শান্তি অথবা গণতন্ত্র আমরা কোনটা চাই?
এস এম সামসুল হুদা:
স্বাধীনতা পরবর্তী গত ৪৩ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মুখনিঃসৃত সর্বাধিক শব্দ সম্ভবত গণতন্ত্র। রাজনৈতিক জনসভার বক্তৃতায়, মিটিং-মিছিলে, সেমিনার বা টকশোতে গণতন্ত্রের জয়গানের শেষ নেই। চলমান গণতন্ত্র আমাদেরকে মিথ্যাচার, অন্যায়, অবিচার, অশান্তি ছাড়া কিছু দিতে না পারলেও বিজ্ঞাপনের জোরে এর প্রতি আমাদের ভালোবাসা এতটাই যে, আমাদের মনমগজ-চিন্তাধারা সবই আজ গণতান্ত্রিক। সাধারণ মানুষ রাজনীতি আর গণতন্ত্র বলতে বোঝেন ক্ষমতায় গিয়ে স্বার্থ হাসিলের বিশেষ কৌশল। এর বেশি তারা বোঝেন না। গত ৪৩ বছর ধরে রাজনীতির নামে সাধারণ মানুষের উপর যে কশাঘাত করা হচ্ছে তার দ্বারা আমাদের সবার পিঠ রক্তাক্ত। তবু প্রচলিত গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। এর কারণ আমরা মনে করছি এই চাবুক গণতন্ত্রের নয়। গণতন্ত্র আসলে ভালো, আমাদেরকে পেটাচ্ছে অগণতান্ত্রিক শক্তি। আসলে এ ধারণা ভুল। এই আঘাত গণতন্ত্রেরই কশাঘাত, এর বেশি আর কিছু আমাদের প্রাপ্য নয়। যতদিন আমরা স্বার্থবাদীদেরছেলেভোলানো মন্ত্রে ভুলে থাকবো, ততদিন এই চাবুকপেটা খেয়ে যেতে হবে। যে তন্ত্র দুর্নীতিগ্রস্ত, সন্ত্রাসী, চোর-ডাকাতদের হাতে নেতৃত্ব দেয়, যে তন্ত্র গরীবের রক্ত শুষে নিয়ে ধনীরা ব্যাংকে অর্থের পাহাড় গড়ে তোলে, যে তন্ত্র, রাজনীতিক প্রতিহিংসার জন্ম দেয় যার বলি হয় নিরীহ, নিরপরাধ জনগণ, খেটে খাওয়া মানুষ, নিষ্পাপ শিশু, সেই গণতন্ত্রকেই আমরাই আদরে লালন করি, ভোট দিয়ে তার গোড়ায় পানি সিঞ্চন করি। আমরা বুঝি না যে, এ বৃক্ষ বিষবৃক্ষ, এর বিষফল আমাকেই খেতে হবে। সাধারণ জনগণ অর্থাৎ ভোটাররা যদি বুঝতেন দেশে দুই দিন পর পর যে এই যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়, জীবন্ত ভোটারকে রোস্ট করা হয়, মানুষের সহায়-সম্পদ-জীবনের সকল অবলম্বনকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয় এটাই গণতন্ত্রের মূর্তিমান রূপ। এই সত্য তাদেরকে বুঝতে দেওয়া হয় না, কারণ তারা বুঝে গেলে ভোটবাক্স যে খালি পড়ে থাকবে। আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্রের নামে যে ভালো ভালো কথাগুলো লেখা আছে, সেগুলোর আশায় মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দিন গুনে গুনে পরলোকে যাত্রা করছে, কিন্তু সেই কল্পরাজ্য, গণতন্ত্রের ইউটোপিয়া সংবিধানের পাতা থেকে আর বস্তুজগতে মূর্তিমান হচ্ছে না।
একাত্তরের পর থেকে আজ অবধি গণতন্ত্রকে যদি আমরা পরীক্ষামূলক রাজনীতিক মতবাদ হিসেবে ধরি দেখব এর সামগ্রিক ফলাফল অনেকগুলো শূন্য, সুস্থ চিন্তাসম্পন্ন জাতির কাছে এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকতে পারে না। এই তন্ত্র টিকে আছে কেবলই ষোল কোটি মানুষের অনৈক্যের উপর ভিত্তি করে এবং তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প না থাকার দরুন। তাই আমরা গণতন্ত্রের উপরই আস্থা রাখতে চাই, মার খাওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে আমরা বাঙালিরা জন্মেছি। আমরাদের পূর্বপুরুষ মার খেয়ে অভ্যস্ত ছিলেন, তারা মার খেতেন বিদেশি শাসকদের, আমরা মার খাই আমাদের ভোটে নির্বাচিত শাসকদের। কোনটা উত্তম তা মহাকালই বিবেচনা করবেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আমরা সেই একাত্তর থেকে আজ অবধি প্রতিনিয়ত ঢেলে যাচ্ছি বুকের রক্ত। দেশ গড়ার দিকে আমাদের নেতাদের নজর নেই, ডাস্টবিনে কুকুর যেমন আবর্জনার দখল নিয়ে কামড়া কামড়ি করে, আমাদের ভদ্র, সুশীল, সুবেশি রাজনীতিকরা তেমনটাই করেন জাতির সম্পদ লুটে খাওয়ার জন্য। তাদের স্বার্থের লড়াইয়ে ককটেল-পেট্রল বোমায় ঝলসিয়ে যাচ্ছি নিজেদেরকে, তবু আমরা এই অন্যায় তন্ত্রের বিরুদ্ধে এক হতে পারি না, কেবল কেঁদে যাই। আমাদের কান্না দেখার কেউ নেই। আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা ভোটার।
গণতন্ত্র আমরা পেয়েছি মূলত ব্রিটিশদের হাত ধরে। তারা দুইশ’ বছরের শাসন-শোষণ চালিয়ে যখন উপমহাদেশ ছেড়ে আমাদেরকে আপাত স্বাধীনতা দিয়ে চলে গেল, তখন চাপিয়ে দিয়ে গেল গণতন্ত্র নামের এই সোনার পাথরবাটি। আজ ব্রিটিশপরবর্তী অর্ধশত বছরের বেশি সময় পেরিয়ে এসেও আমরা সেই সোনার পাথরবাটির স্বরূপ অনুধাবন করতে পারি নি। গণতন্ত্রের একটাই সুবিধা, এর চর্চায় মানুষ বাক্যবাগিশ হতে পারে, যে বাক্যগুলোকে ফাঁকাবুলি বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। বলা হয়ে থাকে- গণতন্ত্র এমন একটি পদ্ধতি যেখানে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকেন যারা জনগণের বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অভিমত প্রকাশের অধিকারকে রক্ষণাবেক্ষণ করেন । গণতন্ত্র হলো একটি সর্বসাধারণের দ্বারা পরিচালিত সরকার পদ্ধতি । এই ব্যবস্থার অধীনে শাসকগণ নির্বাচিত হয়ে জনগণের ইচ্ছা অনুসারে দেশ শাসন করেন। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, ‘যে ব্যবস্থায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি তা কুলীনতন্ত্র এবং যেখানে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিতহয়েছে তা গণতন্ত্র।’ কল্পবিলাসী সাম্যবাদের পতনের পর গণতন্ত্রের এইসব তাত্ত্বিক বুলিই পৃথিবীব্যাপী এর বিস্তারে অবদান রেখেছে। এসব মনোলোভা এবং আকর্ষণীয় কথা-বার্তায় আমাদেরকে মোহিত করে রাখা হচ্ছে। কেউ যদিওবা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখ খোলে তার মুখ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বলা হয়, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকরূপ পায় নি, গণতন্ত্র এদেশে এখনো শিশুকাল পেরোয় নি ইত্যাদি। আসলে আমরা ভাবছি, পশ্চিমারা যে আজ এত চাকচিক্যের মধ্যে বাস করছে, এটা বুঝি গণতন্ত্রের ফল। আসলে তা নয়। তারা দীর্ঘ দিন প্রায় সারা বিশ্বটাকে উপনিবেশ বানিয়ে তাদের সম্পদ লুটপাট করে নিজেদের দেশকে উন্নত করেছে। আসলে তারাও সুখে নেই। তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ অপরাধ অর্থাৎ খুনো-খুনি, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ, আত্মহত্যা ইত্যাদি সামাজিক
অপরাধের পরিসংখ্যান দেখলে আমরা দেখতে পাব যে পাশ্চাত্যের সমাজকে যতটা সুখী মনে করা হয় মোটেও তারা ততটা সুখী নয়। প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মাঝেও রয়েছে বিরাট আর্থিক বৈষম্য। টিভিতে যেটা দেখা যায় সেটাই সব নয়, আরো আছে অনেক কিছুই।
পশ্চিমা গণতন্ত্রকে প্রাচ্যে বড় করতে গিয়ে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো:
ক) জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি:
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বহুদল ও বহুমতের নামে জাতি বিনাশী অনৈক্যর জন্ম দেয়া। গণতান্ত্রিক ভাষায় বলা হয়ে থাকে- যে দেশে যত বেশি রাজনৈতিক দল থাকে সেই দেশের গণতন্ত্র তত বেশি পরিপক্ক। বাস্তবতায় বহুদল ও বহুমতের পরিণাম হচ্ছে অনৈক্য, বিভেদ ও অশান্তি। একটি জাতির উন্নতির প্রথম সূত্রই হলো ঐক্য। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বুনিয়াদিভাবেই গণতন্ত্র অনৈক্যের সকল উপাদান বিলিয়ে যায়। গণতান্ত্রিক ধারায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি তার বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনসমূহকেও বৈধতা প্রদান করে। এর সূত্র ধরে দলের ভেতর সৃষ্টি হয় আরো উপদলের। স্বাভাবিক ফলাফল দলের মধ্যে অন্তর্কোন্দল, হানাহানি, ক্ষমতা ও পদ দখলের লড়াই। অর্থাৎ গণতন্ত্র একই মত ও পথে বিশ্বাসীদেরকেও এক সূত্রে আবদ্ধ হতে দিতে চায় না। তারা বিপক্ষ শক্তির চেয়ে নিজের দলের দ্বারাই বেশি আক্রান্ত, হতাহত হয়।
খ) বিরোধী মতের বৈধতাদানকারী গণতন্ত্র:
গণতান্ত্রিক সিস্টেম রাষ্ট পরিচালনায় বিরোধী দলের অস্তিত্বকে অত্যাবশ্যক বলে জ্ঞান করে থাকেন প্রায় সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং এতদসংক্রান্ত গবেষকগণ। তাদের মতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী দল দুটি স্বতন্ত্র উপাদান। তারা একটিঅপরটির পরিপূরক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়, তারা সরকার গঠন করে। যারা কম আসন পায়, তারা থাকে বিরোধী দলে। এই দু’য়ের স্বতন্ত্র ভূমিকা শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করে। এ কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। সরকারের অযৌক্তিক কাজে বিরোধী দল বাধা প্রদান করে সরকারের স্বৈরাচারী আচরণকে বাধাগ্রস্ত করে। কিন্তু বাস্তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দেখা যায় সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র।
আমাদের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, শুধুমাত্র বিরোধিতা করার খাতিরেই বিরোধী দল যতদিন বিরোধী দলে থাকে ততদিন সরকারের ভালো-মন্দ সকল কর্মকাণ্ডের একচেটিয়া বিরোধিতা করে যায়। এমনও দেখা যায় বাজেট ঘোষণার আগেই বিরোধীদল বাজেটের বিরুদ্ধে কর্মসূচি গ্রহণ করে ফেলে, এমনকি বিকল্প বাজেটও তৈরি করে। সরকারের এমন একটি সিদ্ধান্তও থাকে না যার বাস্তবায়নের পথে বিরোধী দল বিরোধিতা করে না। ফলে সরকারি দল আর বিরোধী দলের মাঝে সব সময়ই থাকে দা-কুমড়া সম্পর্ক। সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও- পোড়াও, ভাঙচুর ইত্যাদি করে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে বিরোধী দল। অপরদিকে সরকারি দলের পক্ষ থেকেও বিরোধীদলের উপর চলে দমন-পীড়নের স্টিম রোলার। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে-সরকারি দল আর বিরোধী দলের লড়াইয়ে জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে।
গ) নেতা নির্বাচনে ভুল পদ্ধতি:
একটি পুকুরে যদি বড় বড় ফাঁকা বিশিষ্ট একটি জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়, তাহলে সেই জালে কোনো ছোটমাছ ধরা পড়বে না, ধরা পড়বে কেবল বড় মাছগুলি। ছোট মাছ ধরার বেলায় জালের ফাঁকাগুলি হতে হয় খুব ছোট, যেমন কারেন্ট জাল। সুতরাং কোন ধরনের মাছ আমি ধরব তার উপরে নির্ভর করবে আমার জাল কেমন হবে, অর্থাৎ এই জাল হচ্ছে মাছ ধরার একটি ঝুংঃবস. বর্তমানে গণতন্ত্রে যে পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচন করা হয় সেটি হচ্ছে বড় ফাঁকাবিশিষ্ট একটি জালের মতো, অর্থাৎ বড় বড় রুই কাতলারাই এতে উঠে আসবে। সমাজে যারা প্রভাবশালী, বিত্তবান, পেশীশক্তিতে বলীয়ান তারাই এখন সমাজের রুই কাতলা। পক্ষান্তরে যারা চরিত্রবান, ভালো মানুষ, ওয়াদা রক্ষাকারী, ভদ্র, কারও ক্ষতি করে না তারা বর্তমানের সমাজে বোকা হিসাবে চিহ্নিত, তারা গুরুত্বহীন, সর্বত্র অবদমিত। এই দুই ধরনের মানুষের সমন্বয়েই সমাজ। এই সমাজে প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে কেমন লোক নির্বাচিত হবে সেটা দেখা যাক।
প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে প্রথমে একজন টাকা দিয়ে মনোনয়ন পত্র কিনে প্রার্থী হয়, নিজের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপায়, নিজের গুণগান নিজেই প্রচার করে, মিছিল করে, ব্যানার টানায়, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়, মানুষকে তার পক্ষে নেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন দেখায়, প্রয়োজনে বহু হিংসাত্মক কাজে জড়িত হয় যেমন প্রতিপক্ষকে খুন করা, বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি।গ্রাম্য মেম্বার থেকে শুরু করে যে কোনো পর্যায়ের নির্বাচনেই এসব ঘটনা ঘটে থাকে। এটাই নেতা নির্বাচনের বর্তমান সিস্টেম, সারা দুনিয়াতে এই সিস্টেম প্রায় একই রকম, কোথাও সহিংসতা কম, কোথাও বেশি। এখন ধরুন একজন সৎ মানুষ আছেন যিনি বিত্তবান নন, নিজস্ব কোনো লাঠিয়াল বাহিনী নেই, পেছনে প্রভাবশালী গোষ্ঠির মদদ নেই
তিনি নির্বাচনে দাঁড়ালেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বড়ই দুঃশ্চরিত্রের অধিকারী, নীতিহীন এবং অনেক টাকার মালিক। এখন এই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কার? সহজ উত্তর: এই দ্বিতীয় লোকটাই বিজয়ী হবে। এভাবে প্রতিটি পর্যায় থেকে খারাপ লোকগুলি বিজয়ী হতে হতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসে। সুতরাং বড় ফাঁক বিশিষ্ট জাল দিয়ে যেমন সব ছোট মাছ বেরিয়ে যায় এবং বড় মাছগুলি রয়ে যায়, তেমনি নির্বাচনের বর্তমান পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ, অসৎ চরিত্রের মানুষটিই বিজয়ী হয়ে নেতার আসনে উপবিষ্ট হন। এখন নেতারা সমাজ সেবার কাজ যা কিছু করে সব প্রশংসার জন্য। আজকে নেতারা জনগণের দেয়া করের টাকায় কোথাও একটা ব্রিজ তৈরি করে দেয়, একটা ছেলেকে যদি বৃত্তি, একজন বৃদ্ধকে কিছু টাকা দেয় সেটা নিয়েও তাদের প্রচারণার কোনো শেষ থাকে না, সব অবদানের সঙ্গে নিজের নামটি অবধারিতভাবে জুড়ে দেয়। টিভি ক্যামেরা না আসলে ত্রাণ দেওয়া বন্ধ থাকে। এটাও না যে, যারা এই পদ্ধতিতে নেতা নির্বাচিত হন তাদের ১০০% ই খারাপ লোক, কিছু কিছুসচ্চরিত্র লোকও এ পদ্ধতির জালে উঠে আসেন তবে তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। আর আসলেও তারা বেশিদিন তাদের চরিত্র বজায় রাখতে পারেন না; System টাই এমনভাবে তৈরি যে, কেউ ভালো থাকতে চাইলেও ভালো থাকতে পারেন না, বিরুদ্ধ স্রোতে বেশিদিন নৌকা বাইতে পারেন না।
ঘ) গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন:
গণতন্ত্র ক্ষমতাসীন সরকারের অনৈতিক ও অযৌক্তিক আচরণের প্রতিবাদে বিরোধী দলকে বিভিন্ন কর্মসূচির অধিকার প্রদান করে। এসব কর্মকাণ্ড প্রায় সময়ই দেখা যায় সহিংসতার রূপ নেয়। বিরোধীদল কতটা শক্তিশালী তা বিচার করা হয় সহিংসতায় তারা কতটা সিদ্ধহস্ত তার উপর। এই অধিকার বলেতারা বছরের বিশেষ একটা সময় ধরে হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও- পোড়াও, বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করায়।
ঙ) ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন:
সরকারি দল ও বিরোধী দলের এই সংঘাত ও মানি না মানবো না এসব দাবি এবং বিরোধী দল রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে, সহিংসতা ঘটিয়ে প্রায়ই সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামায়। বিরোধী দল সরকারে গেলে সরকারি দল আবার বিরোধী দলে গিয়ে ঐ একই কাজ করে। উভয়ের এই লড়াইয়ে কোনো সরকারই নিশ্চিন্তে দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে পারে না। আবার উভয় পরে হানাহানিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে সামরিকবাহিনী বাধ্য হয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এভাবে ক্ষমতার কামড়া-কামড়ির সুযোগে বিশ্ব মোড়লগণ তাদের আধিপত্য বিস্তার করে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়।
চ) গণতন্ত্রের সার্বিক ফলাফল:
আধুনিক পৃথিবীতে একদিকে চলছে গণতন্ত্রের জয়-জয়কার, আর অপরদিকে চলছে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, গুম-খুনের মহোৎসব। পরিসংখ্যান খুললেই দেখা যাবে- গণতন্ত্র পালনকারীরা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অন্যায়-অবিচার, অশান্তিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। শুধু গণতন্ত্রই নয়, এই একই রকম ফল সবক’টি মানবসৃষ্ট জীবনব্যবস্থাতেই। এক সময় মানুষ রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র পরিবর্তনের জন্য জীবন দিয়ে গণতন্ত্র এনেছে আর এখন তাতেও সন্তুষ্টি অর্জন করতে না পেরে ভিন্ন পথ খুঁজছে। কিন্তু একের পর এক জীবনব্যবস্থা সৃষ্টি ও প্রয়োগের ফলে মানুষ আজ কান্ত-শ্রান্ত আস্থা হারানো দিশেহারা পথিক। এটাই ছিল তাদের শেষ ভরসা, সামনেও আর কিছু নেই। ধর্মগুলোতো কবেই পঁচে গেছে। তাই গণতন্ত্রের ব্যর্থতায় অজান্তেই নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে গণতন্ত্রকে আজও প্রতিষ্ঠা করতে পারলাম না। অপরদিকে গণতন্ত্রের ফুটো দিন দিন এত বড় হয়ে উঠছে যে, তা আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না, বোঝা যাচ্ছে মানুষ হাজার ইচ্ছে করেও আর বেশিদিন এরই ব্যবস্থা ধরে রাখতে পারবে না, শিশুকালেই গণতন্ত্রের আয়ু শেষ। এক সময় অন্যান্য জীবনব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে সংগ্রাম করেছে, এবার গণতন্ত্র থেকে বের হওয়ার জন্য সে সংগ্রাম করবে।
তারচেয়ে বড় কথা হলো, সবাই আজ শান্তি চাই, সত্যিকারের শান্তি। আমরা যদি সত্যিই শান্তি পেতে চাই প্রথমত আমাদেরকে গণতন্ত্রের প্রতি অন্ধবিশ্বাস দূর করতে হবে। কোনো অন্ধবিশ্বাসই ভালো নয়, সকল অন্ধবিশ্বাসই মৌলবাদ। আল্লাহ বলেছেন, “বস্তুত চক্ষুতো অন্ধ হয় না, কিন্তু বক্ষস্থিত অন্তরই অন্ধ হয় (সুরা ত্বা-হা ৪৬)। তাই দেখে, শুনে, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরি, সে বিশ্বাস ধর্মের প্রতিই হোক আর গণতন্ত্রের প্রতিই হোক। যা কিছুই অকল্যাণকর, অশান্তির মূল তার থেকে দ্রুত বিশ্বাস প্রত্যাহার করাও সমধিক জরুরি।