২০০৯-২৪: উচ্চ শিক্ষাকে নিচে নামিয়েছেন আ.লীগের যেসব নেতারা
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। দেশে বিগত কয়েক দশকে উচ্চ শিক্ষায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত দেড় দশকে। দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬৩। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৩টি। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১০টি।
অভিযোগ আছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য-রেজিস্ট্রারসহ উচ্চ পর্যায়ের নিয়োগগুলোর ক্ষেত্রে একাডেমিক যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যই গুরুত্ব পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারকদের খুশি করে এসব পদ বাগানোরও অভিযোগ আছে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেও উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম থেকে শুরু করে অবকাঠামো দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। আবার শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম নিয়েও রয়েছে বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। শিক্ষাবিদরা বলছেন, গত দেড় দশকে দেশে উচ্চ শিক্ষার মান না বেড়ে উল্টো অবনমন হয়েছে। শিক্ষার মানহীনতার পাশাপাশি হানাহানি-কোন্দল আর দুর্নীতিতে কলুষিত হয়েছে উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম। এক্ষেত্রে প্রধানতম ভূমিকা রেখেছিলেন দেশের শিক্ষা খাতের নীতিনির্ধারক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শিক্ষকরা।
দেশে উচ্চ শিক্ষা খাতের বর্তমান দৈন্যদশার পেছনে সবচেয়ে দায়ীদের অন্যতম মনে করা হয় নুরুল ইসলাম নাহিদকে। নবম ও দশম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন তিনি। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তার মেয়াদকালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়োগে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ব্যাপকভাবে বাড়ে বলে অভিযোগ আছে। এমনকি বেশকিছু নিয়োগে সরাসরি মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের মধ্যে একটি ছিল সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার হিসেবে বদরুল ইসলাম শোয়েবের নিয়োগ।
নুরুল ইসলাম নাহিদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শোয়েব ২০১০ সালের শেষদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পান। এরপর মাত্র ২ বছর ১১ মাসের মাথায় তাকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। যদিও ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিয়োগবিধি অনুযায়ী রেজিস্ট্রার হতে ন্যূনতম পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল। তবে বদরুল ইসলাম শোয়েবকে নিয়োগের আগে নীতিমালা সংশোধন করে অভিজ্ঞতা পাঁচ বছরের পরিবর্তে চার বছর এবং অভ্যন্তরীণ প্রার্থীর ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের বিধান রাখা হয়।
শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নুরুল ইসলাম নাহিদের মেয়াদকালে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসও নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নফাঁস দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি করে। তাদের মধ্যে ২০১৪ সালে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে অন্তত ৪০ জনকে আটক করা হয় এবং ২০১৮ সালে ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেয়া হয়।
অভিযোগ আছে, তার মেয়াদকালে নিয়োগ, বদলিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদনের ক্ষেত্রে ঘুস ও অবৈধ আর্থিক লেনদেন হতো। ২০১৮ সালে ঘুস ও অবৈধ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে নুরুল ইসলাম নাহিদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মো. মোতালেব হোসেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে কর্মরত উচ্চমান সহকারী নাসিরউদ্দিনকে গ্রেফতারও করা হয়। এছাড়া ২০১৭ সালে শিক্ষা ভবনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) সম্মেলন কক্ষে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা ঘুস খান, কিন্তু সহনীয় মাত্রায় খান।’ এ ঘটনা তখন দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করেছিল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নুরুল ইসলাম নাহিদের উত্তরসূরি ডা. দীপু মনির বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করলে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ডা. দীপু মনি। নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অনিয়ম অব্যাহত ছিল দীপু মনির মেয়াদকালেও। এর সঙ্গে তার আমলে যুক্ত হয় উপাচার্য নিয়োগে ঘুস গ্রহণের অভিযোগ। অভিযোগ আছে দীপু মনির ভাই জেআর ওয়াদুদ টিপুর মাধ্যমে অধ্যক্ষ পদের জন্য ৫০ লাখ টাকা এবং ভিসি পদের জন্য ২ কোটি টাকা করে নেয়া হতো। এমনকি শিক্ষা প্রশাসনের অন্যান্য পদের জন্যও বিভিন্ন পরিমাণের ঘুস গ্রহণ করা হতো। এছাড়া, ২০২০ সালে নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে বাড়তি মূল্যে জমি ক্রয় করিয়ে সেই জমি চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অধিগ্রহণের মাধ্যমে ৩৫৯ কোটি টাকা বাড়তি নেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে দীপু মনির বিরুদ্ধে। তবে ওই সময়ে বিষয়টিকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে দাবি করেছিলেন দীপু মনি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদে শিক্ষা উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে উপমন্ত্রী থাকাকালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অধীন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা দখল করেছিলেন তিনি। এছাড়া অভিযোগ আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের নিয়মিত সংঘর্ষেও ইন্ধন ছিল তার। তবে শুরু থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাবেক এ মন্ত্রী।
ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে গত দেড় দশকে নানা মাত্রার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণসহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল, ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ না করেই শতাধিক শিক্ষককে নিয়োগ প্রদান করা হয়। বেশ কয়েকটি বিভাগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে এবং পদের অতিরিক্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এছাড়া এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া শিক্ষার্থীরা গুরুত্ব পেলেও তার মেয়াদকালে মেধা তালিকায় থাকা শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে ছাত্রলীগের পদধারীদের নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০১৪ সালের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের নিয়োগে বাদ পড়েন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া এক প্রার্থী। কিন্তু ওই একই নিয়োগেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ১৯তম স্থান অধিকার করা প্রার্থী। মেধা তালিকায় ১৯তম স্থান অধিকার করা ওই প্রার্থী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। একই ঘটনা ঘটে ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগেও। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া প্রার্থীকে বাদ দিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে যথাক্রমে দশম ও দ্বাদশতম স্থান অধিকারীকে নেয়া হয়। আরো বেশকিছু বিভাগের নিয়োগের ক্ষেত্রেও এর পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে। এসব বিষয়ে মন্তব্যের জন্য আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
২০০৯ থেকে মে ২০১২ পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শরীফ এনামুল কবির। দায়িত্বে থাকাকালে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, ছাত্রলীগের ‘একটি অঞ্চলভিত্তিক’ অংশকে মদদ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ২০১২ সালে তার ‘মদদপুষ্ট’ হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ নেতাদের হামলায় সংগঠনটির অন্য অংশের কর্মী ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ নিহত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের জেরে উপাচার্যের পদ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।
উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব ছাড়ার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড ও সিন্ডিকেটে শিক্ষাবিদ হিসেবে এবং নিয়োগ বোর্ডে এক্সপার্ট মেম্বার হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয় সরকার। শরীফ এনামুল কবির যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডে শিক্ষাবিদ এবং নিয়োগ বোর্ডে এক্সপার্ট মেম্বার হিসেবে ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। অভিযোগ আছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে তিনি একটি নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুপারিশ করতেন। তাদের মধ্যে বশেমুরবিপ্রবিতে তিনি রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য থাকাকালে মোট নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের।
এ বিষয়ে জানতে শরীফ এনামুল কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি এ ধরনের কোনো কিছুতে জড়িত ছিলাম না। যারা এমন দাবি করছে তারা ভুল বলছে।’
উপাচার্য ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী শিক্ষকরাও দেশের উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম ও এর মানকে বিপর্যস্ত করেছেন নানাভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির আলোচিত নেতা নিজামুল হক ভূঁইয়া। শিক্ষক সমিতির নেতা হলেও তার শিক্ষক হওয়ারই যোগ্যতা ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক পদে যোগদানের যোগ্যতা না থাকায় একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পরে পরিচয় ও সম্পর্কের প্রভাব খাটিয়ে অ্যাডহক ভিত্তিতে শিক্ষক পদে যোগ দেন তিনি। একই প্রক্রিয়ায় শিক্ষক পদে চাকরি নিয়মিতকরণ হয় তার। নিজামুল হক ভূঁইয়ার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—শিক্ষাজীবনের কোনো পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী নিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেননি তিনি। স্নাতক-স্নাতকোত্তরের ফলাফলে নিজ ব্যাচের মধ্যে তার অবস্থান ছিল পেছন সারির দিকে। ফার্স্ট অথর হিসেবে লিখেছেন এমন কোনো গবেষণা নিবন্ধের খোঁজ পাওয়া কঠিন। এমনকি তার পিএইচডি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন মৃত্তিকা বিজ্ঞান (বর্তমানে মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ) বিভাগ থেকে ১৯৮২ ব্যাচে স্নাতক ও ১৯৮৩ ব্যাচে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। উভয় পরীক্ষায়ই তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এরপর ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্সের (আইএনএফএস) ডিপ্লোমা কোর্স ও এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন এবং আইএনএফএসেই গবেষণা সহযোগী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে তিনি অ্যাডহক ভিত্তিতে আইএনএফএসের প্রভাষক পদে নিয়োগ পান। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নিয়োগ নীতিমালায়ও প্রভাষক পদে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনে ন্যূনতম একটি প্রথম শ্রেণী সংবলিত ডিগ্রি বাধ্যতামূলক ছিল। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বে আসার পর সমিতির পক্ষ থেকে সরকারের পক্ষে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন বিবৃতি দিয়ে গেছেন তিনি। এসব বিষয়ে মন্তব্যের জন্য নিজামুল হক ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রিজেন্ট বোর্ড ও সিন্ডিকেট মেম্বার হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে যাদের নিয়োগ দেয়া হতো তাদের একজন শেখ কবির হোসেন। সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চাচাতো ভাই তিনি। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড মেম্বার এবং খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বশেমুরবিপ্রবিতে অর্ধশতাধিক শিক্ষকের নিয়োগে এবং খুকৃবিতে চার শতাধিক শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের ঘটনা ঘটে।
অভিযোগ আছে এসব নিয়োগের বেশির ভাগেই তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এছাড়া তিনি ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যানও ছিলেন। অভিযোগ আছে তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয়করণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
নাম অপ্রকাশ রাখার শর্তে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক এক সদস্য বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড ভাঙার পেছনে শেখ কবিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শুধূ আমাদেরই নয়, আরো বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। মূলত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয়করণ করতেই এসব করা হয়েছিল।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ফারজানা ইসলাম। তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ প্রকল্প নিয়ে উপাচার্য ও ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। ওই ফোনালাপে ছাত্রলীগ নেতারা উপাচার্যের কাছে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের পদ হারান দুই ছাত্রনেতা। তবে ফারজানা ইসলাম মেয়াদ পূর্ণ করা পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকেন।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ছাত্রলীগের কর্মীদের নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। ওইদিন আবরার ফাহাদকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে রাতভর নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনার সময় বুয়েটে উপাচার্য হিসেবে ছিলেন ড. সাইফুল ইসলাম। তিনি ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য হন। অভিযোগ রয়েছে আবরারকে যখন নির্যাতন করা হচ্ছিল তখন উপাচার্যকে বিষয়টি জানানোর পরও তিনি আবরারকে উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেননি। এমনকি তিনি ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ারও চেষ্টা করেন। এছাড়া তার সময়ে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এমন নানা অজুহাতে ব্যাপক নির্যাতন চালাত বলে অভিযোগ রয়েছে। আর তৎকালীন উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সব জেনেও এর প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি তিনি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেয়াদের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আবদুস সোবহান। মেয়ে সানজানা সোবহানকে নিয়োগ দিতে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েই খুলেছিলেন নতুন বিভাগ। ওই সময় ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬২তম সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হয় যেকোনো বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভাগীয় একাডেমিক মেধা তালিকায় প্রথম থেকে সপ্তম অবস্থানে থাকতে হবে। কিন্তু উপাচার্যের মেয়ে মেধা তালিকায় ছিলেন না। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা পরিবর্তন করে মেয়েকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি।
এছাড়া পরিবর্তিত নীতিমালার সুযোগে জামাতা এটিএম সাহেদ পারভেজকেও নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করেন উপাচার্য আবদুস সোবহান। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর (ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) প্রভাষক পদে তাকে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এছাড়া নিজের শেষ কর্মদিবসে কর্মকর্তা ও কর্মচারী হিসেবে ১৩৮ জনকে নিয়োগ দেন তিনি। পরবর্তী সময়ে হা্ইকোর্টের নির্দেশে এসব নিয়োগ বাতিল করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮তম উপাচার্য ছিলেন শিরীন আখতার। ২০১৯ সালের নভেম্বরে উপাচার্য পদে দায়িত্ব নেন তিনি। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই তৃতীয় শ্রেণীর ১১৫ আর চতুর্থ শ্রেণীর ৫৭ জন ১৭২ জনকে নিয়োগ দেন। এর বাইরে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ১৩০ জন শিক্ষকসহ ৩৬৮ জনকে নিয়োগ দেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে এসব নিয়োগেও তিনি তার নিজের পছন্দের প্রার্থীদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এমনকি শেষ কর্মদিবসেও তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে ৩৭ জনকে নিয়োগ দেন, যাদের প্রায় সবাই ছিল ছাত্রলীগ কর্মী।
২০১৯ সালে আন্দোলনের জেরে পদত্যাগ করেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দীন। তার সময়ে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি এবং কম যোগ্যতাসম্পন্নদের নিয়োগের অভিযোগ ওঠে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন খোন্দকার মাহমুদ পারভেজকে। সম্পর্কে তিনি ছিলেন নাসিরউদ্দীনের ভাতিজা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে স্নাতক ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী বাধ্যতামূলক হলেও পারভেজ মাহমুদের দুটোতেই ছিল দ্বিতীয় শ্রেণী। শর্ত শিথিল করে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে। একইভাবে শর্ত শিথিল করে নিয়োগ দেয়া হয় কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে আক্কাস আলীকেও। এছাড়া তার মেয়াদকালে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়। দুর্নীতি ও শিক্ষার্থীদের দমন-পীড়নের অভিযোগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়। পরে ইউজিসি এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং কমিটি অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়। ওই বছর ৩০ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন নাসিরউদ্দীন।
শিক্ষার্থীর চেয়ে অধিকসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে এবং নিয়োগে অনিয়মের কারণে আলোচনায় আসেন খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. শহীদুর রহমান খান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন ৪৪৭ জন। এ ৪৪৭ জনের মধ্যে উপাচার্য নিজের ছেলে-মেয়ে, শ্যালক, ভাতিজাসহ ৪২৬ জন আত্মীয়কে নিয়োগ দেন। সর্বশেষ স্ত্রীকে নিয়োগ দিতে গেলে এ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের বিষয়গুলো সামনে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্যের ছেলে-মেয়েসহ নয় স্বজন এবং ৭৩ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। ইউজিসি থেকেও বলা হয়েছিল নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে। তারপরও ৪০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেন উপাচার্য। সর্বশেষ অনিয়ম ও দুর্নীতির বোঝা মাথায় নিয়ে ২০২২ সালে ১০ সেপ্টেম্বর রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়েন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা মৌখিক, এটাকে দুই-তিনভাবে করা উচিত। প্রশাসনিক দিকেও যারা, দলীয় স্বার্থ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ ও শিক্ষাঙ্গনের স্বার্থ আগে রাখবে, তাদের যেন নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের দলীয় পরিচয় কোনোভাবে মুখ্য হওয়া উচিত না। তার ক্রেডিবিলিটি, গবেষণা, বহির্বিশ্বের প্রতি যে আউটলুক ছিল, এর ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া উচিত। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের করতে হলে তার একটা বিশ্ববীক্ষা থাকতে হয়। সেই বিশ্ববীক্ষার ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। উপাচার্যের কাজ হচ্ছে বিশ্ব দরবারে কীভাবে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলে আনা যায়, কীভাবে বড় গবেষণাগুলোয় ফান্ডিং করা যায়, সেটি নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগুলোকে বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়াও উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের কাজ। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের আসলে দরকার অনুগত ভৃত্যের দল, চাবুকের দল। সেগুলো করতে গিয়ে তারা মূল কাজ করতে পারেন না। তাই এ জায়গায় মেরুদণ্ড আছে এমন মানুষ দরকার, যাদের আসলে চাবুকের দরকার নেই। এ ধরনের মানুষ পাওয়া কঠিন, কিন্তু অসম্ভব কিছু না।’
শাবিপ্রবিতে দুই মেয়াদে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক ফরীদ উদ্দিন। অভিযোগ আছে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে পদায়নের ক্ষেত্রে অঞ্চলপ্রীতি দেখিয়েছেন। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও আছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বাধা ও নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ও আপত্তিকর মন্তব্যেরও অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের জেরে ২০২২ সালে উপাচার্যের পদত্যাগে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ওই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ ও ছররা গুলি চালায়। এ ঘটনায় দেশজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানায়।
২০১৩ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন ড. মীজানুর রহমান। যুবলীগের সভাপতি হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে আলোচনায় আসেন তিনি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে ছাত্রলীগ কর্মীদের প্রাধান্য দেয়ারও অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোতে তিনি জানিয়েছিলেন, যুবলীগের দায়িত্ব পেলে উপাচার্যের দায়িত্ব ছেড়ে দিতেও রাজি আছেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের নিয়েও বিভিন্ন বিতর্কিত মন্তব্য করেন তিনি।
দেশের প্রথম ছাত্র রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এক সময় বেশ সুনাম অর্জন করেছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এক সময় বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নানা অর্জন বহির্বিশ্বেও বেশ খ্যাতি পেয়েছিল। চাকরির বাজারেও বেশ ভালো করেছেন এখানকার শিক্ষার্থীরা। যদিও সে সুনাম এখন অনেকটাই ম্রিয়মাণ। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ জামানকে দায়ী করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। তার অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণকাজ ও নিয়োগে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয়ভাবে একের পর এক নতুন ডিসিপ্লিন (বিভাগ) খোলার অভিযোগও উঠেছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা দিতে আসা সাবেক এক নারী শিক্ষার্থীকে হয়রানিমূলক ও আপত্তিকর মন্তব্য করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ জামান উপাচার্য থাকাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন আটটি ডিসিপ্লিন ও একটি ইনস্টিটিউট চালু, ১০০ শিক্ষকের পদ সৃজন ও নিয়োগ, ৬৫ জন কর্মকর্তার আপগ্রেডেশন, ১২ কর্মকর্তার নতুন পদে নিয়োগ ও ৮৩ জন কর্মচারী নিয়োগ হয়। অভিযোগ আছে, তার সময় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপকমাত্রায় অনিয়ম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্কুল ও ডিসিপ্লিনে ডিন ও বিভাগীয় প্রধান পদে যোগ্যতমদের পরিবর্তে অনুগতদের নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। নিজের আত্মীয়-স্বজনকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। কোনো কোনো ডিসিপ্লিনে শিক্ষক স্বল্পতা থাকলেও বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে নিয়োগ কম দেয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ঘটনাও ঘটেছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসিকে তদন্তের অনুরোধ জানিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যদিও সব নিয়োগই স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হয়েছে বলে দাবি করেছিল ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ জামানের প্রশাসন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন, আবাসিক হল, গ্রন্থাগার, অতিথি ভবনসহ কয়েকটি নতুন ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি আদায়ে ২০১৯ সালের শেষ দিকে উপাচার্য মো. ফায়েক উজ জামানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। সে বছর ডিসেম্বর মাসে ৪৫ জন শিক্ষক রেজিস্ট্রার বরাবর দেয়া এক স্মারকলিপিতে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। স্মারকলিপিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন হল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়। এর সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়। স্মারকলিপিতে জানানো হয়, অনিয়মের মাধ্যমে বিতর্কিত ঠিকাদার ও যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানকে হল নির্মাণের কাজ পাইয়ে দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠার পর ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দরপত্র বাতিল করে আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু এবারো রহস্যজনকভাবে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন ভবন নির্মাণে ত্রুটি, মানসম্মত বৈদ্যুতিক ক্যাবল ব্যবহার না করায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখা দেয়ারও অভিযোগ তোলেন শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মেয়াদের শেষদিকে এসে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বৈধতা এবং ভিন্নমত দমনে তড়িঘড়ি করে অনুগতদের সিন্ডিকেটে অন্তর্ভুক্ত করেছেন ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ জামান। এরপর তাদের সহায়তায় সিন্ডিকেটের ২১২তম সভায় অবৈধভাবে কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার ও অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, বিষয়টি পরে আদালতে গড়ানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর অনশনের ঘটনাও ঘটে।
ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ জামান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে তার নামে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশ হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা বই ‘আপনিই তো বাংলাদেশ’।
এসব বিষয়ে জানতে ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ জামানের সেলফোনে কল করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি।
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) ২০২২ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ না করে এবং যোগ্যতর প্রার্থীদের উপেক্ষা করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ে অহনা আরেফিনকে। এর কিছুদিন পরই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে নিয়োগ পান বশেমুরবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুবের মেয়ে ফারজানা মাহবুব। তবে দুই উপাচার্যেরই দাবি ছিল তারা নিয়ম মেনেই পরস্পরের কন্যাদের নিয়োগ দিয়েছেন।
২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর থেকেই একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছেন অধ্যাপক আ ফ ম আবদুল মঈন। অভিযোগ আছে, আড়াই বছর মেয়াদে বেশকিছু নিয়মবহির্ভূত নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। দুর্নীতির পক্ষে সাফাই গেয়ে গণমাধ্যমের শিরোনামও হয়েছেন। দায়িত্বে থাকাকালে শিক্ষকদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে হাতাহাতিতেও জড়িয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে দায়িত্বে থাকাকালে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকা যাবে না উল্লেখ থাকলেও আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়া আসামিকে সান্ধ্য কোর্সে ভর্তির সুযোগ করে দেয়ারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। একই মামলার আরেক অভিযুক্তকে নিয়োগ দেন কর্মকর্তা হিসেবে। এছাড়া তার সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মেরও অভিযোগ উঠেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, ‘চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ’৭৩-এর যে অধ্যাদেশ তৈরি হয়েছিল সেখানে গণতন্ত্র ছিল। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলীয় উপাচার্য নিয়োগের জেরে তারা ওই দলের উদ্দেশ্য সাধনে এবং দলীয় ব্যক্তিদের নিয়োগেই ব্যস্ত থাকেন। এমনকি প্রশাসনকে প্রশ্ন করার যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বডি শিক্ষক সমিতি, সেই শিক্ষক সমিতির কার্যকারিতাও নষ্ট করা হয়েছে। শিক্ষক সমিতির শিক্ষকরাই এখন প্রশাসনিক বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থাৎ তিনিই প্রশাসনের অংশ হয়ে গেছেন এবং প্রশাসনের কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারছেন না। এ জবাবদিহিতার জায়গাগুলো এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়াতেই সংকটগুলো তৈরি হচ্ছে। আমরা যদি এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে বের হতে হবে। শিক্ষক রাজনীতি হোক বা ছাত্র রাজনীতি, সেগুলো হতে হবে শিক্ষক-ছাত্র তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে।’
গত দেড় দশকে প্রশাসনের অনেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি বা এর কাছাকাছি পর্যায়ের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। একাডেমিক গবেষণাভিত্তিক এসব ডিগ্রি অর্জনে প্রচুর সময় প্রয়োজন হয়। এজন্য এমনকি শিক্ষকতার মতো সার্বক্ষণিক একাডেমিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িতদেরও পিএইচডি বা এমফিল ডিগ্রি অর্জনের জন্য শিক্ষা ছুটি নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু গত সরকারের প্রশাসনের প্রভাবশালীরা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালে অনেকটা ক্ষমতার জোরেই জালিয়াতির মাধ্যমে পিএইচডির মতো ডিগ্রিও বাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের সহায়তা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রভাবশালী শিক্ষকরা। ব্যাপক দুর্নীতি ও দমন-পীড়নে অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) ডিগ্রি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ থেকে। ২০১৯ সালে ঢাবি থেকে এ ডক্টরেট ডিগ্রি নেন তিনি। র্যাবের মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় নিয়ম শিথিল করে বিশেষ বিবেচনায় তাকে অনুষদটির অধীন ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ডিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির অনুমতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে তার হয়ে সুপারিশ করেছিলেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, যিনি চলতি মাসেই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
অভিযোগ আছে, ডক্টরেট ডিগ্রি প্রোগ্রামে ভর্তির যোগ্যতাই ছিল না বেনজীর আহমেদের। শর্ত শিথিল করে তাকে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়েছিল। ডিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হয়। কিন্তু বেনজীর আহমেদের ডিগ্রি ছিল বিএ (পাস)। এছাড়া শিক্ষাজীবনের সব পাবলিক পরীক্ষায় কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নম্বর পেতে হয়। বেনজীরের তা ছিল না।
বেনজীর আহমেদের ক্ষেত্রে ‘নিয়ম শিথিলের’ যুক্তি হিসেবে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সুপারিশপত্রে লিখেছিলেন, ‘বেনজীর আহমেদ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক। সমাজের এ রকম একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে ডিবিএ প্রোগ্রামে বিশেষ বিবেচনায় হলেও ভর্তির অনুমতি দিলে দেশের কল্যাণে কাজে আসবে।’
বেনজীর আহমেদ এখন ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে দেশ থেকে পলাতক রয়েছেন। এছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনও রয়েছে।