Connect with us

বিশেষ নিবন্ধ

শুদ্ধ লিখুন মাতৃভাষা

Published

on

Riyadul-Hassan-225x300@2xরিয়াদুল হাসান
নদীস্রোতের মতো প্রবহমান ভাষাস্রোত- নিয়তই চলে ভাষার রূপ-রূপান্তরের পালা। এই পরিবর্তনের ফলে একদিকে ভাষা যেমন উন্নত হচ্ছে, অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছে নানামাত্রিক সমস্যা। উদ্ভূত সে সকল সমস্যাবলির মধ্যে একটি হচ্ছে ভুল বানানে লেখা, আরেকটি হলো ভাষার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ সমস্যা। বাংলা ভাষার বয়স প্রায় চৌদ্দশ’ বছর। এ দীর্ঘ সময়ে বাংলা ভাষায় সর্বদা সংযুক্ত হয়েছে নতুন নতুন উপাদান। আমাদের ভাষাভা-ারে যুক্ত হয়েছে নানা বিদেশি ভাষা। আরবি, ফারসি, পর্তুগিজ, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা থেকে আমরা গ্রহণ করেছি অনেক শব্দ। বাংলা ভাষায় আছে তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের বিপুল ব্যবহার। দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহারের ফলে একটি অশুদ্ধ শব্দই আপাত শুদ্ধ হয়ে ওঠে, ঢুকে পড়ে অভিধানের শরীরে; কখনো কখনো একটি অপপ্রয়োগ চেতনায় এমনভাবে গেঁথে যায়, তখন শুদ্ধ প্রয়োগটাই অপপ্রয়োগ বলে মনে হয়।
ভাষার ধর্মই হচ্ছে বদলে যাওয়া। বর্তমান আধুনিক যুগে বিভিন্ন বিবর্তনে মানুষের ভূমিকা আগের তুলনায় অনেক বেশি, ভাষার ক্ষেত্রে স¤পূর্ণই। তাই বলে শুদ্ধ বাংলা না শিখে সেই অজ্ঞতাকে আধুনিকতা বলে চালিয়ে দেওয়া একটি অপরাধ, ভাষার বিরুদ্ধে শত্রুতার নামান্তর। আশা করি ভাষাবিদেরা অতটা বিবর্তন প্রশ্রয় দিবেন না, যাতে করে পাঁচশ’ বছর পরে কোনো শিক্ষার্থী বর্তমানের কোনো সাহিত্য/রচনার অর্থ বোঝার জন্য অভিধানের সাহায্য নিয়েও কোনো দিশা খুঁজে পাবে না। যেমন চর্যাপদ পড়তে গেলে বর্তমানের কোনো অভিধানেই কুলোয় না। আধুনিক প্রজন্মের একটি বড় অংশ ‘জটিল, অস্থির, পাঙ্খা’ শব্দগুলিকে ‘চমৎকার, অপূর্ব’ অর্থে ব্যবহার করছে, যার অর্থ অভিধান থেকে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। এমন স্বেচ্ছাচারিতার অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। ভাষা বদলাবেই কিন্তু এ বদলে যাওয়া হবে প্রকৃতির মতো স্বাভাবিক। শিশু হতে বালক, বালক হতে কিশোর, কিশোর হতে তরুণ, তরুণ হতে যুবক, যুবক হতে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় হতে বৃদ্ধ- ঠিক এভাবে। তেমনিভাবে ভাষার পরিবর্তনও হবে প্রাকৃতিকভাবেই, জোর করে পরিবর্তন করলে অপারেশন করে লিঙ্গ পরিবর্তনের মতো করুণ পরিণতি বয়ে আনবে।
জনসংখ্যা বিবেচনায় বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ ভাষা। পঁচিশ কোটি লোক বাংলায় কথা বলে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার কারণে আমাদের দেশে কথ্য ও লেখ্য ভাষা হিসেবে শতকরা প্রায় ৯৫ জনই বাংলা ব্যবহার করে থাকে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নানা পর্যায় অতিক্রম করে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বিজয় লাভের পর মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব ও তাৎপর্যও বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন কিন্তু আমরা সেই ভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য কোনো চেষ্টা করি না। স্কুল কলেজের গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আমরা শুদ্ধ বাংলা বলা ও লেখার যোগ্যতা লাভ করতে পারছি না। ফলে বাংলা ভাষা শুধু একটু আন্তরিকতার অভাবে ক্রমেই চরম বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ বিপর্যয়ের দায় আমরা এড়াতে পারব না। ভুল বানানে লেখা সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন দেখে এখন আর কেউ অবাক হন বলে মনে হয় না। ইদানীং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্লগ, ফেসবুক, অনলাইন নিউজ পোর্টালসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট। অবস্থা দেখে মনে হয়, এসব স্থানে যা খুশি তা লেখাটাই যেন রীতি! কিংবা এ ক্ষেত্রে বানান নিয়ে ভাবার কোনো দরকার নেই। শুধু তাদের কথাই-বা বলি কেন, প্রতিদিন যত পত্রিকা প্রকাশ করা হচ্ছে তার ক’টার মধ্যে শুদ্ধ বাংলা বানান প্রয়োগের চেষ্টা থাকে?
অনেকেই বলে থাকেন, অর্থ বুঝতে পারলেই তো হলো, শুদ্ধি-অশুদ্ধি নিয়ে অত মাথা ঘামানোর কী প্রয়োজন? অবস্থা এতদূর সঙ্গিন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমরা ভুল বাংলা লিখতে লজ্জিত তো হই-ই না, এমনকি কৈফিয়ৎ দিই- বাংলা খুব শক্ত ভাষা। যথাযথ বিনয়ের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, নিজের মাতৃভাষা সম্পর্কে অন্য কোনো জনগোষ্ঠী এত মূঢ়, নির্লজ্জ উক্তি করে বলে আমরা জানি না।
এখানে বলা প্রয়োজন, পৃথিবীতে উন্নত আধুনিক ভাষাগুলোর মধ্যে নিয়মকানুনের দিক থেকে বাংলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিধিবদ্ধ একটি ভাষা; এর বানানবিধি, উচ্চারণের নিয়ম ইংরেজি বা ফরাসির চেয়ে উন্নত। পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষায় কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে বিবেচনায় বাংলা ভাষার সীমাবদ্ধতা বলা যায় অতি নগণ্য। উদাহরণ হিসাবে ইংরেজির সঙ্গে যদি বাংলার তুলনা করি দেখা যাবে, একটি ধ্বনির প্রতিলিপি হিসেবে ইংরেজিতে একটি বর্ণ সৃষ্টি হয় না। যেমন G বর্ণের উচ্চারণ কখনও বর্গীয়-জ, কখনও বা গ। আবার কখনও উচ্চারণই হয় না, যেমন Night, Germ, Gun. পক্ষান্তরে প্রত্যেকটি ধ্বনির জন্য বাংলায় নির্দিষ্ট বর্ণ আছে। ‘ক’ বর্ণের উচ্চারণ সবসময় সর্বত্র অভিন্ন। ইংরেজি বর্ণমালার তৃতীয় অক্ষর সি (C) এর ভিন্নভাবে উচ্চারিত হওয়ার (Cancer, concern) মতো জটিলতা বাংলা ভাষায় নেই। ইংরেজির এ রীতিবিহীন উচ্চারণ-রীতি সংস্কার করে ধ্বনিমূলক পদ্ধতিতে ইংরেজি লেখার পদ্ধতি প্রচলনের জন্য জর্জ বার্নড শ মোটা অঙ্কের অর্থ উইল করে গিয়েছিলেন, অথচ আজও পর্যন্ত ইংরেজ ভাষাবিজ্ঞানীরা এটা করে উঠতে পারেন নি। কিন্তু বাংলা ভাষায় লেখ্য ও কথ্য উভয় ক্ষেত্রেই প্রমিত রীতি নির্ধারণ করা বাংলা একাডেমির পক্ষে সম্ভব হয়েছে। বাংলা বানান শেখার অনেক বই রয়েছে যেগুলি পড়লে খুব সহজেই শুদ্ধভাবে বাংলা লিখা সম্ভব।
যেহেতু শিক্ষাব্যবস্থায় বানান-শিক্ষার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় নি, তাই বানান ভুল পরিহার করার ব্যাপারটি প্রায় পুরোপুরিই ব্যক্তিগত শিক্ষা ও আয়ত্তের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজের ভুল বানানগুলো খেয়াল করে দক্ষতা ও উৎকর্ষ অর্জন করতে হয়। ভাষা শুদ্ধ করে লেখার জন্য দরকার সামান্য আগ্রহ ও একটু মমতা। অনেক ক্ষেত্রে বানান ভুলের কারণ অজ্ঞতা নয়, অসাবধানতা ও অমনোযোগিতা। তাই ভুল পরিহারের জন্য লেখা শেষ করার পর ধীরে-সুস্থে আবার তা পড়ে দেখা উচিত। বানান শুদ্ধ আছে কি না সে স¤পর্কে সন্দেহপ্রবণতা বানান দক্ষতা অর্জনে ভালো কাজ দেয়। কোনো শব্দের বানান নিয়ে সন্দেহ হলে চট করে অভিধানের সঙ্গে তা মিলিয়ে নেয়া প্রয়োজন। সন্দেহ হলেই আলসেমি কিংবা অনুমানের ওপর নির্ভর না করে সঙ্গে সঙ্গে অভিধান দেখে বানান স¤পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এভাবে অভিধান দেখতে দেখতে একসময় বানানে দক্ষ হয়ে ওঠা যাবে।

লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি ও নিবার্হী সম্পাদক, বাংলাদেশেরপত্র ডটকম।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *