বিনম্র শ্রদ্ধায় ভাষা শহীদদের স্মরণ করলো জাতি
নিজস্ব প্রতিবেদক: সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন, অন্যান্য জাতিসত্তার ভাষা ও বর্ণমালা সংরক্ষণের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবির মধ্য দিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভাষা শহীদদের স্মরণ করেছে সমগ্র জাতি।
ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশের প্রথম প্রহরেই হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ফুলে ফুলে ভরে উঠে বাঙালির শোক আর অহংকারের এই মিনার।
রাত ১২ টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার এডভোকেট ফজলে রাবিব মিয়া শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে নিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবুল মাল আব্দুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের ও এডভোকেট সাহারা খাতুন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, মিজবাহ উদ্দিন সিরাজ ও বিএম মোজাম্মেল, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
পরে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ১৪ দল, রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল, তিন বাহিনীর প্রধানেরা, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এর আগে শনিবার মধ্য রাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় উপস্থিত হন।
এসময় হাজার হাজার মানুষ নগ্নপায়ে বুকে শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ লাগিয়ে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারিÑআমি কি ভুলিতে পারি’ গানে কণ্ঠ মিলিয়ে এবং যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে শ্লে¬াগান দিতে দিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যান। একই সাথে তারা সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের এবং অন্যান্য জাতিসত্তার ভাষা ও বর্ণমালা সংরক্ষণের দাবি জানান।
রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, খালেকুজ্জামান ভূইয়ার নেতৃত্বে বাসদ, দিলীপ বড়–য়ার নেতৃত্বে সাম্যবাদী দল, অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খানের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান।
এছাড়াও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও সিনেট সদস্য, সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম, গণফোরাম, আওয়ামী যুব লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, বাংলা একাডেমী, সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় প্রেসক্লাব, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাফর ওয়াজেদ ও সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, সভাপতি শাবান মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরীর নেতৃত্বে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমদের নেতৃত্বে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, শিল্পকলা একাডেমী, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আজিমপুর, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, গণতন্ত্রী পার্টি, সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জমানের নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক সমিতি এবং শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিনিধিরা একুশের প্রথম প্রহরে ভাষা শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
সকালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রভাতফেরী সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে অনেক বিদেশী নাগরিককে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেখা গেছে।
৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ, জারি হয় ১৪৪ ধারা, ভেঙে ফেলা হয় শোষকের শৃঙ্খল। রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। গুলিতে বিদীর্ণ হয় বুক। শহীদ হন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকে। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে ইতিহাস গড়েন তারা। বাংলা পায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। একাত্তরে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গের এই দিনটিকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালে। অমর একুশে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশের চেতনার প্রতীক ‘শহীদ মিনার’ এখন এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ সব কটি মহাদেশের বহুভাষিক চেতনার স্মারক।
মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত পবিত্র কুরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সকালে জাতীয় বায়তুল মোকাররম মসজিদে এ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক এম এম সিরাজুল ইসলাম ও ড. আব্দুস সালামসহ ফাউন্ডেশনের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
বায়তুল মোকাররম মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মহিউদ্দিন কাসেমের পরিচালনায় মোনাজাতে শহীদদের রূহের মাগফিরাত কামনা ছাড়াও দেশ ও মানবতার কল্যাণে দোয়া করা হয়।
মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করে কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলা। রাজধানীর সেগুন বাগিচায় কচি কাঁচা মিলনায়তনে অনুষ্ঠানে দিবসটি উপলক্ষে সুন্দর হাতের লেখা, শুদ্ধ বানান ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিশুদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন প্রধান অতিথি ডা. মোহাম্মদ শফিকুর রহমান।
এদিকে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকর নেতৃত্বে এক প্রভাতফেরী বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শুরু হয়ে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
বাদ জোহর বিশ^বিদ্যালয় মসজিদুল জামিয়া, সকল হলের মসজিদ এবং বিশ^বিদ্যালয় আবাসিক এলাকার মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাত ও শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত/প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রাজধানীর স্কুল-কলেজ ও পাড়া-মহল্লায়ও ছিল নানা আয়োজন। অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সবাই। ভাষার প্রতি ভালোবাসা আর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা। এই শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় বেঁচে থাকবে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা এমনটাই প্রত্যাশা সকলের। এসব আয়োজনে শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত।