বিশেষ নিবন্ধ
রাজমহল থেকে পলাশী : দু’টি ঐতিহাসিক ভুল
২৩ জুন, ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। ঐতিহাসিকভাবে দাবি করা হয় এই দিনেই বাংলার আকাশ থেকে প্রায় দুইশ বছরের জন্য স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর অনেক আগেই অর্থাৎ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শেষ স্বাধীন শাসকদের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা হারায়। ঐতিহাসিকদের নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে বাংলার শেষ স্বাধীন শাসক হিসেবে চিহ্নিত করাটা এক ধরনের ব্যর্থতা বলেই প্রতীয়মান হয়। আজকের আলোচ্য নিবন্ধে আমরা সে বিষয়টিই তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।
বাংলার ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের অবদান অনস্বীকার্য। ভারতীয় ঐতিহাসিক ছাড়াও ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীগণ মুসলিম বীরদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পান। কিন্তু যদি আমরা যুক্তির নিরিখে বিচার করি তাহলে তাদেরকে কোনভাবেই বিদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি না। বিদেশি হিসেবে একমাত্র তারাই গণ্য হবে যারা বাইরে থেকে এই উপমহাদেশে এসে লুটপাটের মাধ্যমে ধন-সম্পদ অর্জন করে নিজেদের দেশে পাঠিয়েছে এবং এক সময় নিজেরাও নিজেদের দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু যারা নিজেদের আত্মীয়-পরিজন নিয়ে এদেশে স্থায়ীভাবে চলে আসেন এবং এ দেশের মাটিও মানুষের সাথে মিশে গিয়ে এই দেশ গড়ার পেছনে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন তাহলে আমরা তাদেরকে কি করে বিদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি? এই যুক্তির নিরিখে বরং ইউরোপীয়ানদেরকে আমরা বিদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। কেননা তারা এদেশের বুকে এসে শাসন-শোষণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করে দুইশত বছর পরে এদেশ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু মুসলিমদের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই তারা সুদূর আফগানিস্তান, তুর্কিস্থানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে এদেশে এসে এদেশের মাটি ও মানুষকে আপন করে নিয়ে আবার এদেশের মাটির সাথে মিশে গিয়েছেন।
মুসলিমদের এদেশের বুকে আসার পেছনে নিছক দেশ জয় করাই উদ্দেশ্য ছিলো না। এর সাথে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করাও ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু কালক্রমে যখন তারা সে উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে শুধুমাত্র দেশ জয়ের মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে তখন তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে প্রকৃত মুমিনের সংজ্ঞা (সুরা হুজারাত-১৫) থেকে বের হয়ে যান। ফলশ্র“তিতে তারা ধীরে ধীরে পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে গোলামিতে নিমজ্জিত হয়। বলা আবশ্যক- আল্লাহর ঘোষণা মোতাবেক মুসলিম জাতি কখনো পরাজিত হতে পারে না। কারণ তিনি পবিত্র কোর’আনে মুমিনদেরকে দুনিয়ার কর্তৃত্ব ও শাসনক্ষমতা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন (সুরা নূর ৫৫)। তিনি বলেছেন, মুমিনদের সঙ্গে যুদ্ধে কাফেররা কখনও বিজয়ী হবে না (সুরা ফাতাহ ২৩), মুমিনরাই সর্বদা বিজয়ী হবে (সুরা এমরান ১৩৯), আল্লাহ নিজে মুমিনদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন (সুরা আনফাল ১৭), তিনি স্বয়ং মুমিনদের অভিভাবক (বাকারা ১৫২), মুমিনদেরকে সাহায্য করা তাঁর কর্তব্য (সুরা রূম ৪৭)। তার মানে পলাশীর যুদ্ধে ‘মুসলিম’ বাহিনীর পরাজিত হওয়ার অর্থ হলো তখন আর এই জাতি প্রকৃত মুমিন ছিল না। এ ব্যাপারে রসুলাল্লাহর ভবিষদ্বাণী ছিলো এই যে তিনি বলেছেন, “আমার উম্মাহর আয়ু ৬০/৭০ বছর।” অর্থাৎ রসুলাল্লাহর (সঃ) এন্তেকালের পর এই জাতি জাতি হিসেবে ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত তার আরদ্ধ কাজ চালিয়ে যাবে। কী কাজ? এই প্রশ্নের জবাবে এখানে কিছু কথা না বললেই নয়। তাঁর কাজ সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে কি দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন।
রসুলাল্লাহর উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব ছিল সমস্ত বাতিল দ্বীন বা জীবনব্যবস্থাগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে দীনুল ইসলামকে সমস্ত পৃথিবীর ওপর প্রতিষ্ঠা করা (সুরা ফাতাহ: ২৮, সুরা সফ: ৯, সুরা তওবা: ৩৩)। সমস্ত পৃথিবীতে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আল্লাহর শেষ রসুল (সঃ) একটি জাতি বা উম্মাহ গঠন করলেন যারা উম্মতে মোহাম্মদী নামে পরিচিত ছিলেন। রসুল (সঃ) এর এই জাতিটিকে একটি জাতি না বলে সামরিক বাহিনী বলাটাই যথার্থ হয়। উম্মতে মোহাম্মদীর সঠিক আকিদার মধ্যে যে জাতীয় চরিত্র আল্লাহর রসুল (সঃ) গেঁথে দিয়েছিলেন তা হচ্ছে World Oriented বা দুনিয়া অভিমূখী। রসুলাল্লাহ (সঃ) এর এন্তেকালের পর পর তাঁর হাতে গড়া চরম দরিদ্র, অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা সেই উম্মতে মোহাম্মদী একটা একটা করে নয়, একসাথে সামরিকভাবে আক্রমণ করে তদানীন্তন পৃথিবীর দুই দুইটি বিশ্বশক্তি, একদিকে অগ্নি-উপাসক পারস্য ও অন্যদিকে খ্রিস্টান রোমান সাম্রাজ্যকে পরাজিত ও ছিন্নভিন্ন করে অর্ধ-পৃথিবীতে এক নতুন আদর্শ, নতুন সভ্যতার জন্ম দিলেন, অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্ধ-পৃথিবীর শাসক এবং সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়ে গেল। এভাবে সঠিক আকিদা নিয়ে উম্মতে মোহাম্মদী জাতি হিসেবে মোটামুটি প্রায় ১০০ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবজাতিকে শান্তি দেয়ার জন্য সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন। কিন্তু এরপর ঘোটল এক সাংঘাতিক ঘটনা। জাতির আকিদার মধ্যে ভিন্নতা প্রবেশ করল। ৬০/৭০ বছর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এ জাতির উমাইয়া, আব্বাসীয়া, ফাতেমীয়, এবং উসমানীয় খলিফা নামধারী শাসকগণ পৃথিবীর অন্যান্য রাজা-বাদশাহদের মত রাজা- বাদশাহী আরম্ভ করলো। উম্মতে মোহাম্মদী বিশ্বশক্তির অন্যতম পারস্য শক্তি পরাজয়ের পর যেটাকে আমরা ইরান বলি, সেই ইরানি জাতিটি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে গিয়েছিলো। তারপর মুসলিম জাতি যখন ভারতে প্রবেশ করে, এখানেও তারা বাদশাহী করা আরম্ভ করলো। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে মুসলিম শাসকেরা বাংলায় রাজতন্ত্রের সূচনা করেন।
এই সময়ে, অর্থাৎ খ্রিস্টিয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে এই উপমহাদেশের দুর্বল মোঘল সম্রাট এবং বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মোঘলদের নিযুক্ত সুবেদারগণ অর্থাৎ নবাবদের দেশ পরিচালনার ব্যর্থতা, সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ভোগবিলাস এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে উপমহাদেশে বাণিজ্য করতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি সামরিকভাবে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে শুরু করে। নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর তার প্রিয় দৌহিত্র সিরাজ উদ দৌলা চরম প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব হিসেবে মসনদে অধিষ্ঠিত হন। সিরাজ-উদ-দৌলা সিংহাসনে বসার পর থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে তাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে ছিলেন ঘষেটি বেগম, রাজা রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণবল্লভ, মানিক চাঁদ, আমির চাঁদ, আমির বেগ, খাদেম হোসেন, ইয়ার লতিফ খান, ওয়াটস, নবকুমার, এবং প্রধান সেনাপতি মীরজাফর। সেই সময়ে বেশকিছু হিন্দু সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জমিদাররা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে অপসারণ করতে ষড়যন্ত্রকারীদের মদদ দেয়। এক পর্যায়ে ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে হাত মেলায় এবং মীরজাফরকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব বানাতে কাশিমবাজার কুঠিতে মীরজাফর-ক্লাইভের মধ্যে এক গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই গোপন চুক্তির ধারাবাহিকতায় আসে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। সেই যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভসহ কতিপয় কুচক্রী মহলের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে নবাব সিরাজের নেতৃত্বাধীন ৫৭ হাজার বাহিনী ক্লাইভের ৩ হাজার বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইংরেজদের হাতে। ১৭৫৭ সালের ২ জুলাই বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে জাফরগঞ্জের এক কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় মোহাম্মদী বেগ তার নাঙা তলোয়ার দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে সিরাজের দেহ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। রক্তস্রোতের উপর লুটিয়ে পড়েন বাংলার শেষ ‘মুসলিম’ শাসক নবাব সিরাজ উদ দৌলা। মীরজাফর পুতুল নবাব হন। পলাশীর বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় কালক্রমে ইউরোপের খ্রিস্টানরা সামরিক শক্তি বলে এই পাক-ভারত উপমহাদেশসহ সমস্ত মুসলিম ভূখণ্ড পদানত করে।
এখানে ইতিহাসে একটি ভুল করা হয়। তা এই যে, বলা হয়ে থাকে ২৩ শে জুন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে সংঘঠিত লড়াইয়ে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীন শাসক নবাব সিরাজ উদ দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এখানেই ঐতিহাসিকগণ ভুল করেছেন। কারণ, এই নবাব বংশীয় শাসকগণ কখনোই এই এলাকার স্বাধীন শাসক ছিলেন না। তারা ছিলেন দিল্লির মুঘল সম্রাটদের নায়েব, অর্থাৎ প্রতিনিধি। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক জনাব হায়দার আলী চৌধুরী রচিত ‘পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ’ নামক ইতিহাস গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন, “স্বাধীন নবাব বলে যে কথাটি প্রচলিত তা ঐতিহাসিক সত্য নয়! স্বাধীন নবাব কথাটি নাট্যকারদের লেখা। কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। নবাব কোনদিন স্বাধীন হয় না (পৃষ্ঠা: ৭৭)”। তাঁর এই কথা অত্যন্ত যৌক্তিক, কারণ নবাব শব্দটি আরবি নায়েবের অন্যতম রূপ। আর নায়েব মানেই শাসকের প্রতিনিধি। সিরাজ উদ দৌলা ছিলেন মোগল শাসকদের অধীনস্থ সুবেদার। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে বাংলার শাসনে সর্বশেষ স্বাধীন শাসনকর্তা সিরাজ উদ দৌলা নন। সিরাজ উদ দৌলাসহ তার পূর্বসূরী নবাব আলীবর্দী খানগণ সবাই ছিলেন তৎকালীন দিল্লির মসনদে আসীন মুঘল সম্রাটদের অনুগত প্রতিনিধি। প্রকৃতপক্ষে বাংলার স্বাধীন শাসক এবং স্বাধীনতা গত হয় আরো অনেক আগে। অনুসন্ধিৎসু পাঠককে সত্যিকার ইতিহাস জানতে ফিরে যেতে হবে আরো পেছনে।
মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন দাউদ খান পন্নী। পন্নী বংশীয় শাসনামলকে অনেক ইতিহাস বইতে কররানী আমল নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। মূলত, আফগানিস্তানের কাররান অঞ্চলের অধিবাসী হওয়ায় তাদেরকে কাররানী বলা হতো, তবে সত্যিকার অর্থে তাদের বংশের নাম ছিল পন্নী। দিল্লির কেন্দ্রীয় সিংহাসনে শক্তিমান শাসক মোঘলগণ আসীন থাকায় সে সময়ে বাংলায় কোন শাসক স্বাধীন ছিলেন না। যারাই শাসন কাজ পরিচালনা করতেন, করতেন দিল্লির বাদশাহর অনুগত্য স্বীকার করেই। এরা ইতিহাসে নবাব হিসেবে পরিচিত। এদের প্রায় সবাই আত্মীয়তাসূত্রে দিল্লির বাদশাহদের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত ছিলেন।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত গোলাম হোসায়ন সলীম এর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘রিয়াজুস সালাতিন’ গ্রন্থে বর্ণিত এই রাজবংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলো, ৯৭১ হিজরীতে (১৫৬৩ খ্রিঃ) নিজ ভাইকে হত্যা করে মসনদ দখল করে ক্ষমতা লাভ করা অবৈধ শাসক গিয়াস উদ্দিনকে দমন করার জন্য দক্ষিণ বিহারের গভর্ণর সুলায়মান খান পন্নী তাঁর জেষ্ঠ্য ভ্রাতা তাজ খান পন্নীকে গৌড়ে প্রেরণ করেন। গিয়াস উদ্দিনকে হত্যা করে তাজ খান পন্নী তার ভ্রাতা সুলায়মান পন্নীর পক্ষে বাংলার গভর্নররূপে ৯৭১ থেকে ৯৭২ হিজরী (১৫৬৪-৬৫খ্রিঃ) পর্যন্ত শাসন কার্য পরিচালনা করেন। ৯৭২ হিজরীতে তার মৃত্যু হয়। তাজখানের মৃত্যুর পর সুলেমান খান নিজেকে বাংলা ও বিহারের সম্পূর্ণ স্বাধীন সুলতানরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। খারাপ আবহাওয়ার জন্য তিনি গৌড় ত্যাগ করে টান্ডা শহরে রাজধানী স্থাপন করেন। ৯৭৫ হিজরীতে তিনি উড়িষ্যা জয় করেন এবং তথায় একজন গভর্নরের অধীনে স্থায়ীভাবে এক বৃহৎ সৈন্যবাহিনী রেখে কুচবিহার জয়ের জন্য যাত্রা করেন। কুচবিহারের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ অধিকার করার পর তিনি সংবাদ পান যে, উড়িষ্যায় বিদ্রোহীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রয়োজনবশত: তিনি কুচবিহার শহরের অবরোধ তুলে রাজধানী টান্ডায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেই সময় এইভাবে কিছুকাল সমগ্র হিন্দুস্থানে গোলমাল আরম্ভ হয়েছিল। বাদশাহ হুমায়ূন যখন পারস্য থেকে হিন্দুস্থানে ফিরে আসেন, তখন সুলেমান খান পন্নী দূরদর্শিতাবশত: (কৌশলে) উপহারসহ আনুগত্য স্বীকার করে মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের নিকট এক পত্র প্রেরণ করেন। অপর পক্ষ তখন শের শাহের বংশধর ও সমর্থকদের ধ্বংসকার্যে ব্যস্ত থাকায় উক্ত উপহারসমূহ গৃহীত হয়; এবং উত্তরে সুলেমান খানের নিকট আস্থাসূচক ও সদিচ্ছামূলক পত্রসহ তাঁকে তাঁর পদে বহাল রেখে এক বাদশাহী ফরমান প্রেরিত হয়।
এরপর বাংলা রাজ্যে সুলেমান খান পন্নী নিজের নামে খোৎবা ও মুদ্রা চালু রেখেছিলেন। তিনি নিজেকে হযরতে-আলা (সর্বপ্রধান) রূপে অভিহিত করতেন। তবে কৌশলে মাঝে মাঝে মুঘল বাদশাহ আকবরের আনুগত্যের চিহ্নস্বরূপ উপহার প্রেরণ করতেন। প্রায় ষোল বছর এভাবে সালতানাত পরিচালনা করার পর ৯৮১ হিজরীতে তার মৃত্যু হয়। সুলেমান খান পন্নীর পর তাঁর পুত্র বায়াজীদ খান পন্নী বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। একমাস অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই, অন্য সূত্রে এক বছর ছয় মাস শাসন করার পর হাঁসো নামক এক আফগানি কূটকৌশল অবলম্বন করে বায়াজীদ খান পন্নীকে হত্যা করে। আড়াই দিন পর সুলেমান খান পন্নীর ছোট ছেলে দাউদ খান পন্নী হাঁসোকে হত্যা করে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ঐতিহাসিক বিচারে এই দাউদ খান পন্নীই বাংলার ইতিহাসে সর্বশেষ স্বাধীন শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি ক্ষমতার আসনে আসীন হয়েই বাংলার সমস্ত অঞ্চল বশীভূত করে নিজের নামে খোতবা ও মুদ্রা প্রচলন করেন। তার লোক লস্কর ও সৈন্য সংখ্যা ছিলো প্রচুর। ৪০,০০০ সুসজ্জিত অশ্বারোহী সৈন্য, ৩৩০০ হস্তী, ১,৪০,০০০ পদাতিক সৈন্য এবং এর মধ্যে বন্দুকধারী, গোলন্দাজ, তীরন্দাজ প্রভৃতি সকল শ্রেণির সৈন্যই ছিল। ২০,০০০ আগ্নেয়াস্ত্র- এর অধিকাংশই ছিল প্রাচীর ধ্বংসকারী কামান, বহু সশস্ত্র নৌযান ও যুদ্ধের অন্যান্য সরঞ্জামও মওজুদ ছিলো। এমতবস্থায় তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সীমান্তে গোলযোগ সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে আকবরের আদেশ অনুযায়ী তাকে দমন করার জন্য ‘খান-ই-খানান’ উপাধিধারী মুনিম খান- দাউদ খান পন্নীর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠায়। দাউদ খান তার প্রধান আমীর লোদী খান আফগানকে অগ্রগামী করে মুঘল সৈন্যদের বিরুদ্ধে পাঠান। পরবর্তীতে সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি একটার পর একটা দীর্ঘকালীন লড়াইয়ের সূচনা করেন। সর্বশেষ দাউদ খান পন্নীকে দমন করতে বাদশাহ আকবর স্বয়ং নিজে ময়দানে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে দাউদ খান বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে বাহিনী খুইয়ে বাদশাহের সাথে সন্ধিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য হন। বাংলার মসনদে নবাব হিসেবে আসীন হন ‘খান-ই-খানান’ মুনিম খান। অল্পদিন পর তিনি খারাপ আবহাওয়ার কারণে ৯৮৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করলে দাউদ খান পন্নী আবার আফগানদের সহযোগিতায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পুনরায় মুঘল বাদশাহ আকবর হোসেন কুলী খান তুর্কমানকে খানজাহান উপাধি দিয়ে বাংলায় প্রেরণ করেন। বেধে যায় আবার যুদ্ধ। দীর্ঘ এই যুদ্ধে দাউদ খান পন্নী পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলে সৈন্যরা তাকে ধরে খানজাহানের কাছে হাজির করে। দাউদ খানকে গোলমাল ও বিদ্রোহের উৎস গণ্য করে খানজাহান (হোসেন কুলী বেগ) তাঁকে হত্যা করলেন। ঐতিহাসিকরা এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, ‘মুঘল সেনাপতি খানজাহানের বীরধর্মের সম্পূর্ণ অভাব লক্ষ্য না করে পারা যায় না। তার অব্যবহিত পূর্বসূরী খান-ই-খানানের এক চতুর্থাংশ বীরধর্মবোধ যদি এর থাকতো, তাহলে তিনি এরূপ হিংস্র ও কাপুরুষোচিত নৃশংসতা করতে পারতেন না। দাউদ খানের মত যোগ্য ও বীর প্রতিদ্বন্দ্বীর এতদপেক্ষা মহৎ ব্যবহার প্রাপ্য ছিলো। খানজাহানের প্রভু মহান আকবর এই প্রকার দুষ্কার্যের প্রতিরোধের ব্যবস্থা আগে থেকে না করায় তার স্মৃতিও কলঙ্কিত হয়।’
দাউদ খানের পরাজয় এবং হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই মূলত: বাংলার শাসন ক্ষমতা থেকে ‘স্বাধীন’ শাসকের অবসান ঘটে। সুতরাং ১৭৫৭ সালের ২৩ ই জুন নবাব সিরাজ উদ দৌলা নন, ১৫৭৬ সনের ১২ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান পন্নীর অবসানের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। এরপর শুধু পন্নী বংশই নয়, কোন শাসকই আর স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে সক্ষম হন নি। পন্নী রাজবংশের পরাজয়ের পর বারো ভূঁইয়াখ্যাত পন্নীদের অনুগত দৃঢ়চেতা কমান্ডার ও জমিদারগণ দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারকে অস্বীকার করে আঞ্চলিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে অবশ্য এক সময় তারাও মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। মুঘলদের অধীনস্ত নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতনের পর ধীরে ধীরে শাসন ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যায়।
উল্লেখ্য, সুলতান দাউদ খান কররানী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে খানজাহানের হাতে নিহত হওয়াকে দিল্লির সম্রাট ভালো চোখে দেখেন নি। তিনি এই বীরের প্রতি যথোচিত সম্মানজনক ব্যবহার না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পরে তিনি এর জন্য দায় স্বীকার করে এজন্য অনুতপ্ত হন এবং পন্নী বংশের পরবর্তী সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। বাদশাহের আনুকূল্যে পরবর্তী পন্নীগণ বাংলাসহ অনেক এলাকায় শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
এখানে বলা আবশ্যক যে, কররানী বা পন্নী এবং মোঘল-এই দুইটি রাজশক্তিই ছিলো দাবিদার মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত। তারা দুনিয়ার আর সব রাজা বাদশাহদের মত বাদশাহীতেই লিপ্ত ছিলেন। মুসলিম দাবিদার উভয় শক্তির লড়াই ছিল সত্যিকার অর্থে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। তারা সত্যিকার মুমিন এবং উম্মতে মোহাম্মদী না হোলেও তাদের রাজ্য পরিচালনা করতেন স্রষ্টার দেওয়া আইনেই। কিন্তু অন্যসব বিকৃতির মতই তারাও ভোগ বিলাস ও বাদশাহীতে নিমগ্ন হয়ে নিজেদের মধ্যে ঐক্য নষ্ট করে, সংঘাতে লিপ্ত হয়ে, দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে আল্লাহর প্রতিশ্র“ত সাবধানবাণী মোতাবেক স্বাধীনতা হারায় এবং ভিনদেশি দুর্বল ও ক্ষুদ্র শক্তিসম্পন্ন ব্রিটিশদের গোলামে পরিণত হয়। জাতির কপালে জোটে দীর্ঘ দুশো বছরের বিদেশি শক্তির গোলামি। এই গোলামি খাটার পর আপাতত মুক্তি পেলেও আজও তারা স্বেচ্ছায় ইহুদি খ্রিস্টান বস্তুবাদী সভ্যতাকে প্রভুর আসনে বসিয়ে তাদের আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি সবকিছু পালন করে স্বপ্রণোদিত দাস হয়ে আছে।
Highlights
কাউনিয়ায় অরক্ষিত ১১ রেল ক্রসিং এখন মরন ফাঁদ
Highlights
বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা
Highlights
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে হেযবুত তওহীদের নানামুখী উদ্যোগ
-
আন্তর্জাতিক9 years ago
গ্রিস প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণা
-
আন্তর্জাতিক9 years ago
যুক্তরাষ্ট্রে দুটি বিমানের সংঘর্ষে ৪ জনের মৃত্যু
-
স্বাস্থ্য8 years ago
গলা ব্যথার কারণ ও চিকিৎসা
-
দেশজুড়ে9 years ago
আজ চন্দ্র গ্রহন সন্ধা ৬টা ১২ মিনিট থেকে রাত ৮ টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত
-
বিবিধ10 years ago
আর অটো রিক্সা নয় এবার অবিশ্বাস্য কম দামের গাড়ি!
-
জাতীয়8 years ago
আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ
-
জাতীয়9 years ago
স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা
-
ফিচার9 years ago
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার নামকরণের ইতিহাস