স্বদেশির কাঁধে বিদেশি প্রেতাত্মা

খন্দকার ইয়াসীন পাভেল

সেকেন্ড হোম প্রকল্প বাংলাদেশের বহুল আলোচিত একটি বিষয়। বাংলাদেশে বসবাস করতে করতে যারা বিরক্ত হয়ে গেছেন বা দেশটা যাদের কাছে একঘেঁয়ে লাগে বা যে কোনো কারণে দেশে থাকাকে নিরাপদ মনে করেন না তারা বিদেশে সেকেন্ড হোম কেনেন। মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশগুলোর কিছু এলাকা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশিদের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। এই সেকেন্ড হোমওয়ালাদের মধ্যে কেউ রাজনীতিক, কেউ শিল্পপতি, কেউ সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা। গত ২৫ মার্চ একটি দৈনিকে খবর বের হয়েছে , বিদেশে সেকেন্ড হোম নিয়েছেন এমন ৬৪৮ ব্যক্তির বিষয়ে তদন্ত করছে বাংলাদেশের দুই সংস্থা। ইতিমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পত্রিকাটির রিপোর্টে আরও বলা হয়, এ তালিকাভুক্তদের মধ্যে রাজনীতিক আছেন ৩৮৩ জন এবং সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী আর ব্যবসায়ী ২৬৫ জন। তালিকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের সংখ্যাও আলাদা করা হয়েছে। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীর মধ্যে ২৮৭ এবং বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্ট ৯৬ জনের বাংলাদেশের বাইরে সেকেন্ড হোম রয়েছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
সেকেন্ড হোম প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে মালয়েশিয়া। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশিরা  মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কর্মসূচির আওতায় বিনিয়োগ করা শুরু করেছেন।  সেখানকার সরকারের দেওয়া তথ্যানুসারে, গত এক যুগে সেখানে সেকেন্ড হোম সুবিধা নিয়েছেন ৩ হাজার ৫ জন বাংলাদেশি। তাদের প্রত্যেককে মালয়েশিয়ায় ১০ বছরের জন্য নন-মালয়েশিয়ান হিসেবে ভিসা নিতে কমপক্ষে প্রায় ১ কোটি টাকা করে মালয়েশিয়ার ব্যাংকে জমা রাখা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় করতে হয়েছে। সে হিসেবে শুধু মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৫ কোটি টাকা। এটি বৈধ পথে সেকেন্ড হোম বেছে নেওয়াদের তালিকা। কিন্তু অবৈধ পথে,  হুন্ডি ইত্যাদির মাধ্যমে যাঁরা সেখানে বা অন্যত্র সেকেন্ড হোম খুঁজে নিয়েছেন, তাঁদের সংখ্যা হয়তো জানা যাবে না।
মালয়েশিয়া পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ওয়েব সাইট সূত্রে জানা যায়, ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের আমলে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পের জন্য আবেদন পড়েছিল ১ হাজার ৪২৯ টি। ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণাকারী সেনাসমর্থিত জরুরি সরকার। সে সময়েও মালয়েশিয়ায় নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন ২১৭ জন। তাদের পর ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকার। এই সময়ে সেকেন্ড হোম প্রকল্পের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ১ হাজার ৩৫৯টি। অর্থাৎ দেখা সব সরকারের আমলেই বিদেশে সেকেন্ড হোম ক্রয়ের তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কেন এই তৎপরতা? দুদক বলছে, এসকল সেকেন্ড হোম কিনতে বিদেশে যে পরিমাণ অর্থ প্রেরণ করতে হয়েছে তার কোনো বৈধ উপায় নেই। অর্থাৎ কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাঠানো হচ্ছে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে।
ইংরেজরা আমাদের ভূ-খণ্ড দখল করে সর্বাত্মকভাবে এখানকার সম্পদ তাদের দেশে পাচার করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এখানকার সোনালি ফসল তারা নৌকাভর্তি করে নিয়ে যেত, আর এখানকার মানুষ থাকতো অনাহারে-অর্ধাহারে। তারা একটি দিনও এই ভূ-খণ্ডকে আপন করে নেয় নি। তারপর যখন পাকিস্তানি আমল শুরু হলো, শোষণের মাত্রা নতুন রূপ নিল। তারাও এই বাংলাকে যারপরনাই শোষণ করতে করতে এ দেশে মানুষের স্বার্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করল। অতঃপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে এদেশ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করার পর বাঙালি জাতি ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বুক বেধেঁছিল। কিন্তু বিধিবাম! ইংরেজ এবং পাকিস্তানিরা এ দেশ থেকে চলে গেলেও তাদের প্রেতাত্মাগুলো আজও ভর করে আছে এই দেশের অনেক রাজনৈতিক হর্তাকর্তা, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, গবেষক, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের উপর। তারা একটু অর্থ-কড়ি উপার্জন করে একটু জাতে উঠতে পারলেই দেশের সম্পদ পাচার করতে মরিয়া হয়ে উঠে। এরা স্বদেশ কি জিনিস বোঝে না। ইংরেজদের সাথে এ দেশের ভূ-খণ্ডের ব্যবসায়িক সম্পর্কই মুখ্য ছিল, আত্মার কোনো স্থান ছিল না, বাংলার মাটির প্রতি তীল পরিমাণ ভালোবাসা ছিল না, এদেরও তাই। এই শ্রেণির মানুষগুলি নিজেরা রাজনীতির মঞ্চে, টিভি টকশোতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে দেশপ্রেমের বুলি আউড়ালেও, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে রাজনীতি, দলাদলি, মারা-মারি, ছুরি চালানো, বোমা ফাটানোর মত কাজকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বৈধতা দান করলেও তাদের নিজেদের ছেলে-মেয়েদেরকে ঐসব দেশীয় স্কুল-কলেজগুলোতে পড়া-লেখা করান না, ছাত্র-রাজনীতিতেও জড়িত হতে দেন না। তারা এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থ কামান কিন্তু নিজেদের ছেলে-মেয়েদেরকে বেশি টাকা-পয়সা ব্যয় করে পড়া-লেখা করান বিদেশের স্কুল-কলেজগুলোতে। ইংরেজরা যেমন তাদের শাসনকালে নিজেদের দেশ থেকে বেড়িয়ে আসতেন তেমনি আজকের সরকারি কর্মকর্তারা কিছুদিন পর পর সম্ভব হলে সরকারের কোষাগার খালি কোরে বিদেশভ্রমণ করে আসেন। এদেশীয় শিল্পকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্রের চেয়ে বিদেশি ভাষা, শিল্পকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে বেশি ভালবাসেন। এদের আড্ডায়, কথা-বার্তায়, উদাহরণে থাকে বিদেশি মতবাদ, চালচলনে বিদেশি হাবভাব। পারে তো রাতারাতি দেশটাকে বিদেশি সংস্কৃতি ও সভ্যতার চাদরে আচ্ছাদিত করে ফেলে। আজকে আমাদের সমাজের যারা উচ্চপর্যায়ের বাসিন্দা, তারা আমলাই হোন আর রাজনীতিকই হোন, তাদের সাথে লুটেরা বর্গি, ঠগি, ইংরেজ, ফিরিঙ্গি ও পাকিস্তানিদের চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে কোন পার্থক্যই নেই, পার্থক্য যদি থেকে থাকে গায়ের রঙের, ভাষার। এদের উপস্থিতি সরকারি বা সরকার বিরোধী সব দলেই আছে। প্রকৃতপক্ষে এরা কোনো দলেরই নয়, যেখানে সুবিধা পাবে এরা সেখানেই যাবে। তাই দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এদের সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে। এ জাতি বহুবার বহুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সহজ-সরল জীবনাচারে অভ্যস্ত বাঙালির সরলতার সুযোগ নিয়ে জাতির বুকে বারবার ছুরি চালিয়েছে বিদেশি শোষকশ্রেণি। এখন তাদের প্রেতাত্মাগুলোও যাতে জাতিকে ছুরিকাঘাত করতে না পারে সে জন্য দেশপ্রেমিক বাঙালিকে সজাগ ও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে।

Comments (0)
Add Comment