বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৮৪ হাজার। সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আছে প্রায় ৪০টি। এগুলোর মধ্যে ৫টি দ্রাবিড়, ১৫টি চীনা তিব্বতি, ৯টি অস্ট্রো এশিয়াটিক, ১১টি ইন্দো-ইউরেপিয় ভাষা পরিবারভুক্ত। দেশের কত মানুষ মাতৃভাষা হিসাবে ঐসব ভাষা ব্যবহার করে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক সমীখ্যায় কয়েকটি ভাষার জনগোষ্ঠী সংখ্যা পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলো-২৫টি ভাষায় কথা বলে ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯৭ জন। ৮টি গোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ কথা বলেন তাঁদের মাতৃভাষায়। ৪০টি ভাষার মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন। যেমন বিপন্ন ভাষার মধ্যে রয়েছে প্রায় এক হাজার জনগোষ্ঠীর খারিয়া ভাষা। সৌরা ভাষা ব্যবহার করে প্রায় এক হাজার ব্যক্তি। কোড়া ভাষায় কথা বলে ২ হাজার ৮ শ ৪৩ জন। ৮ হাজার মানুষ ব্যবহারকরে মালতো ভাষা। খুমি ভাষায় কথা বলে ৩ হাজার ৬৬৯ জন। কন্দ ভাষাভাষি প্রায়৭০০ জন। পাংখো ভাষা ব্যবহার করে ২ হাজার ২৭৪ জন। চাক ভাষা ব্যবহারকারী ২ হাজার ৮৩৫ জন। প্রায় ৪ হাজার মানুষের কথ্য ভাষা খিয়াং/লালেং/ …ভাষায় কথা বলে ২হাজার ৩৩ জন। মাত্র ৯৫ জনের কথ্য ভাষা লুসাই। এছাড়া আরো এক তথ্যে জানা যায় ‘‘রেংমিটচ্য’’ ভাষা বলতে পারা ক্ষুদ্র নৃৃ-গোষ্ঠী মাত্র ছয়জন বেঁচে আছেন। বাংলাদেশে সাঁওতালী ভাষার হরফ নিয়ে খৃষ্টান ও নন-খৃষ্টান দ্বন্দ্বে আটকে আছে দীর্ঘকাল থেকে। সাঁওতাল এক গ্রুপ চান ‘বাংলা’ হরফ, অপর গ্রুপ চান রোমান হরফ এবং আরো এক গ্রুপ চান ‘‘অলচিকি’’ হরফ। ফলে সাঁওতালী ভাষার পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে আটকে আছে। এটা সাঁওতাল জাতির জন্য অমঙ্গলজনক ও বিভক্তির কারণও বটে। এমন সিদ্ধান্তে বলা যায় যে, নিম্নলিখিত হেতুবাদে ‘‘রোমান লিপি’’ (হরফ) চালু করাই যুক্তিসঙ্গত হবে। কারণ রোমান হরফের সাথে ইংরেজি হরফের মিল আছে। বর্তমান যুগ জ্ঞান বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তির যুগ। সকল কিছূ আবিস্কার হচ্ছে ইংরেজি মিডিয়ামে। আমি সামাজিক পেশাগত সুবিধার জন্য শিক্ষাদান, লেখালেখি, জ্ঞান চর্চায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করলে ভাল ফল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রীরা করবে ভবিষ্যতে। কোন কোন যুক্তিতে ‘‘অলচিকি’’ ভাষা গ্রহণ যোগ্য নয়, তা ভারতের বিভিন্ন তথ্য থেকে নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১। ‘‘অলচিকি’’ লিপি একটি মৌর্য যুগের ব্রাহ্মী লিপিমালা, গথিক লিপিমালা, দক্ষিণ ভারতীয় লিপিমালা ইত্যাদি থেকে সংগৃহীত
২। অলচিকি লিপির উচ্চারণ প্রকৃত সানতালী বর্ণমালার উচ্চারণ নয়।
৩। সি.এস উপাসক লিখিত ‘দ্য’ হিস্ট্রি এ্যান্ড প্যালিওগ্রাফি অফ মোরিয়ান ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্ট’ গ্রন্থের।১৯১,২৪১,২৮৪,২৮৮,২৮৯,৩০৯ পৃষ্ঠায় দর্শিত লিপিমালার সঙ্গে অলচিকি লিপির হুবহু মিল আছে।
৪। গোথিক লিপিমালার ‘ডি’ এবং ‘পি’ প্রতিরূপ লিপি অলচিকি ‘ইর’ এবং‘ ই্ঞ’ লিপির হুুবহু মিল আছে।
৫। এল, ব্লুমফিল্ড এর ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে অবস্থিত চারটি লিপির সঙ্গে অলচিকি লিপির মিল দেখতে পাওয়া যায়।
৬। অবশিষ্ট অলচিকির লিপিগুলি দক্ষিণ ভারতীয় লিপিচিত্রের সঙ্গে অবিকল মিল দেখা যায়।
৭। রঘুনাথ মুরমু ‘দ্য’ হিস্ট্রি এ্যান্ড প্যালিওগ্রাফি অফ মোরিয়ান ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্ট’ ও অন্যান্য গ্রন্থের লিপিমালা থেকে অবৈজ্ঞানিকভাবে লিপি সংগ্রহ করেছেন এবং রোমান সানতালী ধারা ও চিহ্ন অনুকরণ করেছেন।
৮। অলচিকিতে ‘ক’ কে ‘আক্’, ‘জ’ ‘আজ্’, ‘ল’ কে ‘অল্’, ‘গ’ কে ‘অগ্’, ‘র’ কে ‘ইর’, ‘দ’ কে উদ্, ‘প’ কে ‘এপ্’, ‘ন’কে এন্’, ‘ত’ কে ‘অত্’, ‘ঙ’কে ‘অং’, ‘ম’কে ‘আম্’, ‘ঞ’ কে ‘ইঞ’ ইত্যাদি উচ্চারণ করা হয়।
৯। অলচিকি কোন ভাষা নয়, এটি একটি উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক লিপিমাত্র। সানতালদের মাতৃভাষা সানতালী, যা বহুকাল থেকে রোমান বাংলা দেবগণাগরী লিপিতে লেখা হয়ে আসছে। অলচিকির আগে ও পরে ১৭ জন ব্যক্তি সানতালী ভাষার জন্য নিজ নিজ বিভিন্ন ধরণের লিপি অথবা অক্ষরগুলোকে তৈরী করেছেন। সানতালী ভাষাতে ৪৭টি ধ্বণি আছে। এ জন্যে ৪৭টি অক্ষরের প্রয়োজন । কিন্তু ১৭ জন ব্যক্তির লিপিতে ৪৭ টি ধ্বনির জন্য ৪৭টি অক্ষন নেই। এছাড়া শুধু ঝাড়খন্ড বাসি শ্রী বাবুধন মুর্মু-এর ‘‘নাওয়া সানতালী আখর’’ বইতেই সানতালী ভাষাতে যতগুলি ধ্বনি আছে ততগুলো অক্ষরই তৈরী করেছেন। যদি আমরা অলচিকি লিপিকে গ্রহণ করি, তবে প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র এবং উচ্চ শিক্ষিত সানতাল সমুদয় একই বিন্দুতে অর্থাৎ অ, আ, ক, খ স্তরেই আবদ্ধ হয়ে থাকবে। যদি উপরি লিখিত অক্ষরগুলো দ্বারা অথবা অলচিকি লিপিতে সানতালী ভাষা সাহিত্যের উন্নতি হতে শুধু ১০০ (একশো) বছরই কেন ১০০০(এক হাজার) বছর পিছিয়ে যেতে হবে। অতএব মূল কথা হলো এক রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যের মানুষের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপন এবং সানতালী ভাষা সাহিত্যের উন্নতি, শুধু রোমান লিপিতেই সম্ভব এবং আগেও হবে।
১০। ধ্বনি বিদ্যা অনুযায়ী সানতালী ভাষায় ৪৭টি ধ্বণি আছে। সানতালী ভাষা যথাযথভাবে প্রকাশের জন্য রোমান, বাংলা ও দেবনাগরী লিপিতে ৪৭টি পৃথক অক্ষর বর্তমান। কিন্তু অলচিকি বর্ণমালায় মাত্র ৩০টি অক্ষর আছে, যাতে ১৭টি অক্ষরের অভাব থাকায় অলচিকি অক্ষরের সানতালী ভাষা যথাযথভাবে লেখা যায় না। বানান ও উচ্চারণগত বিকৃতি ঘটে।
১১। অলচিকি বর্ণমালায় একটি ধ্বনিকেই দুইটি পৃথক অক্ষর দ্বারা এবং দুই টি পৃথক ধ্বনিকে একটি মাত্র অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ভাষাবিজ্ঞান বা ধ্বণিবিদ্যা সম্মত নয়।
১২। অবদমিত ব্যঞ্জন ধ্বণি ‘ক্’, ‘চ্’, ‘ত্’ (ৎ), ‘প্’-এর পরিবর্তে অলচিকিতে ‘গ’, ‘জ’, ‘দ’, ‘ব’ লেখা হয়। এতে উচ্চারণ নিরূপণে অবাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়েছে এবং ভাষার বিকৃতি ঘটেছে। (যেমন- ‘দাক্’ কে ‘দাগ্’, ‘লাচ্’ কে লাজ্’, ‘মেৎ’ কে ‘মেদ্’,‘উপ্’কে ‘উব্’, ‘আপ্’কে ‘আব’, ‘দেচ’ কে ‘দেজ্’, ‘রেচ্’ ‘রেজ’ ইত্যাদি।
১৩। ডায়াক্রিটিকেল মার্কস্ ( টুডীক্ আর টয়ৎ) ব্যবহারেও রোমান সানতালী লিপির অনুকরণ ঘটেছে।
১৪। অলচিকি অক্ষরগুলির নামকরণ এবং তাদের উচ্চারণ শুধু যে বিদ্ঘুটেমাত্র তা নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে অক্ষরগুলির নামের সানতালী অর্থ অশ্লীল শব্দও বোঝায়। যেমন -এড় (ব), উপরোক্ত কারণে সানতাল জনসাধারণ অলচিকি লিপিকে অস্বীকার করেন এবং গ্রহণও করেন না। অবৈজ্ঞানিক অলচিকি লিপি সানতালী ভাষার পক্ষে উপযোগী নয়। সানতালী ভাষার ধ্বনি অনুযায়ী অলচিকি লিপির ধ্বনি বিন্যাস নেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অলচিকি লিপির বাস্তব গ্রহণ যোগ্যতা না থাকা স্বতে¦ও, সংকীর্ন রাজনৈতিক কারণে অলচিকির সমর্থকের দ্বারা অবৈজ্ঞানিক, ত্রুটিপূর্ণ এবং অনুকরণকৃত অলচিকি লিপিকে সানতালী ভাষার সাধারণ জনগণের উপর জোড় করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আশ্চয্যের কথা হলো, যারা না বুঝে অলচিকির প্রচার প্রসারে লেগে আছেন, ঐ সব লোকেরা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার (হক) কে না বুঝে হনন করে চলেছে। অলচিকির সমর্থকেরা নিজেরাই অলচিকি জানেন না এবং তাদের নিজেদের সন্তানরাও অলচিকি লিপির মাধ্যমে সানতালী ভাষা লিখতে পড়তে জানে না। এই তথাকথিত অলচিকি সমর্থক সমাজ দরদীরা গরীব ও সরল গ্রামীণ জনতার সন্তানদের জন্য অলচিকি লিপিতে সানতালী ভাষায় পঠন-পাঠনের কথা বলে থাকে, কিন্তু অলচিকি সমর্থকেরা ক্রিশ্চিয়ান মিশনের ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে রোমান লিপিতে নিজের সন্তানদের পড়াশুনার জন্য পাঠায়। এঁরা রোমান লিপির মাধ্যমে নিজ সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে কোনও চেষ্টাই আর বাকি রাখেননি, অথচ রোমান লিপির মাধ্যমেই সানতালী শিক্ষা দানের ব্যবস্থার কথা উঠলেই এনাদের গা জ্বলে ওঠে কেন? পরিবর্তনের পর, আশা করা গিয়েছে যে সানতালী ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি এই সরকারী বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, কতিপয় ভেকধারী তথাকথিত সমর্থকদের দ্বারা এই জনদরদী সরকারও ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন। এই ভেকধারীরা পরিবর্তনের পরে রাতারাতি ডিগবাজি খেয়ে নিজেদের বর্তমান সরকারের প্রকৃত সমর্থক বলে তুলে ধরতে সক্ষম হন, এবং আগের মতোই অবৈজ্ঞানিক, ত্রুটিপূর্ণ ও অনুকরণকৃত অলচিকি লিপিকে সাধারণ সানতালী ভাষী জনগণের উপর চাপিয়ে দেবার কাজে বর্তমান সরকারকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
১৫। কোনও ভাষা লেখার জন্য কি লিপি বা কি কি লিপি সরকার বা আম জনতা দ্বারা ব্যবহৃত হবে, এই বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানের ‘রাজ্য তালিকা’’ বা ‘যৌথ’ ( রাজ্য-কেন্দ্র) তালিকায় কখনও অন্তুর্ভূক্ত করা হয়নি। এটি সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়।
১৬। অলচিকির সমর্থকেরা এবং নেতা, নেত্রী, মন্ত্রীরা দুটি মিথ্যা কথা পরিষ্কার ভাবে বলে থাকেন-(ক) অলচিকি ভাষা এবং (খ) অলচিকি লিপি সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অলচিকি লিপি সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি, কিন্তু শুধু সানতালী ভাষা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। ভাতরীয় সংবিধানে অষ্টম তপশীলে অদ্যাবধি মোট ২২টি ভাষা ‘সরকারী ভাষা’ রূপে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, যার মধ্যে সানতালী ভাষা একটি। এই ভাষাগুলি মধ্যে ভারত সরকার কেবলমাত্র ‘হিন্দী’ এবং ‘ইংরেজি’ ভাষা দুটি সরকারী কাজকর্ম লেখার ক্ষেত্রে লিপি হিসাবে যথাক্রমে ‘দেবনাগরী’ এবং ‘ রোমান’ লিপি দুটিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, বাকি ভাষাগুলি লেখার ক্ষেত্রে তেমন কোনও কেন্দ্রীয় সরকারী আদেশনামা নেই। অর্থাৎ, সানতালী ভাষাসহ অন্যান্য ‘সরকারী ভাষা’গুলি লেখার ক্ষেত্রে কোনও একটি ‘ বিশেষ’ লিপি নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই, এবং দেশে ‘(ভারত বর্ষে) প্রচলিত সবকটি লিপিই এই ক্ষেত্রে সমানভাবে স্বীকার করা হয়েছে।
১৭। অলচিকির সমর্থকেরা বলে থাকেন যে, ‘রোমান’ লিপি একটি অ-সানতাল লিপি, যা কিনা ‘সাহেবদের দ্বারা’, তাঁদের ভাষা চর্চার কাজে ব্যবহৃত না হলে নাকি সানতালদের জাত যাবে, মানে, তাঁরে জাতীত্ত্বাই নাকি বিপন্ন হয়ে পড়বে, এই কথাটা ঠিক নয়, এটি অসত্য কথা।
১৮। এই কু-যুক্তি শুনে মনে প্রশ্ন জাগে-বহুকাল থেকেই তো আসাম, মণিপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যের অ-বাঙালী জনগণ বাংলা লিপিকে আশ্রয় করেই তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা করে আসছেন, কই তাঁরাতো নিজেদের জাতিসত্ত্বা হারিয়ে বাঙ্গালি হয়ে যাননি? একইভাবে দেখা যাবে, পশ্চিম বাংলার সানতাল জনগণ বহুদিন থেকেই বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপির মাধ্যমে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশুনা করে আসছেন, অনেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, কই তাঁরা তো নিজেদের জাতকূল হারিয়ে মুরমু থেকে মুখার্জী, বেসরা বা বাস্কে থেকে ব্যানার্জী হয়ে যাননি! একই কথা খাটে ঝাড়খন্ড বিহারের সানতালদের ক্ষেত্রে, যাঁরা হিন্দী ভাষা ও দেবনাগরী লিপির মাধ্যমে পড়াশুনা করেও সেই সানতালী রয়ে গেছেন। কই তাঁরা তো সানতাল থেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ, হিন্দু পণ্ডিত বা হিন্দু কায়স্তে পরিনত হননি? তবে? রোমান লিপির বিরোধীতায় এরকম সংকীর্ণ মনোভাব কেন? রোমান লিপি তো রোমানদের কাছ থেকে নেওয়া, কই ইংরেজ, ফরাসী, স্পেনীয়, ডাচ্, ওলন্দাজ, স্কট, জার্মান প্রভৃতি জাতির লোকেরা তো রোমীয় বা ইতালীয় হয়ে যাননি। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতি রোমান লিপির মাধ্যমে ইংরেজি পড়াশুনা করছে, সেই সব জাতি তো ইংরেজ হয়ে যাননি? অথচ সানতালদের ক্ষেত্রেও তাঁদের মাতৃভাষা চর্চার জন্য রোমান লিপি ব্যবহার তাঁদেরকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে উন্নতির পথিক করে তুলবে, তাঁদের জাতিসত্ত্বা বিপন্ন হবার পরিবর্তে আরোও উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
১৯। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এখানে যেকোনও ব্যক্তি নিজ রুচি ও ইচ্ছা অনুযায়ী অবাধে যে কোনও ধর্ম পালন করতে পারেন। রাজনৈতিক নেতাটি সরলমতি সানতাল আদিবাসীদের এই বলে বিভ্রান্ত করছেন যে, সানতালদের একমাত্র স্বীকৃত ধর্মের নাম হলো ‘সারণা’ যে বা যারা এই ধর্ম পালন করেন না তাঁরা সানতাল বা আদিবাসী বলে পরিগণিত হতে পারে না। অথচ , সত্যি কথাটা হলো-সানতালদের আদি ধর্মের নাম হলো ‘সৗরি ধরম’, ‘সারণা’ নয়। এছাড়াও সানতালরা বর্তমানে অন্যান্য বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস অনুশীলন করছেন, যে অধিকার ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী প্রশ্নাতীতভাবে তাঁদের বা যে কারোরই রয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ থাকে যে, মহামান্য পাটনা হাইকোর্টের রায়ে বহু পূর্বেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে- একজন আদিবাসী সানতাল তাঁর পছন্দ অনুযায়ী যে কোনও ধর্ম পালন করতে পারেন, তাতে তাঁর আদিবাসীত্বের বা তদানুযায়ী অধিকারসমূহের কোনও হেরফের ঘটে/ঘটবে না। এই বিভ্রান্তকারী ও বিভেদকারী রাজনৈতিক অশুভ শক্তির ধারক, বাহক ও দালালদের থেকে সাধারণ সানতাল জনগণ সতর্ক থাকুন।
২০। অনেক ভাষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞের মতে , অলচিকিলিপি একটি বিকলাঙ্গ শিশুর মতো,শুনতে, বলতে, দেখতে, ঘ্রাণে, স্পর্শে ও চলতে অক্ষম। অলচিকির সমর্থকগণ অলচিকিকে সরকারী সহায়তায় জীবনদায়ী ভেন্টিলেটরে রেখেছেন বটে, কিন্তু নিকটভবিষ্যৎতে এর মৃত্যূ সুনিশ্চিত। অলচিকির নির্মাণকর্তা রঘুনাথ মুর্মুর ধ্বনি বিজ্ঞান এবং অক্ষর বিজ্ঞানে কোন জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিল না। জ্ঞান না থাকার কারণে তিনি সানতালী ভাষার ৪৭টি অক্ষরের পরিবর্তে মাত্র ৩০টি অক্ষরই বানাতে পেরেছেন, এই কারণেই অক্ষরের উচ্চারণও কাল্পনিক এবং আন্দাজে তৈরী করেছেন। সানতালী ভাষাতে কত স্বরবর্ণ এবং কত ব্যঞ্জণবর্ণ আছে তা রঘুনাথ মুর্মুর জানা ছিল না। অলচিকি একটি অবৈজ্ঞানিক (Unscintific) লিপি, তাতে কোন আধার (Base) ও নিয়ম-নীতি(System) নেই। রঘুনাথ মুর্মূকে পণ্ডিত উপাধি ফুটবল খেলার সময় দেওয়া হয়েছিল। কোন বিশ্ব বিদ্যালয় তাঁকে পণ্ডিত উপাধি দেয়নি।
সানতালী ভাষার জন্য প্রচলিত বিভিন্ন লিপির মধ্যে কেবলমাত্র রোমান লিপিরই ব্যবহারিক উপযোগীতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এই লিপিটি কোনো দেশ বিশেষ, কোনো জাতি বিশেষ, কোনো ধর্ম বিশেষ ও কোনো রাজনৈতিক দল বিশেষের নয়। রোমান লিপির কার্যকারিতা এবং সার্বজনিন গ্রহণযোগ্যতা আজ কারোরই সুপারিশের অপেক্ষা রাখে না, তা এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। মানবসভ্যতার অধিকাংশ জ্ঞানভাণ্ডার, সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা চর্চা, সবই প্রায় এই বিশ্বজনিন লিপিকে আশ্রয় করেই উন্নতির পথে এগিয়েই চলেছে। মানব জাতির ভবিষ্যতেও এই লিপিতে নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে এবং এগিয়ে চলছে, ইতিহাসের অমোঘ গতিকে রুখবে, প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থান্বেষীদের সেই সাধ্য কোথায়? জয় চিরকালই সত্যের হয়েছে এবং হবেই। তথ্যসূত্র: ভারত পত্রিকা/ লিফলেট অবলম্বনে।
আরো বিষদে জানার জন্য নিম্নলিখিত বইগুলি অবশ্যই পড়ুন-
১। অলচিকি একটি মৌর্য্যযুগীয় লিপি-দুরবীন সরেন, ২। অলচিকি কী ক্রটিয়াঁ- সুকুমার হেমব্রম, ৩। সানতালী ভাষার জন্য লিপির নির্বাচন- ড. অনিমেষ কান্তি পাল,৪। অলচিকি এক অবৈজ্ঞানিক লিপি- হানুক হাঁসদাক, ৫। সানতালী ভাষার জন্য অলচিকি কেন?-ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক, ৬। ‘‘সংবিধানের অষ্টম তপশিলীতে সানতালী ভাষার স্বীকৃতি’’ ২২ ডিসেম্বর ২০০৩ সরকারী আদেশনামা দেখুন।
বাবুল রবিদাস
এ্যাডভোকেট
জজকোর্ট, জয়পুরহাট।