জাতীয়

স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা

Published

on

বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ সাল ছিল সর্বাধিক বেদনাদায়ক এবং একইসঙ্গে সর্বাধিক সাফল্যজনক একটি অধ্যায়। বেদনার বিষয় এই কারণে যে, এ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের লাগামহীন অত্যাচার-অবিচার ও জিঘাংসার শিকার হয়ে লাখো বাঙালিকে জীবন হারাতে হয়েছিল, সম্ভ্রম হারিয়েছিল অসংখ্য মা-বোন। বিধ্বস্ত হয়েছিল রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বাড়ি-ঘর, স্কুল-কলেজসহ অসংখ্য স্থাপনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বছরটি বাঙালির জাতীয় পথচলায় স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে অমর হয়ে আছে আমাদের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তৎলব্ধ স্বাধীনতার কারণে। সেই একাত্তর আজও ষোল কোটি বাঙালির প্রাণের প্রেরণায় পরিণত হতে পারে। ঘুণে ধরা এই স্বার্থভিত্তিক সমাজে যখন অপরকে সুখী করতে কেউ স্বশরীরে একটি ফুলের আঁচড় নিতেও রাজী নয়, যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির দিকে শকুণের ন্যায় লোলুপ দৃষ্টি ফেলে রেখেছে, জাতির ঐক্য ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, সন্ত্রাসীরা স্বজাতির নিরীহ মানুষগুলোকে আগুন দিয়ে ঝলসে দিচ্ছে, তখন একাত্তরের সেই নিঃস্বার্থ চেতনা বড়ই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নিপীড়িত, অত্যাচারিত, জনমদুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য রক্তে শিহরণ জাগানো সেই স্লোগান আজ আবারও প্রাসঙ্গিক-

‘মোরা একটি মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করি’।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি:

স্বাধীনতা যুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয় নি, ৯ মাসের এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হতে বহু বছর লেগেছে। শত শত অন্যায়-অবিচারের স্টিম রোলার চলেছে এ জাতির উপরে। পাকিস্তানিরা ক্ষমতালাভের পর থেকেই এ দেশের মানুষের উপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, অপশাসন চালিয়েছে তারই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি রচিত হয়েছে এই যুদ্ধের মাধ্যমে। অন্যায়, অবিচার, যুলুমের বিরুদ্ধে বাঙালির সোচ্চার কণ্ঠের এটি একটি পর্যায়মাত্র। বস্তুত পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ কেবল ৯ মাস নয়, বহু বছর ধরে চলেছে। সে যুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ, স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আমাদেরকে আরও আগে থেকে শুরু করতে হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দীর্ঘ প্রায় আড়াইশ বছর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি আমাদেরকে শোষণ করেছে। এ দেশের সম্পদ পাচার করে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে, আর আমাদেরকে উপহার দিয়েছে ক্ষুধা-দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ। কোটি কোটি মানুষকে মরতে হয়েছে শুধু ক্ষুধার জ্বালায়। আমাদের মান-সম্মানকে বুটের তলায় পিষ্ট করেছে, আমাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ রুদ্ধ করেছে। বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা বারবার পদদলিত হয়েছে। এরপর যখন ব্রিটিশরা চলে গেল, বলা হলো- তোমরা স্বাধীন। আর কেউ তোমাদের জীবন-সম্পদ দিয়ে খেলা করবে না, তোমাদের বাড়া ভাতে থাবা বসাবে না, না খাইয়ে মারবে না, অন্যায়, অবিচার করবে না, বৈষম্য করবে না। তোমরা একই ধর্মের মানুষ একই সাথে সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। আমরা স্বভাবসুলভ সরল হৃদয়ে বিশ্বাস করলাম। ইসলামের সুমহান আদর্শ- সাম্য, ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষম বণ্টন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে অর্থাৎ এই অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ইসলামী জীবনাদর্শ উপহার দেওয়ার কথা বলে ভারত থেকে স্বাধীন জাতিসত্ত্বা নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি দেশ গঠন করা হলো। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান উভয় ভূখণ্ডের মানুষই মুসলমান। তারা এক আল্লাহকে সেজদাহ করে, একই দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ পড়ে। তারা এমন নবীর উম্মত যাঁর স্পষ্ট নির্দেশ- মুসলমান ভাই ভাই, মুসলমানের রক্ত ও মান-মর্যাদা একে অপরের জন্য হারাম (পবিত্র)। কাজেই ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূ-খণ্ডের ফারাক ধর্মের মেলবন্ধনকে ছিন্ন করতে পারবে না এমনটাই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে হলো ঠিক উল্টোটা। একই ধর্মের মানুষ হিসেবে ভাই ভাই হয়ে বসবাস করার যে আশা করা হয়েছিল তা উবে গেল অল্প দিনেই। প্রতারক, স্বার্থবাজ, পাকিস্তানের নেতারা অচীরেই ভুলে গেল আল্লাহ ও আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে প্রদত্ত ওয়াদার কথা। পাকিস্তানি শাসকরা মুখে মুখে ধর্মকে আলিঙ্গন করে রাখলেও, অল্প দিনেই কার্যত ধর্মের লেবাস ছেড়ে ঘোর অধর্মের ডাল-পালা বিস্তার করল। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক- সকল দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পদে পদে বঞ্চিত করা শুরু হলো। ব্রিটিশ শোষকদের প্রেতাত্মা ভর করল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উপর। ঔদ্ধত্য তাদেরকে এতটাই অন্ধ করে দিল যে, এ দেশের শত বছরের নির্যাতিত, নিপীড়িত সহজ-সরল মানুষের বুকে গুলি চালাতেও তারা দ্বিধা করল না। ভাষার জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য, সর্বপোরি ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার বাঙালির রক্ত ঝরতে লাগল। এরই ধারাবাহিকতায় রচিত হলো ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ এর নির্বাচন এবং ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। যখনই পশ্চিম পাকিস্তানিরা এ দেশের নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ছক এঁকেছে, এ দেশের কোটি কোটি মানুষ সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ফলে পাকিস্তানি শোষকরা ব্যর্থতার গ্লানিতে জ্বলে অস্ত্রের ভাষায় নিজেদের ক্ষোভের প্রশমন ঘটাতে চেয়েছে। সারা বিশ্ব দেখেছে- বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দৃঢ়তার সাথে শোষকদের প্রতিটি বুলেটকে হজম করেছে, কিন্তু পিছপা হয় নি। ঐক্যের শক্তির বারবার পরাজিত করেছে অস্ত্রের শক্তিকে, এমনকি পরাজিত করেছে ১৯৭১ সালেও।

স্বাধীনতার চেতনা মানে কি ধর্মহীনতা?

একাত্তরে এই জাতির সংগ্রাম ছিল অন্যায়, অবিচার, অনাচার, যুলুম, নির্যাতন তথা অসত্যের বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কোটি কোটি নিরীহ ও শোষিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সংগ্রাম। সেই সাথে সেটা ছিল ধর্মের নামে চলা অধর্মের বিরুদ্ধে প্রকৃত ধর্ম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। নিরীহ মানুষকে আল্লাহু আকবার বলে গুলি করলেই কি সেটা বৈধ হয়ে যায়? না, হয় না, বরং সে কাজ আরও গর্হিত হিসেবে প্রতিভাত হবার যোগ্য। একাত্তরে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী এমন গর্হিত কাজই করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের সকল অপকর্মকে জায়েজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ দেশের মানুষ ধর্মান্ধের মতো তাদের অন্যায় মেনে নেয় নি। কোনটা ধর্ম, কোনটা ধর্মব্যবসা- বাংলার লাখো কোটি জনতা তা ভালোভাবেই বুঝেছিল। তাই এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ ধর্মের নামে চলা অধর্মের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ধর্মব্যবসায়ীরা লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়। অর্থাৎ একাত্তরের চেতনা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হলো- আজ অনেকেই একাত্তরের চেতনা বলতে ধর্মহীনতাকে বোঝেন, যে ধর্মহীনতা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার চিন্তা-চেতনা, ভাবধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামবিদ্বেষী, ধর্মবিদ্বেষী কিছু লেখক-সাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটক, ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ার প্রচারণা এবং ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের সামনে থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা কার্যত উধাও হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে কৌশলে দেশপ্রেমিক তরুণদের মধ্যে ধর্মহীনতার বিষবাস্প ছড়িয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস চলছে।
আমরা সকলেই জানি- মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মুক্তির লক্ষ্যে। কী থেকে মুক্তি? যে কোনো অন্যায়, অসত্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, তা সামাজিক হোক, রাজনৈতিক হোক বা ধর্মীয় হোক। একটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী দুর্নীতি করলে তার দায়ভার যেমন ওই সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান নেবে না, ওই দুর্নীতিবাজ কর্মচারীকে নিতে হবে, তেমনই ধর্মের দোহাই দিয়ে যদি কেউ অপকর্ম করে তার দায়ভারও ধর্ম নেবে না, এর জন্য দায়ী করতে হবে ওই ধর্মব্যবসায়ীদেরকে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, যুগে যুগে ধর্মই মানুষকে অসত্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে সত্যের আলোয় আলোকিত করেছে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের ধর্মহীন দল হিসেবে প্রচার করতো তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো পরের কথা, শোচনীয়ভাবে পরাজিত হতে হতো এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। একইভাবে লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা ধর্মহীনতার চেতনা নিয়ে যুদ্ধ করেছে- এমন ধারণাও নিতান্তই অর্বাচীনসুলভ। কাজেই একাত্তরের চেতনার সাথে ধর্মহীনতাকে জুড়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস থেকে সকলের বের হয়ে আসা উচিত।

লেখক: উপদেষ্টা, দৈনিক বজ্রশক্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version