রৌমারী উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটে দুর্ভোগ রোগীদের
শাহাদত হোসেন, রৌমারী: কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা হাসপাতালটিতে প্রায় দুই মাস ধরে চিকিৎসকশূন্য হওয়ার উপক্রম। দীর্ঘ এ সময়ে কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন চিকিৎসকরা। অসংখ্য রোগী হাসপাতালে এসে বিনা চিকিৎসায় ফেরত যাচ্ছে। সরেজমিন হাসপাতালে গিয়ে এ তথ্য জানা যায়।
হাসপাতালের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১ মার্চ থেকে হাসপাতালে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কেউই উপস্থিত ছিলেন না। এর মধ্যে হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ১৬ মার্চ এবং মেডিক্যাল অফিসার সোনিয়া লায়লা ২২ মার্চ বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। বদলি হওয়ার আগে ওই মাসে এক দিনও তাঁরা কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। এ সময়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহফুজার রহমান সরকার কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি জরুরী কাজে সিভিল সার্জনের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছেন বলে জানান। এ ছাড়া গত ৫ এপ্রিল মেডিক্যাল অফিসার এহসানুল কবীর যোগদান করেই ঢাকায় চলে যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে ১১ জন চিকিৎসক পদের বিপরীতে বর্তমানে আছেন মাত্র দুজন। বর্তমানে কর্মরত থাকলেও উপস্থিত নেই স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহফুজার রহমান সরকার ও মেডিক্যাল অফিসার এহসানুল কবীর। উপসহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার চারজন থাকলেও বাস্তবে পাওয়া গেছে দুজনকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন, ওই দুই ডাক্তার ঢাকায় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়মিত রোগী দেখেন। সরকারি বেতন নেন রৌমারী থেকে আর ব্যবসা করেন ঢাকায়। হাসপাতালের হিসাব সহকারী বলেন, ‘অফিসিয়াল কাজ ও বিল-বেতনের জন্য স্বাক্ষর নিতে আমাকে স্যারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। তা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
শনিবার সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল বহির্বিভাগে অসংখ্য রোগীর ভিড়। রোগীদের চাপ সামলাচ্ছেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার অলোক কুমার ও জহুরুল ইসলাম। দুজন বলেন, ‘স্যাররা তো নেই অনেক দিন। এত রোগীর চাপ! আমাদের হিমশিম খেতে হয়। বহির্বিভাগেই শতশত রোগী আসে। এমনকি জরুরি ও অভ্যন্তরীণ বিভাগে তো রোগী আছেই। সব মিলে কঠিন চাপের মধ্যে রয়েছি আমরা।
উপজেলার তেকানি ঝগড়ার চর গ্রামের ইঞ্জিরা খাতুন পেটে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আছেন। রোগীর স্বজন মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সকালে জরুরি বিভাগ থেকে হাসপাতালে ভর্তি করে স্যালাইন লাগিয়ে দেয়। দুপুর পার হয়ে গেল কোন ডাক্তার কাছে আসে নাই। নার্স বলে বড় ডাক্তার নাই। বন্দবেড় গ্রামের বাতাসি বেগম দুই দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাঁর বোন আকাশি বেগম বলেন, ‘মাইনসে কয় এই হাসপাতালে ডাক্তার থাকে না। দুই দিনে রোগীর কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমগর ট্যাহাপয়সাও নাই যে বাইরে নিয়া যামু।’
হাসপাতালের এক কর্মচারী বলেন, ‘এ হাসপাতালের ডাক্তাররা দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকে। কেউ কিছুই কয় না।’ হাসপাতাল গেটের এক চা দোকানি বলেন, ‘টিবিতে খবর দেহি ডাক্তাররা হাসপাতালে না থাকলে তাগরে বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেয়। আমগর হাসপাতালের ডাক্তাররা তো থাকেই না। তাগরে বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখলাম না।’
কর্মস্থলে অনুপস্থিত প্রসঙ্গে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, ‘আমি সিভিল সার্জনের কাছ থেকে এক মাসের ছুটি নিয়েছি। তা ছাড়া প্রায় দিনই আমাকে অফিসিয়াল নানা মিটিংয়ে যেতে হয়। হাসপাতালে বসে রোগী দেখার সময় আমার নেই। হাসপাতালে ডাক্তার সংকটের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। ডাক্তার পোস্টিং দিলেও তাঁরা এখানে থাকতে চান না। তদবির করে বদলি নিয়ে চলে যান।’ যোগদানের পর থেকেই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে জানতে মেডিক্যাল অফিসার এহসানুল কবীরের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শংকর কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘দুই মাস ধরে হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকার বিষয়টি আমাকে অনেকেই জানিয়েছে। বিষয়টি সিভিল সার্জনকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলার মাসিক সভায়ও এ নিয়ে আলোচনা করা হবে।’
এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বঙ্গবাসী বলেন, চিকিৎসক না থাকার বিষটি অনেকে কাছ থেকে শুনেছি, আগামি মিসিংএ বিষয়টি আলোচনা করা হবে।
এছাড়াও কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমি তো জানি রৌমারীতে দুজন চিকিৎসক রয়েছেন। কর্মস্থলে তাঁদের না থাকার বিষয়টি আমাকে কেউ জানায়নি। আর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহফুজার রহমান সরকার আমার কাছ থেকে এক মাসের ছুটি নেননি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।