জঙ্গিবাদ, ধর্মবিশ্বাসের অপপ্রয়োগ ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

মোহাম্মদ আসাদ আলী
সরকারের হাতে আছে আইন, অস্ত্র, বাহিনী। সেই ক্ষমতাবলে সরকার জিয়া-মারজান গংদের খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখী করবে- এমন ভরসা আমরা করতেই পারি। ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যা করে তারা কেবল মানবতারই ক্ষতি করে নি, সরকারেরও যথেষ্ট ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। সুতরাং সরকার তাদের ছেড়ে কথা বলবে না এটাই স্বাভাবিক। ওদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও জঙ্গিদের প্রতি যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। বেশ ক’জন পুলিশ সদস্য ইতোপূর্বে প্রাণ হারিয়েছে জঙ্গিদের হাতে। কাজেই পুলিশও জঙ্গি দমনে সন্দেহাতীত নিষ্ঠাবান রয়েছে। ইতোমধ্যেই বড় বড় কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, যার ফলে জঙ্গিদেরকে অনেকটাই ছত্রভঙ্গ করা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এত এত ‘সফলতা’ ও ‘সম্ভাবনা’র মধ্যেও কী কারণে যেন একটি ‘কিন্তু’ বসানোর জায়গা রেখে দিচ্ছেন আমাদের নীতি-নির্ধারক মহল।
সরকার জঙ্গিবাদকে যতটা ছোট করে দেখছে বিষয়টা ততটা ছোট নয়। মন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্য থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায় সরকার জঙ্গিবাদের গভীরতা বিচার করছে জঙ্গিদের সংখ্যাসাপেক্ষে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে করেই হোক একটি জঙ্গিসুমারি করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের মতে দেশে জঙ্গির সংখ্যা খুব বেশি হলে দেড়শ-দুইশ হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বাত্মক অভিযানের ফলে জঙ্গিদের এ সংখ্যা নাকি আরও কমেছে। এই মতের ভিত্তিতে খুব সম্ভব সরকারের মধ্যে একটি ধারণা জন্ম নিয়েছে যে, এই শ’দুয়েক ব্যক্তিকে কোনোভাবে সরিয়ে ফেলতে পারলেই জঙ্গিবাদ খতম। ফলে একটা করে জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, পাঁচটা-দশটা করে জঙ্গি মরে, আর হিসাব কষা হয়- কতজন মরল, কতজন বাকি থাকল। কিন্তু বিষয়টাকে যতটা সহজ ভেবে নেয়া হচ্ছে আসলেই কি তাই?
আমি এ দেশে লাখ লাখ জঙ্গি দেখতে পাই। এই জঙ্গিদের মারা যায় না, ধরা যায় না। এমনকি তাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোও যায় না। সমীহ করে চলতে হয়। সরকার তাদের দেখেও দেখে না, জেনেও জানে না। এটা ঠিক যে, এই লাখ লাখ জঙ্গির হাতে অস্ত্র নেই, গায়ে কালো পোশাক নেই এবং কালো পতাকাও সাথে রাখে না এরা। ‘একে ২২’ নিয়ে শক্তিশালী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মুখোমুখী হবার সাহসও এদের নেই। কিন্তু মনে আছে চরম হিংস্রতা, বিদ্বেষ, উন্মাদনা, ধর্মান্ধতা। এরা ‘এই নিরীহ’, ‘এই হিংস্র’। এই আপনার বাসায় দাওয়াত খাচ্ছে, এই আপনাকে কাফের-মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে আপনার বাড়ি পোড়াতে আসছে। এই বলছে ইসলাম শান্তির ধর্ম, এই আবার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে মন্দিরে হামলা করছে। হয়ত অনেকেই এদেরকে আক্ষরিক অর্থে জঙ্গি বলতে চাইবেন না, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে জঙ্গিরা যতটা অমানবিক ও ধর্মান্ধ হয়ে থাকে, এরা তার কোনো অংশে কম নয়।
বাহ্যদৃষ্টিতে বারুদও অন্য দশটা পদার্থের মতই নিরাপদ, কিন্তু আগুনের সংঘর্ষে আসলে বোঝা যায় এটার ভয়াবহতা কত, বোঝা যায় সেটা আগুনেরই অন্য পিঠ। বারুদকে তাই বাহ্যদৃষ্টিতে দেখলে চলে না। সরকারের চিহ্নিত দেড়-দুইশ’ জঙ্গির সাথে লাখ লাখ ধর্মান্ধ-ধর্মোন্মাদের পার্থক্য হচ্ছে- ওই জঙ্গিরা আগুনের সংঘর্ষ পেয়েছে বলে জ্বলে উঠেছে, এরা আগুনের সংস্পর্ষ পায় নি। ওদের চেনা যায়, ভেতর-বাহির পড়া যায়। এদের চেনা যায় না। ওরা পরিষ্কার বলে দেয়- তারা রাষ্ট্র মানে না, সংবিধান মানে না, সংসদ মানে না, বিচার মানে না। এরাও বলে, তবে অন্য ভাষায়। প্রতারণার ভাষায়। সে ভাষা যারা পড়তে পারছেন না তারা স্বভাবতই বিপদও টের পাচ্ছেন না। তাদের জন্য একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ঘটনাটি চলতি বছরের। প্রায় সবগুলো মিডিয়াতে ঘটনাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। ধর্মান্ধতা ও ধর্মবিশ্বাসের অপব্যবহার কত নির্মম হতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই ঘটনাটি।
২০১৬ সালের ১৪ মার্চ। নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে হেযবুত তওহীদের দুইজন সদস্যকে দিনের ঝলমলে আলোয় জবাই করে হত্যা করা হয়। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সেদিন সকাল থেকে ‘জিহাদী সংগ্রহ কার্যক্রম’ আরম্ভ হয়। হেযবুত তওহীদকে প্রচার করা হয় খ্রিস্টান। তারপর স্লোগান তোলা হয়- গীর্জা ভাঙ্গো, খ্রিস্টান মারো। পুরো ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত। কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা নির্দিষ্ট অভিসন্ধী নিয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটায়।
সেদিন স্থানীয় মসজিদের মাইকেখ্রিস্টান মারার জিহাদের ডাক পেয়ে ছুটে আসা হাজার হাজার ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী হেযবুত তওহীদের সদস্যদের বাড়িঘর অবরুদ্ধ করে রাখে। যে হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে আসে খ্রিস্টান হত্যা করার জন্য। এমনকি রাস্তায় আটকে পড়া যাত্রীবাহী বাসের যাত্রীদেরকে বলা হয়- এই গ্রাম থেকে খ্রিস্টান উৎখাতের জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছে, আপনারাও জিহাদে শামিল হউন। কয়েকজন বাহিরাগত যাত্রীও নাকি হামলায় অংশ নিয়েছিল সেদিন। জিহাদের সুযোগ তারা মিস করতে চায় নি!
চার ঘণ্টা ধরে অবরুদ্ধ করে রেখে হেযবুত তওহীদের সদস্যদের বাড়িতে উপর্যুপরি হামলা চালাতে থাকে তারা। এই দীর্ঘ সময়ে বারবার ডাকাডাকি করেও পুলিশের নাগাল পাওয়া যায় নি, কারণ রাস্তায় গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছিল পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক। পুলিশের গাড়ি সময়মত ঢুকতে পারে নি। যখন পুলিশ এলো, ততক্ষণে আমাদের দুইজন সদস্যকে গলা কেটে হত্যা করা হয়ে গেছে। তাদের চোখ উপড়ানো হয়, রগ কাটা হয়। তাতেও আক্রোশ না মেটায় লাশের গায়ে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সেই সাথে দুইটি বাড়িও আসবাবপত্রসমেত জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয়।
হুজুগে মেতে উঠে হামলায় অংশগ্রহণকারী অনেকেই হেযবুত তওহীদকে নয়, খ্রিস্টানকে মারতে গিয়েছিল। যদি তারা জানত এরা খ্রিস্টান নয়, মুসলমান, তাহলে হয়ত হামলায় অংশ নিত না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- হেযবুত তওহীদ খ্রিস্টান নয় মানেই এই নয় যে, দেশে কোনো খ্রিস্টান নেই। এ দেশে খ্রিস্টান আছে, হিন্দু আছে, বৌদ্ধ আছে, নাস্তিকও আছে। আর আছে বিধর্মী হত্যার জিহাদের ডাক দেওয়ার জন্য হাজার হাজার ধর্মব্যবসায়ী। তাদের একজনের ডাকে লক্ষ জন ছুটে আসবে। যে নৃশংসতা আইএসও কোনোদিন করতে পারে নি, সেটা অবলীলায় করে দেখাবে, যেমনটা সোনাইমুড়িতে করল।
এই যে লক্ষ লক্ষ মানুষের হুজুগপ্রবণতা, চরম সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা, জিহাদের কথামাত্র আগপাছ না ভেবে পঙ্গপালের মত ছুটে গিয়ে নিরীহ মানুষের উপর হামলে পড়া, মসজিদকে গুজব ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা, যাকে ইচ্ছা তাকে কাফের-মুরতাদ-নাস্তিক ফতোয়া দিয়ে কতল করার ডাক দেওয়া, এক কথায় মানুষের ধর্মবিশ্বাসের অপব্যবহার করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা- এর বিরুদ্ধে আমাদের সরকার শক্তি প্রয়োগ করে আদৌ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে।
নব্য উত্থিত সশস্ত্র জঙ্গিদের প্রতিরোধে সরকার যথেষ্ট সজাগ রয়েছে- এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মদক্ষতাও প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু যদি ভাবা হয় যে, এই দেড়-দুইশ সশস্ত্র ব্যক্তিকে দেশ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারলেই বাংলাদেশ নিরাপদ হয়ে যাবে, জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে যাবে, তবে সেটা হবে সরকারের অলীক কল্পনা। সর্বক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের অপপ্রয়োগ বন্ধ করা না গেলে, ধর্মভীরু মানুষের ধর্মবিশ্বাস নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পকেটস্থ থেকে গেলে, মানুষকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দিতে না পারলে, এ আশঙ্কা করা অমূলক হবে না যে, সেদিন বেশি দূরে নয় যখন মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার জঙ্গি তৈরি হবে, কোথাও গলা কাটা হবে, কোথাও চোখ উপড়ানো হবে, কোথাও রগ কাটা হবে, কোথাও আগুন দিয়ে বাড়িঘর পোড়ানো হবে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আরও বাড়বে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ মৌলবাদী রাষ্ট্রের খেতাব কুড়োবে। তার জন্য ‘একে-২২’ থাকতেই হবে, কালো কাপড় পরতেই হবে, সাইট ইন্টেলিজেন্সে আইএসের দায় স্বীকার করতেই হবে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Comments (0)
Add Comment