ব্রাহ্মণবাড়িয়া: পুলিশ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে ছাত্র নিহতের জের ধরে মঙ্গলবার তাণ্ডব চলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। হামলা, পাল্টাহামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো শহর।
এ তাণ্ডবের আগুনের ধ্বংস হয়ে গেছে দেশের ঐহিত্যের বিশাল এক সম্পদ। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে শাস্ত্রীয় সংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতির বিশাল অংশ।
উপমহাদেশের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পৈত্রিক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে কুমারশীল রোডে। ১৯৭৩ সালে বাড়িটিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি সংগীত অ্যাকাডেমি ও জাদুঘর।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তার দীর্ঘ জীবনে দেশ বিদেশে নানা জায়গায় সংগীত পরিবেশন করেছেন। সেসব স্মৃতির ছবিগুলো স্থান পেয়েছিল জাদুঘরের গ্যালারিতে। মঙ্গলবারের তাণ্ডবের সময় এই জাদুঘরেই চালানো হয় হামলা। হামলায় লণ্ডভণ্ড হয়ে জাদুঘরের ভেতরে ও বাইরে। নিশ্চিহ্ন করা হয় গ্যালারি। ধ্বংস হয়ে যায় সম্পূর্ণ জাদুঘরটি।
শুধু তাই নয়, হামলার পাশাপাশি আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহারের বহু জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ভাঙচুর ছাড়াও লুটপাট করা হয়। তাণ্ডব শেষে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা গেছে শুধু তার ব্যবহারের একজোড়া তবলা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার সকালে মাদরাসা ছাত্র হাফেজ মাসুদুর রহমানের (২০) মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে উন্মত্ত হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। এসময় তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
শত শত ছাত্র নেমে আসে রাস্তায়। পড়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে। বিভিন্ন যানবাহন, রেলওয়ে স্টেশন, দোকানপাট, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, জেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিস কোনোটিই বাদ পড়ে না বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাত থেকে।
এক পর্যায়ে ছাত্ররা সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সংগীতাঙ্গণ, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরের ৫টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে হামলা চালায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের হালদারপাড়া এলাকায় অবস্থিত শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর। আর জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমি ভবনটিও এখানেই অবস্থিত। পাশে ছিল আরো কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তারা জেলা শহরে অবস্থিত এসব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। লুঠপাট করা হয় কম্পিউটারসহ নানা জিনিসপত্র। তারা এসব সাংস্কৃতিক সংগঠন কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগও করে। এতে পুরো শহর পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।
গত সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ মার্কেটের একটি দোকানের সামনে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কান্দিপাড়া জামেয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসা ছাত্রদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বিরোধ হয়। এরপর তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে পুলিশ। শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষ। আর এসময় গুরুতর আহত হয় মাদরাসা ছাত্র হাফেজ মাসুদুর রহমান।
পরদিন মঙ্গলবার হাসপাতালে মৃত্যু হয় আহত ছাত্রের। সকালে এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে শুরু হয় ব্যাপক সহিংসতা। দিনভর সংঘর্ষের পরে বিকেলে হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে ফেরার পথে আবারো সহিংস হয়ে ওঠে ছাত্ররা। আরেক দফা তাণ্ডব চলে শহরে।
তবে সহিংসতা আর তাণ্ডবের আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শাস্ত্রীয় সংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিচিহ্ন।