বিশেষ নিবন্ধ
রোহিঙ্গা নির্যাতন মুসলিম জাতির করণীয়
আসাদ আলী
আমরা যদি মনে করি রোহিঙ্গা সঙ্গট কেবল রোহিঙ্গাদের একার সমস্যা তাহলে ভুল হবে। মুসলিমদের উপর অকথ্য নির্যাতন কোথায় হচ্ছে না? সারা পৃথিবীতেই হচ্ছে। রাখাইন থেকে কাশ্মীর, জিনজিয়াং থেকে ফিলিস্তিন- সবখানেই জাতিগত পরিচয়ে মুসলিমরা আজ নির্যাতনের শিকার। আজ আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনের মাটি সিক্ত হয়ে আছে মুসলিমদের রক্তে। এই মুহূর্তে বিশ্বে প্রায় ৬ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু, যাদের প্রায় সবাই মুসলিম। রোহিঙ্গা নির্যাতন বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, পৃথিবীময় চলা মুসলিম নির্যাতনেরই অংশমাত্র। সব একই সূত্রে গাঁথা। আসলে বিপদ কেবল রোহিঙ্গাদের নয়, বিপদ আমাদের সবার, বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলিম নামক জনসংখ্যার। সুতরাং আমাদেরকে সমস্যার গোড়ায় প্রবেশ করতে হবে। জানতে হবে কেন এই বিপর্যয়। কোথায় পথ হারিয়েছি আমরা। সমাধান কোন পথে।
বিশ্বের কোথাও মুসলিমদের উপর নির্যাতন হলেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। ঘেরাও, জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়। ফিলিস্তিনে ইজরাইল গণহত্যা চালালে অন্যান্য মুসলিম দেশে ইজরাইলের দূতাবাস ঘেরাও করা হয়। বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে উত্তেজিত মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের জাতীয় সম্পদ নষ্ট করে, নিজেদেরই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ করে হতাহত হয়। এসব করে ধর্মানুভূতির প্রকাশ ঘটানো যায় বটে, প্রতিকার কিন্তু আসে না। আবার দেখা যায় একটি দেশে অন্য ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা মুসলিম সংখ্যালঘুরা হত্যাকা-ের শিকার হলে তার প্রতিশোধস্বরূপ আরেক দেশে উত্তেজিত মুসলিমরা ঐ ধর্মের মানুষের উপর হামলা চালায়। ভারতে মুসলিম নির্যাতিত হলে বাংলাদেশে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয়। মিয়ানমারে মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ নিতে বাংলাদেশের বৌদ্ধ পল্লিতে হামলা হয়। এতে মুসলিমদের কোনো লাভ হয় কি? হয় না, হবার কথাও নয়। এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা আসলে মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতকেই সুসংহত করে।
অনেকে মোনাজাত করেন যেন আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে মুসলিমদের অবস্থা পরিবর্তন করে দেন। অথচ আল্লাহ কোর’আনে বলেই দিয়েছেন- আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে (রাদ ১১)। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে ইজরাইল যখন ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর নির্যাতন শুরু করল, তখন থেকেই সারা পৃথিবীর মুসলমানরা ওয়াজ-মাহফিল-ঈদগাহে নিয়মিত মোনাজাত করে আসছে যে, হে আল্লাহ! ইজরাইলকে তুমি ধ্বংস করে দাও। এসব দোয়া-মোনাজাত যে আল্লাহর দরবারে কবুল হয় নি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যত মোনাজাত করেছি ইজরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটির আয়তন ততই বেড়েছে। উল্টো ফল হচ্ছে কারণ এসব প্রচেষ্টাহীন দো’য়া।
একইভাবে আমেরিকা যখন ইরাকে হামলা করল লাখ লাখ মানুষ সাদ্দামের বিজয়ের জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছিল। এই দোয়া-মোনাজাতেও কাজ হয় নি। তারপর গত এক যুগের মধ্যে একে একে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে চোখের সামনে জ্বলতে দেখেছি আমরা। লাখ লাখ মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। মাইলের পর মাইল গ্রাম উজার করা হয়েছে। শহর-বন্দর ধ্বংস করে মরুর বালুর সাথে একাকার করে ফেলা হয়েছে। লাখ লাখ মুসলিম নারীর ইজ্জত হরণ করা হয়েছে। আমাদের হাজারো দোয়া-মোনাজাতেও এই নির্যাতন বন্ধ হয় নি। আমাদের কোনো বিক্ষোভ, কোনো প্রতিবাদ, কোনো ওজর-আপত্তি-আব্দার মানবাধিকারের ফেরিওয়ালাদের কর্ণকোটরেও পৌঁছে নি। যখন দেখা গেল অবস্থা এই, আমাদের কোনো প্রতিবাদ, কোন বিক্ষোভে কাজ হচ্ছে না, পৃথিবীতে মুসলিম নামক জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেললেও তাদের পক্ষে একটা ‘টু’ শব্দ করারও লোক নেই, তখন ‘মরতে যখন হচ্ছেই বীরের মত মরব’ এই চেতনা থেকে অনেক জায়গায় সশস্ত্র প্রতিরোধের চেষ্টা শুরু হলো। আরাকানেও কিন্তু তাই হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে কিছু বিদ্রোহী সংগঠন। তবে প্রচ- দমন-পীড়নের মুখে তাদেরকেও হার মানতে হয়েছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। একই কথা প্রযোজ্য আফগান, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তানসহ সর্বত্র গড়ে ওঠা সশস্ত্র মুসলিম যোদ্ধাদের ক্ষেত্রে। নিঃসন্দেহে ওই পথ ভুল, ধ্বংসাত্মক ও আত্মঘাতী। কিছুদিন আগে আমাদের দেশের কিছু মুসলিম তরুণ জেহাদী জোশে ঢাকায় অন্তত বিশজন বিদেশিকে জবাই করে হত্যা করে। তাদের বক্তব্য অনেকটা এরকম যে, ‘‘সিরিয়া-ইরাকে পশ্চিমারা নিরীহ বেসামরিক মুসলমানদেরকে হত্যা করছে, আমরা তাদের বেসামরিক মানুষ হত্যা করে প্রতিশোধ নিলাম।’’ এই তরুণরা সহজ একটি সত্য অনুধাবন করতে পারল না যে, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ কখনও অন্যায় দিয়ে হয় না।’ ইসলাম ন্যায়ের ধর্ম। মুসলমানরা ন্যায়বিচার দিবে তাদের পরম শত্রুকেও- এটাই ইসলামের আদর্শ। সে আদর্শ ত্যাগ করে কাপুরুষের মত নিরীহ মানুষ খুন করতে থাকলে মুসলিমদের উপর নির্যাতন বন্ধ তো হবেই না, বরং মুসলিমদের প্রতি অন্য ধর্মের মানুষের ঘৃণা সৃষ্টি হবে এবং এ ধরনের ঘটনায় সা¤্রাজ্যবাদীরা নিরীহ মুসলিমদেরকে নির্বিচারে হত্যা করার আরও অজুহাত পেয়ে যাবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে গণহত্যা শুরু করেছে তার সূত্রপাত কিন্তু একটি জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করেই। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে এ যাবৎকালে মুসলিমদের উপর নির্যাতন বন্ধের জন্য কার্যকরী কোনো উপায় অবলম্বন করা যায় নি। আমাদের বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, লেখালেখি, প্রচারণা, লং মার্চ, দোয়া-মোনাজাত, এমনকি সশস্ত্র প্রতিরোধ- কিছুতেই কিছু হয় নি। ভাগ্যাহত মুসলিমদের ভাগ্যাকাশে শনির মেঘ ক্রমশই ঘন হচ্ছে। তাহলে উপায়?
উপায় একটাই, আগে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের নিজেদের মধ্যে হাজারো বিভেদের দেয়াল দাঁড়িয়ে গেছে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ হবে না কেন? সে সুযোগ তো আমরাই দিয়ে রেখেছি। শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা নিজেরাই শিয়া-সুন্নিসহ হাজারো ফেরকা-মাজহাবে বিভক্ত হয়ে নিজেদের হাতে নিজেদেরকে হত্যা করে আসছি। এক আল্লাহ, এক রসুলের অনুসারী হয়েও আমরা আজ ধর্মীয়ভাবে হাজারো ফেরকা-মাজহাবে, আধ্যাত্মিকভাবে বিভিন্ন তরিকায়, রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন দল-উপদলে ও ভৌগোলিকভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে কাঁঠালের আঠার মত লেগে আছি। শিয়া মরলে সুন্নি খুশি হয়, সুন্নি মরলে শিয়া খুশি হয়। সা¤্রাজ্যবাদীরা শিয়া রাষ্ট্র ধ্বংস করলে সুন্নিরা সহযোগিতা করে, সুন্নি রাষ্ট্র ধ্বংস করলে শিয়া রাষ্ট্র ইন্ধন যোগায়। এই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত আজ আমাদেরকে সামষ্টিকভাবে মৃত্যুখাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে। এখন শিয়ারও যে পরিণতি, সুন্নিরও তাই। শিয়া মসজিদ যেমন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সুন্নিদের মসজিদও রক্ষা পাচ্ছে না। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, মিয়ানমারের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কে সরকারি দলের, কে বিরোধী দলের, কে শিয়া কে সুন্নি, কে হানাফি কে শাফেয়ী, কে মাদ্রাসা শিক্ষিত কে সাধারণ মাধ্যমে শিক্ষিত তা আর কেউ শুনতে চায় না। তাদের সবার এখন এক পরিচয়- গৃহহারা, স্বজনহারা, হতভাগা উদ্বাস্তু। সুতরাং নিজেদের স্বার্থে, মানবতার স্বার্থে, ধর্মের স্বার্থে দল-মত-ফেরকা-মাজহাব নির্বিশেষে পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ হবার কোনো বিকল্প নেই।
সারা পৃথিবীর মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি হেযবুত তওহীদের আহ্বান হচ্ছে, ‘‘বাঁচার জন্য ঐক্যবদ্ধ হোন। অনেক হয়েছে। আর বিভেদের চর্চা করবেন না।’ আমরা কোনো নির্দিষ্ট ফেরকা-মাজহাবে ঐক্যবদ্ধ হতে বলছি না, শিয়াকে সুন্নি হতে বলছি না বা সুন্নিকে শিয়া হতে বলছি না, আওয়ামী লীগকে বিএনপি হতে বলছি না বা বিএনপিকে আওয়ামী লীগ হতে বলছি না, আপনারা যার যার বিশ্বাস ও পছন্দ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের মত থাকুন, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে এক আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে যাবতীয় ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হোন। আমাদেরকে শপথ নিতে হবে আমরা আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকব, একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করব না, ঐক্য নষ্ট হয় এমন কাজ করব না বা এমন কথা বলব না, অন্যায় যে করবে আমরা সবাই তার বিরুদ্ধে দাঁড়াব। কে অন্যায় করল তার চেহারা দেখব না, সে কোন ধর্মের কোন বর্ণের কোন দলের তা দেখব না। কেবল বৌদ্ধরা মুসলিমদের মারলে বিক্ষুব্ধ হব, কিন্তু মুসলিমরা হিন্দুদের বাড়িঘর-মন্দির ধ্বংস করলে চুপ করে থাকব- এটা হবে আরেক অন্যায়। বৌদ্ধরা করুক, হিন্দুরা করুক, মুসলমানরা করুক, আমরা থাকব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ১৬০ কোটি মুসলমান যদি যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তবে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণের পূর্বে কোনো যালেম শক্তিকে একশ’বার ভাবতে হবে।