দায়মোচন নয়, দায়িত্ব নিয়ে সন্ত্রাস প্রতিহত করুন
মোহাম্মদ আসাদ আলী:
সহিংসতা-সন্ত্রাসের কবলে পড়েছে দেশ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই আক্রান্ত হচ্ছেন সন্ত্রাসীদের দ্বারা। গত দুই মাসের সহিংসতায় অনেক মায়ের কোল খালি হয়েছে, অনেক সন্তান এতিম হয়েছে, অনেক পরিবার হয়েছে সর্বস্বান্ত। পুড়ে মরার মিছিল থেকে বাদ পড়ে নি অন্তস্বত্ত্বা স্ত্রীলোকও। একেকটি বাসে আগুন মানেই যেন বার্ন ইউনিটের বীভৎসতা, আর্তনাদ, চামড়া পোড়ার গন্ধ, স্বজনের আর্তি, দেশ ও দশের আতঙ্ক-উত্তেজনা। পুলিশ-প্রশাসনের নিরাপত্তা বেষ্টনী কোনো কাজে আসে নি। এখনও ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রত্যাশিত এই জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ড। এ সহিংসতার কুশীলব কারা? দায়ভার কেউ নিচ্ছে না। কিন্তু দায়ভার কেউ না নিলেও সহিংসতা তো হচ্ছে, কেউ না কেউ তো করছে। তারা কারা?
সরকারের পক্ষ থেকে বক্তব্য-বিবৃতিতে বারবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে দায়ী করা হচ্ছে। এর পেছনে শক্ত যুক্তিও তারা দেখাচ্ছেন। সেটা হলো- এই সহিংসতাগুলো ঘটছে বিএনপির অবরোধ-হরতালের মধ্যেই। তাছাড়া ককটেল-পেট্রলবোমাসহ অনেক বিএনপি-জামাতকর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কাজেই সরকার বিএনপিকে দায়ী করছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে তারা সহিংসতা-সন্ত্রাস, মানুষ পোড়ানোর সাথে জড়িত নয়। তারা কখনও বলছে সরকারই বিএনপির উপর দায় চাপানোর জন্য এসব করছে, আবার কখনও বলছে এসব তৃতীয় কোনো শক্তির কাজ। গত মাসের ১৪ তারিখে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী শাজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন- চলমান সহিংসতার জন্য বিএনপি দায়ী নয়। সুযোগ সন্ধানী তৃতীয় কোনো শক্তি এসব করতে পারে। এমন কথা আরও অনেকে বলছেন। অর্থাৎ আমাদের রাজনীতিকদের ভাষ্যমতে এ সহিংসতার জন্য সরকার ও বিরোধীপক্ষ কেউই দায়ী নয়। এটা করছে অন্য কেউ, অন্য কোনো শক্তি। যদি প্রশ্ন করা হয় কোন স্বার্থে অন্য কোনো শক্তি এসব করছে- উত্তর মিলবে না। তবুও না হয় ধরেই নিলাম তৃতীয় কোনো শক্তি করছে। এই তৃতীয় শক্তি কিন্তু সন্ত্রাসী শক্তি, সন্ত্রাস করেই তারা নিজেদের অস্তিত্বের আবহ তৈরি করেছে। সারা দেশ একদিকে আর কথিত এই তৃতীয় শক্তি একদিকে, পরস্পরবিরোধী সংঘর্ষে লিপ্ত। এখন রাজনীতিকদের কাছে প্রশ্ন হলো- আপনারা সরকার ও বিরোধীপক্ষ কেউই যখন সে সন্ত্রাসের সাথে জড়িত নন, সকলেই যখন ধোয়া তুলশী পাতা তাহলে সে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে সোচ্চার হতে বাধা কোথায়? র্যাব-পুলিশ-বিজিবি, লক্ষ লক্ষ দলীয় কর্মী-সমর্থক সকলেই কি সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায় হয়ে গেলেন? গত দুই মাস যাবৎ দেশে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে, রাজনীতিক দলগুলোর বাইরে ভিন্ন কোনো অপশক্তি যদি এ কাজে লিপ্ত থাকে তাহলে এতদিনেও কেন আপনারা তার কোনো মাথা-মুণ্ডু আবিষ্কার করতে পারলেন না? সাধারণ নিরীহ-নিরপরাধ, রাজনীতি-জ্ঞানশূন্য মানুষ আগুনে পুড়ে কয়লা হচ্ছে, ওই মানুষগুলোকে রক্ষা করার দায়িত্ব কার? অবশ্যই আপানাদের। কারণ আপনারাই পাঁচ বছর পর পর জনতার কাছে করজোড়ে ভোট ভিক্ষা করেন, আশ্বাসের ফাঁকা বাণী শুনিয়ে শান্তিময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান। এটাই কি সেই শান্তির নমুনা? দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে রাজনীতিকরা আরও বড় মনের পরিচয় দিতে পারতেন। জনগণ সংগঠিত নয়, তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক ধাপ এগোলে দুই ধাপ পেছনে ফেরে। প্রাণের মায়া, সংসারের মায়া তাদেরকে সন্ত্রাস-সহিংসতার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা থেকে বিরত রাখছে। কিন্তু আপনারা তো সংগঠিত। প্রতিটি জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম-মহল্লায় আপনাদের কমিটি আছে, লোকবলের অভাব নেই। সেই সংগঠিত শক্তি নিয়ে আপনারা পারতেন না সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে তো দেশের জন্য নিজের জীবনকেও উৎসর্গ করে দেওয়া। তেমন কিছু তো আমরা দেখলাম না। আবার যারা জাতীয়তাবাদের ছাতা ধরে আছেন তারাই বা কোন আশায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হাত গুটিয়ে রয়েছেন? জনগণের জন্যই যদি আপনাদের আন্দোলন হয় তাহলে এ বোধ আপনাদের নিশ্চয়ই আছে যে, এখন সরকার পতনের চেয়ে সন্ত্রাস নির্মূল বেশি প্রয়োজনীয়, বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই দেশের মানুষ, এই দেশের সম্পদ রাজনীতিকদের জন্য আমানত। এই আমানতের হানি ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। এ অবস্থায় যদি রাজনীতিকরা ঘর ছেড়ে মানুষের কাতারে এসে না দাঁড়ান তাহলে তারা মানুষের বিশ্বাস হারাবেন। তাই সরকার ও বিরোধীপক্ষ উভয়ের কাছেই আহ্বান- আর দায়মোচন নয়, এবার দায়িত্ব নিয়ে সন্ত্রাসকে প্রতিরোধ করুন।