে হিন্দু ধর্ম কখনোই বলা হোত না। হিন্দু ধর্ম বা Hinduism এই শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা যা ছিলো তাদের সুচতুর ষড়যন্ত্রের একটি পদক্ষেপমাত্র। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ২০ খন্ডের ৫১৯ পৃষ্ঠায় ‘Hinduism’ অধ্যায়ে বলা হোয়েছে, ”The term Hinduism … [was] introduced in about 1830 by British writers.”
এভাবে ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এভাবে সম্প্রীতে বসবাসকারী দুটি জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিল। সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটানো তাদের সহজ হোয়ে গেলো। যার চুড়ান্ত ফলাফল আমরা দেখতে পেলাম ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে। এতে না লাভ হলো হিন্দুদের না হলো মুসলিমদের, যাদের লাভবান হবার দরকার ছিল সেই ঔপনেবিশকরা কিন্তু ঠিকই লাভবান হয়েছে।
সকল মানুষ একই পিতা-মাতা আদম হাওয়ার সন্তান, সকলেই সকলে আত্মীয়। সনাতন ধর্মের গ্রন্থে এই আদি পিতা-মাতাকে আদম ও হব্যবতী বোলে উল্লেখ করা হোয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রাথমিকভাবে মহর্ষী মনুর অনুসারী। অনেক গবেষক গাণিতিক যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন মহর্ষী মনুই হোচ্ছেন কোর’আনে বর্ণিত নূহ (আ:)। সুতরাং মুসলিম ও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আদিতে একই নবীর অনুসারী ছিলেন। আর ইসলাম ধর্মমতে নূহ (আ:) এর অনুসারীরা ছাড়া সমস্ত মানব জাতিই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সুতরাং পৃথিবীতে বিরাজমান সকল মানুষের পূর্বপুরুষগণ একসময় নূহের (আ:) অনুসারী ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে অনৈক্য হবার সুযোগ কোথায়?

খিস্টান ধর্ম ও ইসলাম:
মুসলিমরা যেমন আল্লাহর প্রেরিত নবী মোহাম্মদ (সা.) এর অনুসারী, তেমনি খ্রিস্টানরাও ঈসা (আ:) অনুসারী যাকে তারা যিশু খ্রিস্ট বলে থাকে। আদি পিতা আদম-হাওয়ার সন্তান বলে তারা উভয়ই স্বীকার করে। যাকে বাইবেলে বলা হোয়েছে অ্যাডাম-ইভ। নবী হিসাবে ঈসা (আ:) কে স্বীকৃতি দেয়া, সম্মান করা শুধু একজন মুসলিমের কর্তব্যই নয়, ঈমানী দায়িত্ব। কোন মুসলিম যদি তাঁকে অস্বীকার করে তবে সে কাফের হয়ে যাবে (সুরা নেসা- ১৫১)।
তাছাড়া ইব্রাহীম (আ:) কে মুসলিমরা যেমন জাতির পিতা বোলে মান্য করেন। খ্রিস্টানরাও তাই করে। আল্লাহ বলেন, “এটাই (ইসলাম) তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের দীন। আল্লাহ তোমাদের নাম রেখেছেন “মুসলিম”। পূর্বের গ্রন্থাবলীতেও আবার এই গ্রন্থেও (কোর’আন) ঐ নামই দেয়া হোয়েছে। (সুরা আল-হাজ্জ ৭৮)।
বাইবেলে বলা হোচ্ছে: Abraham is “the father of all those who believe”, both of the circumcised and the uncircumcised (Rom 4:9-12). অর্থাৎ আব্রাহাম খাৎনাকারী এবং খাৎনা বিহীন নির্বিশেষ সকল বিশ্বাসী মানুষের পিতা। ঈসা (আ:) তাঁর অনুসারীদের বোলছেন, “If you were Abraham’s children, then you would do what Abraham did. (John 8:39) অর্থাৎ যদি তোমরা ইব্রাহীমের সন্তান হোয়ে থাকো তবে সেই কাজই তোমাদের কর্তব্য যা ইব্রাহীম করেছেন। সুতরাং এদিক দিয়েও মুসলিম খ্রিস্টান একই পিতার দুই পূত্র।
আমরা কোরআনে পাই ঈসা (আ:) আল্লাহর তওহীদ তথা একত্ববাদ শিক্ষা দিয়েছেন। বাইবেলেও আমরা পাই, একদিন একজন লোক তাঁর কাছে জানতে চাইলো, সকল অনুশাসনের (commandment) মধ্যে সর্বপ্রথম অনুশাসন কি? ঈসা (আ:) উত্তরে বোললেন, “শোন হে বনী ইসরাইল। সর্বপ্রথম অনুশাসন হোচ্ছে আমাদের প্রভু আল্লাহ হোচ্ছেন একমাত্র প্রভু, “The first of all the commandments is, Hear, O Israel; The Lord our God is one Lord.” (The 12th chapter of Mark)
হাদিসে বলা আছে ঈসা (আ:) আবার আসবেন এবং দাজ্জাল ধ্বংস করে এমন শান্তি প্রতিষ্ঠা কোরবেন যে, নেকড়ে আর ভেড়া এক সাথে থাকবে। বাইবেলও বলছে যিশু খ্রিস্ট আবার আসবেন এসে এন্টি ক্রাইস্ট ধ্বংস কোরবেন, ‘কিংডম অব হ্যাভেন’ প্রতিষ্ঠা কোরবেন। এ বিষয়েও উভয়ের বিশ্বাস একই। তাহলে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে এত শত্রুতা সৃষ্টির মতো পার্থক্য রোইল কোথায়?
খ্রিস্টান নামধারী কিন্তু না মানে ইঞ্জিলের বিধান, না মানে ঈসা (আ:) এর উপদেশ এক কথায় যারা স্রষ্টার বিধান মানে না তারা আসলে ঈসা (আ:) এর প্রকৃত অনুসারী নয়। তেমনিভাবে যারা না মানে কোর’আনের বিধান, না অনুসরণ করে শেষ নবীর আদর্শ, তারা মুসলিম বংশোদ্ভূত হোলেও মুসলিম নয়, উম্মতে মোহাম্মদী নয়। আর এরাই তারা যারা চায় ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থ উদ্ধার, দাঙ্গা ও সহিংসতা সৃষ্টি। তারা চায় না সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করি।
অন্যান্য ধর্মের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন- যে ঈমানদারগণ, আল্লাহর পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে তোমরা তাদের গালী দিও না, কারণ সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত তারা তোমার আল্লাহকেও গালি দিবে।” (সুরা আন-আম-১০৮) এ আয়াতেই স্পষ্ট হয়ে যায় আল্লাহ অন্যান্য ধর্মকে অবমাননা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহর এই নিষেধ ভঙ্গ করে মুসলিমরা কিভাবে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণ করতে পারে।
রসুল (স.) যখন মদিনায় রাষ্ট্র গঠন করলেন তখন তিনি সেখানকারে খ্রিষ্টান, ইহুদি, মুর্তিপূজক, মোনাফেক সবাইকে নিয়েই করলেন মদিনার সনদ। সেখানে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসাবে সকলের মূল্যই সমান রাখা হলো। কাউকে খাটো করা হলো না। এমনকি অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের আভ্যন্তরীণ বিচার ফয়সালা তাদের নিজ নিজ ধর্মীয়গ্রন্থে বর্ণিত আইন অনুসারেই করার বিধান রাখা হলো। এক কথায় তিনি ইসলামকে কারো উপর চাপিয়ে দিলেন না। ফলে দীনের এই মাহত্ম্য দেখে সেখানকার অনেক ইহুদি-খ্রিষ্টান ইসলাম গ্রহণ করল। আর যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলো তারা চুক্তি ও আইন মোতাবেক শাস্তি ভোগ করল। যেটা বর্তমানে সব জাতি রাষ্ট্রই করে থাকে।
এটা প্রসিদ্ধ ইতিহাস যে, মক্কা বিজয়ের পর রসুলাল্লাহ (সা.) কাবা ঘরে স্থাপিত বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি ভেঙে ফেলছিলেন। সেগুলো ভেঙ্গেছিলেন এজন্য যে সেগুলো অন্য ধর্মের কোনো দেবদেবী ছিল না, সেগুলো ছিল স্বয়ং ইব্রাহীম (আ:) অনুসারীদেরই কল্পিত বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। অথচ কাবার অভ্যন্তরভাগের দেওয়ালে ঈসা (আ:) ও মা মরিয়ম (যিশু খ্রিস্ট ও মাতা মেরির) ছবিও ছিল। আল্লাহর রসুল সকল মূর্তি ভাঙলেও, সকল ছবি ধুয়ে ফেললেও ঐ ছবিটা নষ্ট কোরলেন না। কয়েক শতাব্দী ঐ ছবি সেখানেই ছিলো। পরে কাবাঘর পুনসংস্কার করার সময় সেই ছবিগুলি নষ্ট হোয়ে যায় (সূত্র: সিরাত ইবনে ইসহাক)।
খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হোয়ে থাকে কোর’আনে বহু আয়াত আছে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে। এটা একটা বিভ্রান্তি। বস্তুত কোর’আনে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে কোনো আয়াত নেই। কোর’আনে বলা আছে- তুমি অবশ্যই মুমিনদের জন্য মানুষের মধ্যে শত্রুতায় অধিক কঠোর পাবে ইহুদি ও মুশরিকদেরকে। আর মুমিনদের জন্য বন্ধুত্বে তাদেরকে নিকটে পাবে যারা বলে, ‘আমরা নাসারা (খ্রিস্টান)’ (মায়েদা, ৮২)।
নাজ্জাশী ছিলেন খ্রিস্টান শাসক। তিনি রসুলাল্লাহকে সত্য প্রচারে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেছেন বোলে কোনো সহিহ হাদিস বা ইতিহাস পাওয়া যায় না। কিন্তু রসুলাল্লাহ তাঁকে একজন মুসলিমের সম্মানে সম্মানিত করেছেন। তাঁকে মুসলিমদের ভাই হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
সুরা আল ইমরানের ১৯৯ নং আয়াত নাজেল হলো। এ আয়াতে আল্লাহ বললেন- ‘আর আহলে কিতাবদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও রয়েছে, যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং যা কিছু তোমার উপর অবতীর্ণ হয় আর যা কিছু তাদের উপর অবতীর্ণ হোয়েছে সেগুলোর উপর, আল্লাহর সামনে বিনয়াবনত থাকে এবং আল্লাহর আয়াতসমূহকে স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে সওদা করে না, তারাই হলো সে লোক যাদের জন্য পারিশ্রমিক রয়েছে তাদের পালনকর্তার নিকট। নিশ্চয়ই আল্লাহ যথাশীঘ্র হিসাব চুকিয়ে দেন।’ আহলে কিতাবরাও দীন প্রতিষ্ঠার কাজে সাহায্য করে মুসলিমদের সমান মর্যাদার অধিকারী হোতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই আয়াতটিই।
ঈসা (আ:) সম্পর্কে আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, “দুনিয়ায় এবং আখেরাতে আমি ঈসা ইবনে মারিয়ামের (আ:) সবচেয়ে নিকটতম। সকল নবীরাই ভাই ভাই, কেবল তাদের মা আলাদা। তবে তাদের সবাই একই ধর্মের অনুসারী। (হাদীস- আবু হোরায়রা রা. থেকে বোখারী)। আবার ঈসা (আ:) শেষ নবীকে কতখানি সম্মান করেছেন তা বাইবেলে বর্ণিত আছে। ঈসা (আ:) তাঁর আসহাবদেরকে বোলেছেন, “বিশ্বাস করো আমি তাঁকে দেখেছি এবং তাঁকে সম্মান জানিয়েছি। এভাবে সকল নবী তাঁকে দেখেছেন। তাঁর রূহকে দর্শনের মাধ্যমে নবীগণ নব্যুয়তপ্রাপ্ত হোয়েছেন। আমি যখন তাঁকে দেখলাম আত্মা প্রশান্ত হোয়ে গেল। আমি বোললাম, O Muhammad;, God be with you, and may he make me worthy to untie your shoelace; for obtaining this I shall be a great prophet and holy one of God. হে মোহাম্মদ! আল্লাহ আপনার সহায় হোন। আমাকে তিনি আপনার জুতার ফিতা বাঁধার যোগ্যতা দান করুন। কারণ আমি যদি এই মর্যাদা লাভ কোরি তাহলে আমি একজন বড় নবী হবো এবং আল্লাহর একজন পবিত্র মানুষ হোয়ে যাবো। (The Gospel of Barnabas, Chapter 44)”. এই ছিল একজন নবীর নিকটে অপর একজন নবীর সম্মান, মর্যাদা। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, নবী-রসুল-অবতারগণ একে অপরকে কতখানি সম্মান কোরতেন, ভালোবাসতেন। অথচ তাদেরই অনুসারী দাবি করে আমরা জেহাদ-ক্রুসেড আর ধর্মযুদ্ধের নামে একে অপরের সাথে বংশ পরম্পরায় শত্রুতা করে যাচ্ছি, উপাসনালয় ভাঙছি, মূর্তি ভাঙছি, দাঙ্গা করছি, কতল করছি, রক্তপাত করছি। কী নিষ্ঠুর পরিহাস।
এবার আসা যাক রসুলের আসহাবদের দিকে। আবু বকর (রা:) খেলাফতকালে মুসলিম বাহিনীর আয়ত্বে আসে সিরিয়ার হেমস নগরী। সেখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা নাগরিক সুবিধা ও নিরাপত্তা ভোগের জন্য বাৎসরিক ট্যাকস্ বা জিজিয়া দিতেন। সে সময় রোমান সম্রাট ইয়ারমুকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য কয়েক লাখ সৈন্য সমাবেশ ঘটান। তৎকালীন বিশ্বশক্তি রোমানদের এই বিশাল সৈন্যবাহিনীর মোকাবিলায় বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসলিমদের একত্রিত করা হয়। সে সময় মুসলিম বাহিনী হেমস নগরীর দখল ছেড়ে দেন। নিরাপত্তার ভার ছেড়ে দেয়ায় মুসলিমরা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের দেয়া জিজিয়া ফেরৎ দিয়ে দেন। পরবর্তীতে ইয়ারমুকে বিজয় লাভের পর মুসলিম বাহিনী আবার হেমস নগরী দখলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এবার তাদের কোনো যুদ্ধ করতে হলো না, এবার ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হেমসবাসী জিজিয়ার অর্থ নিয়ে মুসলিমদের স্বাগত জানালো। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, হেমসে বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মের মানুষকে মুসলিমরা কতটুকু শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে পেরেছিল যে তারা যুদ্ধ না করে স্বেচ্ছায় মুসলিমদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিল।
পবিত্র জেরুজালেম শহর মুসলিম বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার পর খলিফা ওমর (রা:) ঘুরে ঘুরে শহরের দর্শনীয় বস্তুগুলি দেখার সময় যখন খ্রিস্টানদের একটি অতি প্রসিদ্ধ গির্জা দেখছিলেন তখন নামাজের সময় হয়ে গেল। তিনি গির্জার বাইরে যেতে চাইলেন। জেরুজালেমের প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ বিশপ সোফ্রোনিয়াস ওমরকে (রা:) অনুরোধ কোরলেন ঐ গির্জার মধ্যেই তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নামাজ পড়তে। ভদ্রভাবে ঐ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ওমর (রা:) গির্জার বাইরে নামাজ পড়লেন। কারণ হিসাবে বললেন – আমি যদি ঐ গির্জার মধ্যে নামাজ পড়তাম তবে ভবিষ্যতে মুসলিমরা সম্ভবতঃ একে মসজিদে পরিণত করে ফেলতো।
উম্মতে মোহাম্মদী যতো যুদ্ধ করেছিলো সেগুলির উদ্দেশ্য ছিলো সত্য ও ন্যায় ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। যেটা মাহনবী এবং পরবর্তীতে তাঁর খলিফাগণ রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসাবে পরিচালিত করেছেন। কিন্তু তারা একটি মানুষকেও তার ধর্ম ত্যাগ করে এই দীন গ্রহণে বাধ্য করেন নি। শুধু তাই নয়, তারা যেখানেই শাসন করেছেন করেছেন সেখানেই অন্য ধর্মের চার্চ, সিনাগগ, মন্দির ও প্যাগোডা রক্ষার দায়িত্ব তো নিয়েছেনই তার উপর ঐ সব ধর্মের লোকজনের ধর্ম পালনে কেউ যেন কোন অসুবিধা না কোরতে পারে সে দায়িত্বও তারা নিয়েছেন।
আরেকটি একটি উদাহরণ দিই। মিসর বিজয়ের পর আলেকজান্দ্রিয়ায় এক রাত্রে কেউ যিশু খ্রিস্টের নির্মিত প্রতিমূর্তির নাক ভেঙ্গে দিল। এতে খ্রিস্টানরা উত্তেজিত হয়ে উঠল। এ সময় সেখানে শাসক ছিলেন আমর ইবনুল আস (রা:)। তিনি সব শুনে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ প্রতিমূর্তিটি সম্পূর্ণ নতুন করে তৈরি করে দিতে চাইলেন। কিন্তু তারা বলল, “আমরা চাই আপনাদের নবী মোহাম্মদের (দ:) প্রতিমূর্তি তৈরি করে ঠিক অমনিভাবে তাঁর নাক ভেঙে দিব।” এ কথা শুনে আমর (রা:) রাগ সম্বরণ করে বোললেন, “আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন প্রস্তাবে আমি রাজি আছি।” পরদিন খ্রিস্টান ও মুসলিমদের ডেকে আমর (রা:) সবার সামনে বিশপকে বোললেন, “এদেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ আপনাদের ধর্মের হোয়েছে, তাতে আমার শাসন দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারি গ্রহণ করুন এবং আমার নাক কেটে দিন।” এই কথা শুনে খ্রিস্টানরা পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, চারদিকে থমথমে ভাব। হঠাৎ সেই নীরবতা ভঙ্গ করে একজন মুসলিম সৈন্য চিৎকার করে বললো, “থামুন! আমি ঐ মূর্তির নাক ভেঙ্গেছি। অতএব আমার নাক কাটুন।” বিজিতদের উপরে বিজয়ীদের এই উদারতায় ও ন্যায়বিচারে মুগ্ধ হোয়ে সেদিন শত শত খ্রিস্টান ইসলাম কবুল করেছিলেন। এই হলো প্রকৃত ইসলামের নমুনা।
বর্তমানে প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন স্রষ্টা কেবল আমাদের সাথেই আছেন। আমরা স্রষ্টার প্রিয় জাতি, অন্যরা অবাধ্য, তারা নরকে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বর্তমানে আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি তাতে স্রষ্টা আমাদের কারও প্রতিই খুশি নন। মানুষে মানুষে বিভেদের অভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে এবং মানবতাকে উপেক্ষা করে নিত্য অশান্তির সৃষ্টি করে আমরা নিজেদের হাতেই আল্লাহর অভিশাপ ক্রয় করে নিয়েছি। এখন প্রতিনিয়ত তার ফল ভোগ কোরছি। তাই আসুন সকল প্রকার অনৈক্যকে পেছনে ফেলে নবী-রসুল-অবতারদের প্রকৃত শিক্ষা মোতাবেক ঐক্যবদ্ধ হোই। ধর্মের আসল শিক্ষা ধারণ করে ভেতরের দেয়াল চুরমান না করা পর্যন্ত এই বিভাজন চলতেই থাকবে। কিন্তু সময় বেশি নেই। এখনই এই সাম্প্রদায়িকাতার ভেদাভেদ থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারলে শেষে আক্ষেপটুকু করারও অবকাশ থাকবেন না। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।।

Comments (0)
Add Comment