Connect with us

বিশেষ নিবন্ধ

রাজমহল থেকে পলাশী : দু’টি ঐতিহাসিক ভুল

Avatar photo

Published

on

আতাহার হোসাইন :

২৩ জুন, ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। ঐতিহাসিকভাবে দাবি করা হয় এই দিনেই বাংলার আকাশ থেকে প্রায় দুইশ বছরের জন্য স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর অনেক আগেই অর্থাৎ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শেষ স্বাধীন শাসকদের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা হারায়। ঐতিহাসিকদের নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে বাংলার শেষ স্বাধীন শাসক হিসেবে চিহ্নিত করাটা এক ধরনের ব্যর্থতা বলেই প্রতীয়মান হয়। আজকের আলোচ্য নিবন্ধে আমরা সে বিষয়টিই তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।

বাংলার ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের অবদান অনস্বীকার্য। ভারতীয় ঐতিহাসিক ছাড়াও ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীগণ মুসলিম বীরদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পান। কিন্তু যদি আমরা যুক্তির নিরিখে বিচার করি তাহলে তাদেরকে কোনভাবেই বিদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি না। বিদেশি হিসেবে একমাত্র তারাই গণ্য হবে যারা বাইরে থেকে এই উপমহাদেশে এসে লুটপাটের মাধ্যমে ধন-সম্পদ অর্জন করে নিজেদের দেশে পাঠিয়েছে এবং এক সময় নিজেরাও নিজেদের দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু যারা নিজেদের আত্মীয়-পরিজন নিয়ে এদেশে স্থায়ীভাবে চলে আসেন এবং এ দেশের মাটিও মানুষের সাথে মিশে গিয়ে এই দেশ গড়ার পেছনে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন তাহলে আমরা তাদেরকে কি করে বিদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি? এই যুক্তির নিরিখে বরং ইউরোপীয়ানদেরকে আমরা বিদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। কেননা তারা এদেশের বুকে এসে শাসন-শোষণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করে দুইশত বছর পরে এদেশ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু মুসলিমদের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই তারা সুদূর আফগানিস্তান, তুর্কিস্থানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে এদেশে এসে এদেশের মাটি ও মানুষকে আপন করে নিয়ে আবার এদেশের মাটির সাথে মিশে গিয়েছেন।

মুসলিমদের এদেশের বুকে আসার পেছনে নিছক দেশ জয় করাই উদ্দেশ্য ছিলো না। এর সাথে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করাও ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু কালক্রমে যখন তারা সে উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে শুধুমাত্র দেশ জয়ের মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে তখন তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে প্রকৃত মুমিনের সংজ্ঞা (সুরা হুজারাত-১৫) থেকে বের হয়ে যান। ফলশ্র“তিতে তারা ধীরে ধীরে পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে গোলামিতে নিমজ্জিত হয়। বলা আবশ্যক- আল্লাহর ঘোষণা মোতাবেক মুসলিম জাতি কখনো পরাজিত হতে পারে না। কারণ তিনি পবিত্র কোর’আনে মুমিনদেরকে দুনিয়ার কর্তৃত্ব ও শাসনক্ষমতা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন (সুরা নূর ৫৫)। তিনি বলেছেন, মুমিনদের সঙ্গে যুদ্ধে কাফেররা কখনও বিজয়ী হবে না (সুরা ফাতাহ ২৩), মুমিনরাই সর্বদা বিজয়ী হবে (সুরা এমরান ১৩৯), আল্লাহ নিজে মুমিনদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন (সুরা আনফাল ১৭), তিনি স্বয়ং মুমিনদের অভিভাবক (বাকারা ১৫২), মুমিনদেরকে সাহায্য করা তাঁর কর্তব্য (সুরা রূম ৪৭)। তার মানে পলাশীর যুদ্ধে ‘মুসলিম’ বাহিনীর পরাজিত হওয়ার অর্থ হলো তখন আর এই জাতি প্রকৃত মুমিন ছিল না। এ ব্যাপারে রসুলাল্লাহর ভবিষদ্বাণী ছিলো এই যে তিনি বলেছেন, “আমার উম্মাহর আয়ু ৬০/৭০ বছর।” অর্থাৎ রসুলাল্লাহর (সঃ) এন্তেকালের পর এই জাতি জাতি হিসেবে ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত তার আরদ্ধ কাজ চালিয়ে যাবে। কী কাজ? এই প্রশ্নের জবাবে এখানে কিছু কথা না বললেই নয়। তাঁর কাজ সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে কি দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন।

রসুলাল্লাহর উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব ছিল সমস্ত বাতিল দ্বীন বা জীবনব্যবস্থাগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে দীনুল ইসলামকে সমস্ত পৃথিবীর ওপর প্রতিষ্ঠা করা (সুরা ফাতাহ: ২৮, সুরা সফ: ৯, সুরা তওবা: ৩৩)। সমস্ত পৃথিবীতে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আল্লাহর শেষ রসুল (সঃ) একটি জাতি বা উম্মাহ গঠন করলেন যারা উম্মতে মোহাম্মদী নামে পরিচিত ছিলেন। রসুল (সঃ) এর এই জাতিটিকে একটি জাতি না বলে সামরিক বাহিনী বলাটাই যথার্থ হয়। উম্মতে মোহাম্মদীর সঠিক আকিদার মধ্যে যে জাতীয় চরিত্র আল্লাহর রসুল (সঃ) গেঁথে দিয়েছিলেন তা হচ্ছে World Oriented  বা দুনিয়া অভিমূখী। রসুলাল্লাহ (সঃ) এর এন্তেকালের পর পর তাঁর হাতে গড়া চরম দরিদ্র, অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা সেই উম্মতে মোহাম্মদী একটা একটা করে নয়, একসাথে সামরিকভাবে আক্রমণ করে তদানীন্তন পৃথিবীর দুই দুইটি বিশ্বশক্তি, একদিকে অগ্নি-উপাসক পারস্য ও অন্যদিকে খ্রিস্টান রোমান সাম্রাজ্যকে পরাজিত ও ছিন্নভিন্ন করে অর্ধ-পৃথিবীতে এক নতুন আদর্শ, নতুন সভ্যতার জন্ম দিলেন, অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্ধ-পৃথিবীর শাসক এবং সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়ে গেল। এভাবে সঠিক আকিদা নিয়ে উম্মতে মোহাম্মদী জাতি হিসেবে মোটামুটি প্রায় ১০০ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবজাতিকে শান্তি দেয়ার জন্য সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন। কিন্তু এরপর ঘোটল এক সাংঘাতিক ঘটনা। জাতির আকিদার মধ্যে ভিন্নতা প্রবেশ করল। ৬০/৭০ বছর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এ জাতির উমাইয়া, আব্বাসীয়া, ফাতেমীয়, এবং উসমানীয় খলিফা নামধারী শাসকগণ পৃথিবীর অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের মত রাজা- বাদশাহী আরম্ভ করলো। উম্মতে মোহাম্মদী বিশ্বশক্তির অন্যতম পারস্য শক্তি পরাজয়ের পর যেটাকে আমরা ইরান বলি, সেই ইরানি জাতিটি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে গিয়েছিলো। তারপর মুসলিম জাতি যখন ভারতে প্রবেশ করে, এখানেও তারা বাদশাহী করা আরম্ভ করলো। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে মুসলিম শাসকেরা বাংলায় রাজতন্ত্রের সূচনা করেন।

এই সময়ে, অর্থাৎ খ্রিস্টিয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে এই উপমহাদেশের দুর্বল মোঘল সম্রাট এবং বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মোঘলদের নিযুক্ত সুবেদারগণ অর্থাৎ নবাবদের দেশ পরিচালনার ব্যর্থতা, সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ভোগবিলাস এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে উপমহাদেশে বাণিজ্য করতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি সামরিকভাবে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে শুরু করে। নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর তার প্রিয় দৌহিত্র সিরাজ উদ দৌলা চরম প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব হিসেবে মসনদে অধিষ্ঠিত হন। সিরাজ-উদ-দৌলা সিংহাসনে বসার পর থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে তাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে ছিলেন ঘষেটি বেগম, রাজা রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণবল্লভ, মানিক চাঁদ, আমির চাঁদ, আমির বেগ, খাদেম হোসেন, ইয়ার লতিফ খান, ওয়াটস, নবকুমার, এবং প্রধান সেনাপতি মীরজাফর। সেই সময়ে বেশকিছু হিন্দু সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জমিদাররা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে অপসারণ করতে ষড়যন্ত্রকারীদের মদদ দেয়। এক পর্যায়ে ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে হাত মেলায় এবং মীরজাফরকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব বানাতে কাশিমবাজার কুঠিতে মীরজাফর-ক্লাইভের মধ্যে এক গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই গোপন চুক্তির ধারাবাহিকতায় আসে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। সেই যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভসহ কতিপয় কুচক্রী মহলের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে নবাব সিরাজের নেতৃত্বাধীন ৫৭ হাজার বাহিনী ক্লাইভের ৩ হাজার বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইংরেজদের হাতে। ১৭৫৭ সালের ২ জুলাই বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে জাফরগঞ্জের এক কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় মোহাম্মদী বেগ তার নাঙা তলোয়ার দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে সিরাজের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। রক্তস্রোতের উপর লুটিয়ে পড়েন বাংলার শেষ ‘মুসলিম’ শাসক নবাব সিরাজ উদ দৌলা। মীরজাফর পুতুল নবাব হন। পলাশীর বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় কালক্রমে ইউরোপের খ্রিস্টানরা সামরিক শক্তি বলে এই পাক-ভারত উপমহাদেশসহ সমস্ত মুসলিম ভূখণ্ড পদানত করে।

এখানে ইতিহাসে একটি ভুল করা হয়। তা এই যে, বলা হয়ে থাকে ২৩ শে জুন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে সংঘঠিত লড়াইয়ে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীন শাসক নবাব সিরাজ উদ দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এখানেই ঐতিহাসিকগণ ভুল করেছেন। কারণ, এই নবাব বংশীয় শাসকগণ কখনোই এই এলাকার স্বাধীন শাসক ছিলেন না। তারা ছিলেন দিল্লির মুঘল সম্রাটদের নায়েব, অর্থাৎ প্রতিনিধি। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক জনাব হায়দার আলী চৌধুরী রচিত ‘পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ’ নামক ইতিহাস গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন, “স্বাধীন নবাব বলে যে কথাটি প্রচলিত তা ঐতিহাসিক সত্য নয়! স্বাধীন নবাব কথাটি নাট্যকারদের লেখা। কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। নবাব কোনদিন স্বাধীন হয় না (পৃষ্ঠা: ৭৭)”। তাঁর এই কথা অত্যন্ত যৌক্তিক, কারণ নবাব শব্দটি আরবি নায়েবের অন্যতম রূপ। আর নায়েব মানেই শাসকের প্রতিনিধি। সিরাজ উদ দৌলা ছিলেন মোগল শাসকদের অধীনস্থ সুবেদার। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে বাংলার শাসনে সর্বশেষ স্বাধীন শাসনকর্তা সিরাজ উদ দৌলা নন। সিরাজ উদ দৌলাসহ তার পূর্বসূরী নবাব আলীবর্দী খানগণ সবাই ছিলেন তৎকালীন দিল্লির মসনদে আসীন মুঘল সম্রাটদের অনুগত প্রতিনিধি। প্রকৃতপক্ষে বাংলার স্বাধীন শাসক এবং স্বাধীনতা গত হয় আরো অনেক আগে। অনুসন্ধিৎসু পাঠককে সত্যিকার ইতিহাস জানতে ফিরে যেতে হবে আরো পেছনে।

মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন দাউদ খান পন্নী। পন্নী বংশীয় শাসনামলকে অনেক ইতিহাস বইতে কররানী আমল নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। মূলত, আফগানিস্তানের কাররান অঞ্চলের অধিবাসী হওয়ায় তাদেরকে কাররানী বলা হতো, তবে সত্যিকার অর্থে তাদের বংশের নাম ছিল পন্নী। দিল্লির কেন্দ্রীয় সিংহাসনে শক্তিমান শাসক মোঘলগণ আসীন থাকায় সে সময়ে বাংলায় কোন শাসক স্বাধীন ছিলেন না। যারাই শাসন কাজ পরিচালনা করতেন, করতেন দিল্লির বাদশাহর অনুগত্য স্বীকার করেই। এরা ইতিহাসে নবাব হিসেবে পরিচিত। এদের প্রায় সবাই আত্মীয়তাসূত্রে দিল্লির বাদশাহদের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত ছিলেন।

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত গোলাম হোসায়ন সলীম এর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘রিয়াজুস সালাতিন’ গ্রন্থে বর্ণিত এই রাজবংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলো, ৯৭১ হিজরীতে (১৫৬৩ খ্রিঃ) নিজ ভাইকে হত্যা করে মসনদ দখল করে ক্ষমতা লাভ করা অবৈধ শাসক গিয়াস উদ্দিনকে দমন করার জন্য দক্ষিণ বিহারের গভর্ণর সুলায়মান খান পন্নী তাঁর জেষ্ঠ্য ভ্রাতা তাজ খান পন্নীকে গৌড়ে প্রেরণ করেন। গিয়াস উদ্দিনকে হত্যা করে তাজ খান পন্নী তার ভ্রাতা সুলায়মান পন্নীর পক্ষে বাংলার গভর্নররূপে ৯৭১ থেকে ৯৭২ হিজরী (১৫৬৪-৬৫খ্রিঃ) পর্যন্ত শাসন কার্য পরিচালনা করেন। ৯৭২ হিজরীতে তার মৃত্যু হয়। তাজখানের মৃত্যুর পর সুলেমান খান নিজেকে বাংলা ও বিহারের সম্পূর্ণ স্বাধীন সুলতানরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। খারাপ আবহাওয়ার জন্য তিনি গৌড় ত্যাগ করে টান্ডা শহরে রাজধানী স্থাপন করেন। ৯৭৫ হিজরীতে তিনি উড়িষ্যা জয় করেন এবং তথায় একজন গভর্নরের অধীনে স্থায়ীভাবে এক বৃহৎ সৈন্যবাহিনী রেখে কুচবিহার জয়ের জন্য যাত্রা করেন। কুচবিহারের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ অধিকার করার পর তিনি সংবাদ পান যে, উড়িষ্যায় বিদ্রোহীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রয়োজনবশত: তিনি কুচবিহার শহরের অবরোধ তুলে রাজধানী টান্ডায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেই সময় এইভাবে কিছুকাল সমগ্র হিন্দুস্থানে গোলমাল আরম্ভ হয়েছিল। বাদশাহ হুমায়ূন যখন পারস্য থেকে হিন্দুস্থানে ফিরে আসেন, তখন সুলেমান খান পন্নী দূরদর্শিতাবশত: (কৌশলে) উপহারসহ আনুগত্য স্বীকার করে মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের নিকট এক পত্র প্রেরণ করেন। অপর পক্ষ তখন শের শাহের বংশধর ও সমর্থকদের ধ্বংসকার্যে ব্যস্ত থাকায় উক্ত উপহারসমূহ গৃহীত হয়; এবং উত্তরে সুলেমান খানের নিকট আস্থাসূচক ও সদিচ্ছামূলক পত্রসহ তাঁকে তাঁর পদে বহাল রেখে এক বাদশাহী ফরমান প্রেরিত হয়।

এরপর বাংলা রাজ্যে সুলেমান খান পন্নী নিজের নামে খোৎবা ও মুদ্রা চালু রেখেছিলেন। তিনি নিজেকে হযরতে-আলা (সর্বপ্রধান) রূপে অভিহিত করতেন। তবে কৌশলে মাঝে মাঝে মুঘল বাদশাহ আকবরের আনুগত্যের চিহ্নস্বরূপ উপহার প্রেরণ করতেন। প্রায় ষোল বছর এভাবে সালতানাত পরিচালনা করার পর ৯৮১ হিজরীতে তার মৃত্যু হয়। সুলেমান খান পন্নীর পর তাঁর পুত্র বায়াজীদ খান পন্নী বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। একমাস অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই, অন্য সূত্রে এক বছর ছয় মাস শাসন করার পর হাঁসো নামক এক আফগানি কূটকৌশল অবলম্বন করে বায়াজীদ খান পন্নীকে হত্যা করে। আড়াই দিন পর সুলেমান খান পন্নীর ছোট ছেলে দাউদ খান পন্নী হাঁসোকে হত্যা করে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ঐতিহাসিক বিচারে এই দাউদ খান পন্নীই বাংলার ইতিহাসে সর্বশেষ স্বাধীন শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি ক্ষমতার আসনে আসীন হয়েই বাংলার সমস্ত অঞ্চল বশীভূত করে নিজের নামে খোতবা ও মুদ্রা প্রচলন করেন। তার লোক লস্কর ও সৈন্য সংখ্যা ছিলো প্রচুর। ৪০,০০০ সুসজ্জিত অশ্বারোহী সৈন্য, ৩৩০০ হস্তী, ১,৪০,০০০ পদাতিক সৈন্য এবং এর মধ্যে বন্দুকধারী, গোলন্দাজ, তীরন্দাজ প্রভৃতি সকল শ্রেণির সৈন্যই ছিল। ২০,০০০ আগ্নেয়াস্ত্র- এর অধিকাংশই ছিল প্রাচীর ধ্বংসকারী কামান, বহু সশস্ত্র নৌযান ও যুদ্ধের অন্যান্য সরঞ্জামও মওজুদ ছিলো। এমতবস্থায় তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সীমান্তে গোলযোগ সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে আকবরের আদেশ অনুযায়ী তাকে দমন করার জন্য ‘খান-ই-খানান’ উপাধিধারী মুনিম খান- দাউদ খান পন্নীর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠায়। দাউদ খান তার প্রধান আমীর লোদী খান আফগানকে অগ্রগামী করে মুঘল সৈন্যদের বিরুদ্ধে পাঠান। পরবর্তীতে সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি একটার পর একটা দীর্ঘকালীন লড়াইয়ের সূচনা করেন। সর্বশেষ দাউদ খান পন্নীকে দমন করতে বাদশাহ আকবর স্বয়ং নিজে ময়দানে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে দাউদ খান বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে বাহিনী খুইয়ে বাদশাহের সাথে সন্ধিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য হন। বাংলার মসনদে নবাব হিসেবে আসীন হন ‘খান-ই-খানান’ মুনিম খান। অল্পদিন পর তিনি খারাপ আবহাওয়ার কারণে ৯৮৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করলে দাউদ খান পন্নী আবার আফগানদের সহযোগিতায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পুনরায় মুঘল বাদশাহ আকবর হোসেন কুলী খান তুর্কমানকে খানজাহান উপাধি দিয়ে বাংলায় প্রেরণ করেন। বেধে যায় আবার যুদ্ধ। দীর্ঘ এই যুদ্ধে দাউদ খান পন্নী পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলে সৈন্যরা তাকে ধরে খানজাহানের কাছে হাজির করে। দাউদ খানকে গোলমাল ও বিদ্রোহের উৎস গণ্য করে খানজাহান (হোসেন কুলী বেগ) তাঁকে হত্যা করলেন। ঐতিহাসিকরা এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, ‘মুঘল সেনাপতি খানজাহানের বীরধর্মের সম্পূর্ণ অভাব লক্ষ্য না করে পারা যায় না। তার অব্যবহিত পূর্বসূরী খান-ই-খানানের এক চতুর্থাংশ বীরধর্মবোধ যদি এর থাকতো, তাহলে তিনি এরূপ হিংস্র ও কাপুরুষোচিত নৃশংসতা করতে পারতেন না। দাউদ খানের মত যোগ্য ও বীর প্রতিদ্বন্দ্বীর এতদপেক্ষা মহৎ ব্যবহার প্রাপ্য ছিলো। খানজাহানের প্রভু মহান আকবর এই প্রকার দুষ্কার্যের প্রতিরোধের ব্যবস্থা আগে থেকে না করায় তার স্মৃতিও কলঙ্কিত হয়।’

দাউদ খানের পরাজয় এবং হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই মূলত: বাংলার শাসন ক্ষমতা থেকে ‘স্বাধীন’ শাসকের অবসান ঘটে। সুতরাং ১৭৫৭ সালের ২৩ ই জুন নবাব সিরাজ উদ দৌলা নন, ১৫৭৬ সনের ১২ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান পন্নীর অবসানের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। এরপর শুধু পন্নী বংশই নয়, কোন শাসকই আর স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে সক্ষম হন নি। পন্নী রাজবংশের পরাজয়ের পর বারো ভূঁইয়াখ্যাত পন্নীদের অনুগত দৃঢ়চেতা কমান্ডার ও জমিদারগণ দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারকে অস্বীকার করে আঞ্চলিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে অবশ্য এক সময় তারাও মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। মুঘলদের অধীনস্ত নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতনের পর ধীরে ধীরে শাসন ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যায়।

উল্লেখ্য, সুলতান দাউদ খান কররানী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে খানজাহানের হাতে নিহত হওয়াকে দিল্লির সম্রাট ভালো চোখে দেখেন নি। তিনি এই বীরের প্রতি যথোচিত সম্মানজনক ব্যবহার না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পরে তিনি এর জন্য দায় স্বীকার করে এজন্য অনুতপ্ত হন এবং পন্নী বংশের পরবর্তী সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। বাদশাহের আনুকূল্যে পরবর্তী পন্নীগণ বাংলাসহ অনেক এলাকায় শাসনকার্য পরিচালনা করেন।

এখানে বলা আবশ্যক যে, কররানী বা পন্নী এবং মোঘল-এই দুইটি রাজশক্তিই ছিলো দাবিদার মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত। তারা দুনিয়ার আর সব রাজা বাদশাহদের মত বাদশাহীতেই লিপ্ত ছিলেন। মুসলিম দাবিদার উভয় শক্তির লড়াই ছিল সত্যিকার অর্থে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। তারা সত্যিকার মুমিন এবং উম্মতে মোহাম্মদী না হোলেও তাদের রাজ্য পরিচালনা করতেন স্রষ্টার দেওয়া আইনেই। কিন্তু অন্যসব বিকৃতির মতই তারাও ভোগ বিলাস ও বাদশাহীতে নিমগ্ন হয়ে নিজেদের মধ্যে ঐক্য নষ্ট করে, সংঘাতে লিপ্ত হয়ে, দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে আল্লাহর প্রতিশ্র“ত সাবধানবাণী মোতাবেক স্বাধীনতা হারায় এবং ভিনদেশি দুর্বল ও ক্ষুদ্র শক্তিসম্পন্ন ব্রিটিশদের গোলামে পরিণত হয়। জাতির কপালে জোটে দীর্ঘ দুশো বছরের বিদেশি শক্তির গোলামি। এই গোলামি খাটার পর আপাতত মুক্তি পেলেও আজও তারা স্বেচ্ছায় ইহুদি খ্রিস্টান বস্তুবাদী সভ্যতাকে প্রভুর আসনে বসিয়ে তাদের আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি সবকিছু পালন করে স্বপ্রণোদিত দাস হয়ে আছে।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Highlights

কাউনিয়ায় অরক্ষিত ১১ রেল ক্রসিং এখন মরন ফাঁদ

Avatar photo

Published

on


কাউনিয়া প্রতিনিধি, রংপুরঃ
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় ব্রিটিশ আমলের কাউনিয়া রেল জংশন ষ্টেশনটি উত্তর জনপদের একটি অন্যতম রেল যোগাযোগের মাধ্যম। জনপ্রিয় এ রেল পথে উত্তরের ২ জেলা কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটসহ রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মানুষ রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের নানা জায়গায় যাতায়াত করে। প্রতিদিন ঐতিহ্যবাহী কাউনিয়া রেল জংশন ষ্টেশন দিয়ে ১২টি আন্তঃনগর ট্রেন মিলে ২৪টি ট্রেন যাতায়াত করছে।

নিরাপদ রেল ভ্রমনের এ ট্রেন যাতায়াতের সড়কে ১১টি রেল ক্রসিং এখন মরন ফাঁদ। রেল ক্রসিং গুলোর রাস্তা দিয়ে দিন-রাত বিভিন্ন যানবাহন, মানুষ ও গবাদী পশু চলাচল করলেও রেল ক্রসিং গুলোতে নেই রেল কর্তৃপক্ষের কোন পাহারাদার বা গেটম্যান তাই হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা আর প্রাণহানী।

ইতোমধ্যে রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে উপজেলার থানা রেল ক্রসিং, তকিপল হাট রেলগেট, গের্দ্দ বালাপাড়া রেল ক্রসিং, খোপাতী তপসীডাঙ্গা রেল ক্রসিং, পাঞ্জরভাঙ্গা রেল ক্রসিং, শহীদবাগ রেল ক্রসিং, বুদ্ধির বাজার বাধের রাস্তা রেল ক্রসিং, মহেশা রেল ঘুন্টি, মৌল রেল ক্রসিং, বল্লভবিষু রেল ক্রসিংয়ে।

এ সব রেল ক্রসিং এখন মানুষ ও গবাদী পশুর মরন ফাঁদে পরিনত হয়েছে। অথচ এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ নিরব। এ সংক্রান্ত কাউনিয়া উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় অনেক আলোচনা-সিদ্ধান্ত হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সভার সিদ্ধান্তের কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে, কিন্তু পাওয়া যায়নি এখনো কোন ভাল ফল।

কাউনিয়া রেল জংশন ষ্টেশন মাস্টার আব্দুর রশীদ জানান, প্রয়োজনীয় ৪২ জন জনবলের বিপরীতে চুক্তিভিত্তিকসহ ২৬ জন দায়িত্ব পালন করছে। এ বিষয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি। এলাকাবাসী বলছেন, এক অফিস থেকে আরেক অফিসে জানাজানি চলবে আর কতদিন? তবে কী এভাবেই চলবে একের পর এক দুর্ঘটনা আর প্রানহানী!

Continue Reading

Highlights

বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা

Avatar photo

Published

on

শেখ হাসিনা:

৭ই জুন ৬ দফা দিবস হিসেবে আমরা পালন করি। ২০২০ সাল বাঙালির জীবনে এক অনন্য বছর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণের জন্য এ বছরটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাঙালিরাও প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ইউনেস্কো এ দিবসটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলিও প্রস্তুতি নিয়েছিল। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে।

যখন এমন ব্যাপক আয়োজন চলছে, তখনই বিশ্বব্যাপী এক মহামারী দেখা দিল। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নামক এক সংক্রামক ব্যাধি বিশ্ববাসীকে এমনভাবে সংক্রমিত করছে যে, বিশ্বের প্রায় সকল দেশই এর দ্বারা আক্রান্ত এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক– সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও এ ভাইরাস থেকে মুক্ত নয়। এমতাবস্থায়, আমরা জনস্বার্থে সকল কার্যক্রম বিশেষ করে যেখানে জনসমাগম হতে পারে, সে ধরনের কর্মসূচি বাতিল করে দিয়ে কেবল রেডিও, টেলিভিশন বা ডিজিটাল মাধ্যমে কর্মসূচি পালন করছি।

১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা ঘোষণা দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, শ্রদ্ধা জানাই আমার মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে। ৭ই জুনের কর্মসূচি সফল করতে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্মরণ করি, ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টে শাহাদাৎবরণকারী আমার পরিবারের সদস্যদের। শ্রদ্ধা জানাই জাতীয় চার নেতাকে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও নির্যাতিত মা-বোনকে।

ছয় দফা দাবির আত্মপ্রকাশ

১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের সভাপতিত্বে বিরোধীদলের সম্মেলন শুরু হয়। সাবজেক্ট কমিটির এই সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাব গৃহীত হয় না। পূর্ব বাংলার ফরিদ আহমদও প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।

৬ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি পত্রিকা এ দাবি সম্পর্কে উল্লেখ করে বলে যে, পাকিস্তানের দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন করার জন্যই ৬-দফা দাবি আনা হয়েছে। ১০ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাংবাদিক সম্মেলন করে এর জবাব দেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। বিমান বন্দরেই তিনি সাংবাদিকদের সামনে ৬-দফা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেন।

৬-দফা দাবিতে পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রদেশকে স্বায়ত্বশাসন দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দল এ দাবি গ্রহণ বা আলোচনা করতেও রাজি হয়নি। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন ঢাকায়।

আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিতে ৬-দফা দাবি পাশ করা হয়। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এ দাবি গ্রহণ করা হয়। ব্যাপকভাবে এ দাবি প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় দলের নেতৃবৃন্দ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান সফর করে জনগণের কাছে এ দাবি তুলে ধরবেন। ৬-দফা দাবির ওপর বঙ্গবন্ধুর লেখা একটি পুস্তিকা দলের সাধারণ সম্পাদকের নামে প্রকাশ করা হয়। লিফলেট, প্যাম্ফলেট, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমেও এ দাবিনামা জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়।

কেন ছয় দফা দাবি

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল সে যুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গ বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এ অঞ্চলের সুরক্ষার কোন গুরুত্বই ছিল না। ভারতের দয়ার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল পূর্ব বাংলাকে। ভারত সে সময় যদি পূর্ববঙ্গে ব্যাপক আক্রমণ চালাত, তাহলে ১২শ মাইল দূর থেকে পাকিস্তান কোনভাবেই এ অঞ্চলকে রক্ষা করতে পারত না। অপরদিকে তখনকার যুদ্ধের চিত্র যদি পর্যালোচনা করি, তাহলে আমরা দেখি পাকিস্তানের লাহোর পর্যন্ত ভারত দখল করে নিত যদি না বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকেরা সাহসের সঙ্গে ভারতের সামরিক আক্রমণের মোকাবেলা করত।

পূর্ব পাকিস্তানে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর কোন শক্তিশালী ঘাঁটি কখনও গড়ে তোলা হয়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশনের একটা হেড কোয়ার্টার ছিল খুবই দুর্বল অবস্থায়। আর সামরিক বাহিনীতে বাঙালির অস্তিত্ব ছিল খুবই সীমিত। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ডন পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বাঙালিদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছিল।

অর্থাৎ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে সর্বোচ্চ পদে তা-ও লে. কর্নেল পদে মাত্র ২ জন বাঙালি অফিসার ছিলেন। অথচ যুদ্ধের সময় বাঙালি সৈনিকেরাই সব থেকে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন।

ঐ যুদ্ধের পর তাসখন্দে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা তাসখন্দ চুক্তি নামে পরিচিত। সেখানেও পূর্ববঙ্গের স্বার্থের বা নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়।

একটু পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখি যে, বাঙালির বিরুদ্ধে সব সময় পাকিস্তানের শাসক চক্র বৈমাত্রীয়সুলভ আচরণ করেছে।

প্রথম আঘাত হানে বাংলা ভাষা যা আমাদের মাতৃভাষার ওপর। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত শুরু করে। রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করে বাঙালিরা। সে ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে। মূলত তখন থেকেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে হবে।

বাঙালিরা সব সময়ই পশ্চিমাদের থেকে শিক্ষা-দীক্ষা, সাংস্কৃতিক চর্চায় সমৃদ্ধ ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা ছিল এ অঞ্চলের মানুষের। জনসংখ্যার দিক থেকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি। ৫৬ ভাগ মানুষের বসবাস ছিল পূর্ববঙ্গে।

পূর্ববঙ্গের উপার্জিত অর্থ কেড়ে নিয়ে গড়ে তোলে পশ্চিম পাকিস্তান। বাঙালিদের উপর অত্যাচার করাই ছিল শাসকদের একমাত্র কাজ। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্যান্য দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে জয়লাভ করে। মুসলীম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কিন্তু ৯২ক ধারা অর্থাৎ ইমার্জেন্সি জারি করে নির্বাচিত সরকার বাতিল করে দেয়। পূর্ববঙ্গে চালু করে কেন্দ্রীয় শাসন। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যখন ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখনও ষড়যন্ত্র থেমে থাকে না। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে। এভাবেই বার বার আঘাত আসে বাঙালিদের উপর।

ছয় দফার প্রতি জনসমর্থন

আইয়ুব খানের নির্যাতন-নিপীড়নের পটভূমিতে যখন ৬-দফা পেশ করা হয়, অতি দ্রুত এর প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমার মনে হয় পৃথিবীতে এ এক বিরল ঘটনা। কোন দাবির প্রতি এত দ্রুত জনসমর্থন পাওয়ার ইতিহাস আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমগ্র পূর্ব বাংলা সফর শুরু করেন। তিনি যে জেলায় জনসভা করতেন সেখানেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হত, গ্রেপ্তার করা হত। জামিন পেয়ে আবার অন্য জেলায় সভা করতেন। এভাবে পরপর ৮ বার গ্রেপ্তার হন মাত্র দুই মাসের মধ্যে। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জে জনসভা শেষে ঢাকায় ফিরে আসার পর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ৯ই মে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করে। একের পর এক মামলা দিতে থাকে।

একইসঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা শুরু হয়। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ছাত্রনেতা, শ্রমিক নেতাসহ অগণিত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে মামলা দায়ের করে।

১৯৬৬ সালের ১৩ই মে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ দিবস পালন উপলক্ষে জনসভা করে। জনসভায় জনতা ছয় দফার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। ৩০-এ মে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির (ওয়ার্কিং কমিটি) সভা হয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী। ৭ই জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয় এবং হরতাল সফল করার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের অনেক সভা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির বাড়িতে অনুষ্ঠিত হত।

৭ই জুনের হরতালকে সফল করতে আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্র নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে তিনি দিক-নির্দেশনা দেন। শ্রমিক নেতা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ধরনের সহযোগিতা করেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের দমনপীড়ন-গ্রেপ্তার সমানতালে বাড়তে থাকে। এর প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষ এক্যবদ্ধ হয়। ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব বাংলার সকল স্তরের মানুষ – রিক্সাওয়ালা, স্কুটারওয়ালা, কলকারখানার শ্রমিক, বাস-ট্রাক-বেবিটেক্সি চালক, ভ্যান চালক, দোকানদার, মুটে-মজুর – সকলে এ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।

পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান যে কোন উপায়ে এই আন্দোলন দমন করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেয় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে।

কিন্তু তাদের শত নির্যাতন উপেক্ষা করে বাংলাদেশের মানুষ ৭ই জুনের হরতাল পালন করে ৬ দফার প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়ে দেন। পাকিস্তান সরকার উপযুক্ত জবাব পায়। দুঃখের বিষয় হল বিনা উস্কানিতে জনতার উপর পুলিশ গুলি চালায়। শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ ১১ জন নিহত হন। আন্দোলন দমন করতে নির্যাতনের মাত্রা যত বাড়তে থাকে, সাধারণ মানুষ ততবেশি আন্দোলনে সামিল হতে থাকেন।

৭ই জুন হরতাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন: ‘‘১২ টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে। জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছেন। তাঁরা ৬-দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়। বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়, শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, কৃষকদের বাঁচার দাবি তাঁরা চায়, এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল” (কারাগারের রোজনামচা পৃ: ৬৯)।

১৯৬৬ সালের ১০ ও ১১ই জুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভায় হরতাল পালনের মাধ্যমে ছয় দফার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করায় ছাত্র-শ্রমিক ও সাধারণ জনগণকে ধন্যবাদ জানানো হয়। পূর্ববঙ্গের মানুষ যে স্বায়ত্বশাসন চায়, তারই প্রমাণ এই হরতালের সফলতা। এ জন্য সভায় সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। ১৭, ১৮ ও ১৯-এ জুন নির্যাতন- নিপীড়ন প্রতিরোধ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীর বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলন এবং তিন দিন সকলে কালো ব্যাচ পড়বে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। হরতালে নিহতদের পরিবারগুলিকে আর্থিক সাহায্য এবং আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য একটা তহবিল গঠন এবং মামলা পরিচালনা ও জামিনের জন্য আওয়ামী লীগের আইনজীবীদের সমন্বয়ে একটি আইনগত সহায়তা কমিটি গঠন করা হয়। দলের তহবিল থেকে সব ধরনের খরচ বহন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আন্দোলনের সকল কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন আরও ব্যাপকভাবে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সভা, সমাবেশ, প্রতিবাদ মিছিল, প্রচারপত্র বিলিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই দাবির প্রতি ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু হয়।

এদিকে সরকারি নির্যাতনও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে যত বেশি নির্যাতন আইয়ুব-মোনায়েম গং-রা চালাতে থাকে, জনগণ তত বেশি তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সকল নিপীড়ন উপেক্ষা করে আরও সংগঠিত হতে থাকেন।

১৯৬৬ সালের ২৩ ও ২৪-এ জুলাই আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং আন্দোলন দ্বিতীয় ধাপে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ আন্দোলন কেন্দ্র থেকে জেলা, মহকুমা ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, তীব্রতর হতে থাকে।

সরকারও নির্যাতনের মাত্রা বাড়াতে থাকে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্তদের একের পর এক গ্রেপ্তার করতে থাকে। অবশেষে একমাত্র মহিলা সম্পাদিকা অবশিষ্ট ছিলেন। আমার মা সিদ্ধান্ত দিলেন তাঁকেই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হোক। আওয়ামী লীগ সে পদক্ষেপ নেয়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

পাকিস্তান সরকার নতুন চক্রান্ত শুরু করল। ১৯৬৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে নিয়ে যায়। অত্যন্ত গোপনে রাতের অন্ধকারে সেনাবাহিনীর দ্বারা এ কাজ করানো হয়। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেওয়া হয়, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে অধিক পরিচিতি পায়।

এই মামলায় ১-নম্বর আসামি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সঙ্গে আরও ৩৪ জন সামরিক ও অসামরিক অফিসার ও ব্যক্তিদের আসামি করে।

অপরদিকে ছয় দফা দাবি নস্যাৎ করতে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু নেতা দিয়ে ৮-দফা নামে আরেকটি দাবি উত্থাপন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। তবে এতে তেমন কাজ হয় না। উঁচুস্তরের কিছু নেতা বিভ্রান্ত হলেও ছাত্র-জনতা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রতিই ঐক্যবদ্ধ থাকেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা অর্থাৎ রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান মামলার মূল অভিযোগ ছিল যে, আসামিরা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বক্তব্য ছিল: ‘আমরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ, সংখ্যাগুরু। আমরা বিচ্ছিন্ন হব কেন? আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই, স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। যারা সংখ্যালগিষ্ঠ, তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা নয়।’

এই মামলা দেওয়ার ফলে আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। বাংলার মানুষের মনে স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ও চেতনা শাণিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়। ছাত্ররা ৬-দফাসহ ১১-দফা দাবি উত্থাপন করে আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জেলা, মহকুমায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

ক্যান্টনমেন্টের ভিতরেই কোর্ট বসিয়ে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা শুরু হয়। অপরদিকে জেল, জুলুম, গুলি, ছাত্র হত্যা, শিক্ষক হত্যাসহ নানা নিপীড়ন ও দমন চালাতে থাকে আইয়ুব সরকার।

পাকিস্তানি সরকারের পুলিশী নির্যাতন, নিপীড়ন ও দমনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করে। তাঁরা রাস্তায় নেমে আসে। সরকারপন্থী সংবাদপত্র থেকে শুরু করে থানা, ব্যাংক, সরকারের প্রশাসনিক দপ্তরে পর্যন্ত হামলা চালাতে শুরু করে। সমগ্র বাংলাদেশ তখন অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়।

‘আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করো, জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’– এ ধরনের শ্লোগানে শ্লোগানে স্কুলের ছাত্ররাও রাস্তায় নেমে আসে। এরই এক পর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি এই মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে বন্দিখানায় হত্যা করা হয়। মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাঁদের আশঙ্কা হয় এভাবে শেখ মুজিবকেও হত্যা করবে। সাধারণ মানুষ ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়। জনতা মামলার বিচারক প্রধান বিচারপতির বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান।

প্রচণ্ড গণআন্দোলনের মুখে ২১-এ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ২২-এ ফেব্রুয়ারি দুপুরে একটা সামরিক জিপে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ধানমন্ডির বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে। অন্য বন্দিদেরও মুক্তি দেয়।

ভাষা আন্দোলন-স্বায়ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতা: ছয় দফার সফলতা

গণআন্দোলনে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে। ক্ষমতা দখল করে সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান। ছয় দফার ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

১৯৭০ সালের ৫ই ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দেন পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’।

কিন্তু বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।

অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। ২৫-এ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২৬-এ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ৯-মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা পায়, পায় জাতিরাষ্ট্র স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ।

Continue Reading

Highlights

কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে হেযবুত তওহীদের নানামুখী উদ্যোগ

Avatar photo

Published

on

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বেকারত্ব একটি অভিশাপ। হেযবুত তওহীদের অন্যতম নীতি হচ্ছে এর কর্মক্ষম সদস্যরা কেউ বেকার থাকতে পারবে না, প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ যোগ্যতা মোতাবেক উপার্জন করবে।
.
আল্লাহর রসুল বলেছেন, “হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, জীবিকা হাসিল করার জন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করো এবং তোমাদের প্রচেষ্টার পরিপূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, কোনো মো’মেনের সত্তাকে দুনিয়ায় বেকার এবং অনর্থক সৃষ্টি করা হয় নি। বরং তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কর্ম ও কর্তব্যের সঙ্গে সংযুক্ত। কর্ম ও প্রচেষ্টার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অল্পে সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার অর্থ এ নয় যে, হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা এবং নিজের বোঝা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। নিশ্চয়ই আল্লাহর উপর ভরসা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু জীবিকা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা নিতান্তই জরুরি বিষয়। আমি তোমাদেরকে অবহিত করছি যে, দুনিয়ায় যত নবী-রসুল এসেছেন তাদের সবাই রেযেক হাসিলের জন্য চেষ্টা- সাধনা করতেন এবং নিজেদের বোঝা অন্যের উপর চাপিয়ে দিতেন না। অতএব তোমরাও রুজি হাসিলের জন্য প্রচেষ্টা করো। শ্রমিক-মজুরের কাজ করা এবং লাকড়ির বোঝা নিজের মাথায় উঠানো অন্যের কাছে ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে উত্তম। যার জীবিকা উপার্জনের সামর্থ্য রয়েছে অন্যের কাছে হাত পাতা তার জন্য খুবই অসম্মানজনক। সে দুনিয়াতেও লাঞ্ছিত এবং শেষ বিচারের দিনও তাকে এমন অবস্থায় হাজির করা হবে যে তার চেহারায় গোশত থাকবে না। আমি পরিষ্কারভাবে তোমাদের বলছি, যার কাছে একদিনের খাদ্যও মজুদ রয়েছে তার জন্য অন্যের কাছে হাত পাতা অবশ্যই হারাম।”
.
এমামুযযামান জমিদার পরিবারের বড় ছেলে হয়েও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার সময় তিনি আন্দোলনের নেতার নির্দেশে কলকাতার রাস্তায় কমলার ব্যবসা করেছেন। তরুণ বয়সে বিভিন্ন প্রকারের ব্যবসা করেছেন। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক। এন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিয়মিত রোগী দেখে গেছেন। হেযবুত তওহীদের সদস্যরা আন্দোলনের কাজে অধিক সময় ব্যয় করা সত্ত্বেও যেন একে অপরের সহযোগিতাক্রমে ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন-জীবিকা চালিয়ে যেতে পারেন, আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করতে পারেন সেজন্য প্রয়োজন পড়ে একটি সুন্দর পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থা। এই পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য আন্দোলনের প্রতিটি কমিটিতে একজন কর্মসংস্থান সম্পাদক থাকবেন।

Continue Reading