স্বার্থপর মুত্তাকির পরিণতি -রিয়াদুল হাসান


বর্তমানে ধর্মহীন পশ্চিমা বস্তুবাদী দর্শনের প্রভাবে মানবজাতি এতটাই স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে যে তাদের কাছে উন্নত জীবনযাপন মানেই হয়ে দাঁড়িয়েছে আরাম আয়েশ, ভোগবিলাস, বস্তুগত সমৃদ্ধি। যে এটা হাসিল করতে পারে তাকে বলা হয়ে থাকে যে, সে বড় মানুষ হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জীবনে সফল হয়েছে অর্থাৎ তার জীবন স্বার্থক। কিন্তু এটা তো স্বার্থকতা নয়। মানদ- পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষ বুঝতেই পারছে না যে তাদের মানবজীবনের স্বার্থকতা হলো নিজের জীবন এবং সম্পাদকে অন্য মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা। মো’মেনের সংজ্ঞার মধ্যেই এই বিষয়টিই আছে যে জীবন এবং সম্পদ দান করে দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করা (সুরা হুজরাত ১৫)। আবার সুরা তওবার ১১১ নং আয়াতে এই কথাটাই লেখা আছে যে আল্লাহ মো’মেনদের জান মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। আল্লাহ জান মাল নিয়ে কী করবেন?
আসলে কিছুই করবেন না, তিনি চান সেই জান ও মাল আল্লাহর অভিপ্রায় মোতাবেক মানুষের কল্যাণে ব্যয়িত হোক। সুতরাং পরিষ্কার হয়ে গেল মো’মেন হওয়ার শর্ত হলো আপনাকে আগে জীবন-সম্পদ কোরবান করতে হবে। আর নামাজ রোজা হজ্জ যাকাত যাবতীয় আমল সব মো’মেনদের জন্য। মো’মেন না হলে সব আমলই অর্থহীন। আল্লাহ বলছেন, ‘আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদের স্বীয় কর্ম ও শ্রমে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের কথা জানিয়ে দেব?- পার্থিব জগতে কৃত সমস্ত আমলই যাদের প-শ্রম হয়েছে। অথচ তাদের ধারণা, খুব ভালো কাজই করে যাচ্ছে তারা।’ (কাহাফ : ১০৩-১০৪)
তাদের এই আমল বিনষ্ট হওয়ার কারণ তাদের তাকওয়া আছে কিন্তু তারা হেদায়াতে নেই আর হেদায়াহ বিহীন ব্যক্তিগত তাকওয়ার মূল্য নেই। অন্যের জন্য জীবন সম্পদ কোরবান না করলে ব্যক্তির তাকওয়ার কোন মূল্য নেই। আরও পরিষ্কার করে বলা যায় ব্যক্তিগতভাবে আপনি যত ভালো মানুষই হওয়া চেষ্টা করুন না কেন, যদি ভাবেন যে আমি একা ভালো মানুষ হয়ে থাকব, সমাজ, দেশ, মানবজাতির কী হয় না হয় সেটা দেখার দায়িত্ব আমার না, আমি চোখ নাক কান বন্ধ করে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লাম, কারো ক্ষতি করলাম না মিথ্যা কথা বললাম না, কারো হক নষ্ট করলাম না, টাখনুর উপর পায়জামা পরলাম, দাড়ি রাখলাম আমি ব্যক্তিগতভাবে ভালো মানুষ হলাম কিন্তু সমাজের অশান্তি দূর করার কোনো প্রচেষ্টা করলাম না, এটা চরম স্বার্থপরতা। এই স্বার্থপরতা আত্মকেন্দ্রিক ভালো মানুষের কোন জান্নাত নাই। আল্লাহ বলছেন, এবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে অপর কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে। যারা নিজেরাও কার্পণ্য করে এবং অন্যকেও কৃপণতা শিক্ষা দেয় আর গোপন করে সে সব বিষয় যা আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে দান করেছেন স্বীয় অনুগ্রহে। বস্তুত তৈরি করে রেখেছি কাফেরদের জন্য অপমানজনক আযাব (সুরা নিসা: ৩৭)।
সুতরাং কৃপণতা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি মো’মেন হওয়ার শর্তের বিপরীত এবং কাফেরের বৈশিষ্ট্য। বর্তমানের পশ্চিমা বস্তুবাদী শিক্ষার প্রভাবে উপরোক্ত আয়াতের প্রতিটি কথা মানবচরিত্র বাস্তবায়িত করে। যেমন এই শিক্ষা ও স¤পদ মানুষকে গর্বিত ও দাম্ভিক করে তোলে, বিনয়ী করে না। পিতা-মাতা, আত্মীয় পরিজন, প্রার্থী, এতিম, অধীন ব্যক্তিদের প্রতি সৎ ও সদয় আচরণে প্রবৃত্ত করে না, কৃপণতা শিক্ষা দেয়, নিজের সম্পদকে গোপন করা শিক্ষা দেয়। আল্লাহ এই ব্যক্তিকে কাফের আখ্যা দিয়ে অপমানজনক জাহান্নামের শাস্তির সতর্কবার্তা জানিয়েছেন।
ব্যক্তি ভালোমানুষি দিয়ে কেউ জান্নাতে যাবে না, কারণ জান্নাত সামষ্টিক। ইসলাম মানে শান্তি, তাই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করলে জান্নাতে ঠাঁই পাওয়া যাবে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা একটি সামষ্টিক কাজ সুতরাং জান্নাতও একটি সামষ্টিক কাজের ফল। এর অর্থ কি আপনি ভালো মানুষ হবেন না? সত্যবাদী হবেন না? হ্যাঁ, ভালো হবেন সমাজকে ভালো করার জন্য। অন্য মানুষকে ভালো করার জন্য আপনাকে ভালো হতেই হবে। ব্যক্তি তাকওয়ার কোন মূল্য নেই। সামষ্টিক তাকওয়াই হলো জান্নাতে যাবার পূর্বশর্ত। যেমন আপনার উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য আপনাকে সুশৃঙ্খল হতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, আত্মিক দিক দিয়ে আপনাকে অনেক দৃঢ় হতে হবে, অনেক দানশীল হতে হবে। আপনাকে সালাহ করতে হবে, সওম করতে হবে এইজন্য যেন আপনি শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ আপনি দুনিয়ার সমাজের মানুষের ভালো করার জন্য আমল করবেন। সেটা আমল হবে। আর দুনিয়ার মানুষ ধ্বংস হয়ে যাক তাতে কিছু যায় আসে না, আমি ভালো হলেই চলবে, এ জাতীয় স্বার্থান্ধ দৃষ্টিভঙ্গির লোক কোনদিন জান্নাতে যেতে পারবে না। বিডিপত্র/আমিরুল

Comments (0)
Add Comment