Connect with us

মতামত

সাঁওতালদের জন্য ‘‘অলচিকি লিপি ও রোমান লিপি’’ বিতর্কের অবসান প্রয়োজন

Avatar photo

Published

on

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৮৪ হাজার। সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আছে প্রায় ৪০টি। এগুলোর মধ্যে ৫টি দ্রাবিড়, ১৫টি চীনা তিব্বতি, ৯টি অস্ট্রো এশিয়াটিক, ১১টি ইন্দো-ইউরেপিয় ভাষা পরিবারভুক্ত। দেশের কত মানুষ মাতৃভাষা হিসাবে ঐসব ভাষা ব্যবহার করে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক সমীখ্যায় কয়েকটি ভাষার জনগোষ্ঠী সংখ্যা পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলো-২৫টি ভাষায় কথা বলে ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯৭ জন। ৮টি গোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ কথা বলেন তাঁদের মাতৃভাষায়। ৪০টি ভাষার মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন। যেমন বিপন্ন ভাষার মধ্যে রয়েছে প্রায় এক হাজার জনগোষ্ঠীর খারিয়া ভাষা। সৌরা ভাষা ব্যবহার করে প্রায় এক হাজার ব্যক্তি। কোড়া ভাষায় কথা বলে ২ হাজার ৮ শ ৪৩ জন। ৮ হাজার মানুষ ব্যবহারকরে মালতো ভাষা। খুমি ভাষায় কথা বলে ৩ হাজার ৬৬৯ জন। কন্দ ভাষাভাষি প্রায়৭০০ জন। পাংখো ভাষা ব্যবহার করে ২ হাজার ২৭৪ জন। চাক ভাষা ব্যবহারকারী ২ হাজার ৮৩৫ জন। প্রায় ৪ হাজার মানুষের কথ্য ভাষা খিয়াং/লালেং/ …ভাষায় কথা বলে ২হাজার ৩৩ জন। মাত্র ৯৫ জনের কথ্য ভাষা লুসাই। এছাড়া আরো এক তথ্যে জানা যায় ‘‘রেংমিটচ্য’’ ভাষা বলতে পারা ক্ষুদ্র নৃৃ-গোষ্ঠী মাত্র ছয়জন বেঁচে আছেন। বাংলাদেশে সাঁওতালী ভাষার হরফ নিয়ে খৃষ্টান ও নন-খৃষ্টান দ্বন্দ্বে আটকে আছে দীর্ঘকাল থেকে। সাঁওতাল এক গ্রুপ চান ‘বাংলা’ হরফ, অপর গ্রুপ চান রোমান হরফ এবং আরো এক গ্রুপ চান ‘‘অলচিকি’’ হরফ। ফলে সাঁওতালী ভাষার পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে আটকে আছে। এটা সাঁওতাল জাতির জন্য অমঙ্গলজনক ও বিভক্তির কারণও বটে। এমন সিদ্ধান্তে বলা যায় যে, নিম্নলিখিত হেতুবাদে ‘‘রোমান লিপি’’ (হরফ) চালু করাই যুক্তিসঙ্গত হবে। কারণ রোমান হরফের সাথে ইংরেজি হরফের মিল আছে। বর্তমান যুগ জ্ঞান বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তির যুগ। সকল কিছূ আবিস্কার হচ্ছে ইংরেজি মিডিয়ামে। আমি সামাজিক পেশাগত সুবিধার জন্য শিক্ষাদান, লেখালেখি, জ্ঞান চর্চায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করলে ভাল ফল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রীরা করবে ভবিষ্যতে। কোন কোন যুক্তিতে ‘‘অলচিকি’’ ভাষা গ্রহণ যোগ্য নয়, তা ভারতের বিভিন্ন তথ্য থেকে নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

১। ‘‘অলচিকি’’ লিপি একটি মৌর্য যুগের ব্রাহ্মী লিপিমালা, গথিক লিপিমালা, দক্ষিণ ভারতীয় লিপিমালা ইত্যাদি থেকে সংগৃহীত
২। অলচিকি লিপির উচ্চারণ প্রকৃত সানতালী বর্ণমালার উচ্চারণ নয়।
৩। সি.এস উপাসক লিখিত ‘দ্য’ হিস্ট্রি এ্যান্ড প্যালিওগ্রাফি অফ মোরিয়ান ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্ট’ গ্রন্থের।১৯১,২৪১,২৮৪,২৮৮,২৮৯,৩০৯ পৃষ্ঠায় দর্শিত লিপিমালার সঙ্গে অলচিকি লিপির হুবহু মিল আছে।
৪। গোথিক লিপিমালার ‘ডি’ এবং ‘পি’ প্রতিরূপ লিপি অলচিকি ‘ইর’ এবং‘ ই্ঞ’ লিপির হুুবহু মিল আছে।
৫। এল, ব্লুমফিল্ড এর ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে অবস্থিত চারটি লিপির সঙ্গে অলচিকি লিপির মিল দেখতে পাওয়া যায়।
৬। অবশিষ্ট অলচিকির লিপিগুলি দক্ষিণ ভারতীয় লিপিচিত্রের সঙ্গে অবিকল মিল দেখা যায়।
৭। রঘুনাথ মুরমু ‘দ্য’ হিস্ট্রি এ্যান্ড প্যালিওগ্রাফি অফ মোরিয়ান ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্ট’ ও অন্যান্য গ্রন্থের লিপিমালা থেকে অবৈজ্ঞানিকভাবে লিপি সংগ্রহ করেছেন এবং রোমান সানতালী ধারা ও চিহ্ন অনুকরণ করেছেন।
৮। অলচিকিতে ‘ক’ কে ‘আক্’, ‘জ’ ‘আজ্’, ‘ল’ কে ‘অল্’, ‘গ’ কে ‘অগ্’, ‘র’ কে ‘ইর’, ‘দ’ কে উদ্, ‘প’ কে ‘এপ্’, ‘ন’কে এন্’, ‘ত’ কে ‘অত্’, ‘ঙ’কে ‘অং’, ‘ম’কে ‘আম্’, ‘ঞ’ কে ‘ইঞ’ ইত্যাদি উচ্চারণ করা হয়।
৯। অলচিকি কোন ভাষা নয়, এটি একটি উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক লিপিমাত্র। সানতালদের মাতৃভাষা সানতালী, যা বহুকাল থেকে রোমান বাংলা দেবগণাগরী লিপিতে লেখা হয়ে আসছে। অলচিকির আগে ও পরে ১৭ জন ব্যক্তি সানতালী ভাষার জন্য নিজ নিজ বিভিন্ন ধরণের লিপি অথবা অক্ষরগুলোকে তৈরী করেছেন। সানতালী ভাষাতে ৪৭টি ধ্বণি আছে। এ জন্যে ৪৭টি অক্ষরের প্রয়োজন । কিন্তু ১৭ জন ব্যক্তির লিপিতে ৪৭ টি ধ্বনির জন্য ৪৭টি অক্ষন নেই। এছাড়া শুধু ঝাড়খন্ড বাসি শ্রী বাবুধন মুর্মু-এর ‘‘নাওয়া সানতালী আখর’’ বইতেই সানতালী ভাষাতে যতগুলি ধ্বনি আছে ততগুলো অক্ষরই তৈরী করেছেন। যদি আমরা অলচিকি লিপিকে গ্রহণ করি, তবে প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র এবং উচ্চ শিক্ষিত সানতাল সমুদয় একই বিন্দুতে অর্থাৎ অ, আ, ক, খ স্তরেই আবদ্ধ হয়ে থাকবে। যদি উপরি লিখিত অক্ষরগুলো দ্বারা অথবা অলচিকি লিপিতে সানতালী ভাষা সাহিত্যের উন্নতি হতে শুধু ১০০ (একশো) বছরই কেন ১০০০(এক হাজার) বছর পিছিয়ে যেতে হবে। অতএব মূল কথা হলো এক রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যের মানুষের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপন এবং সানতালী ভাষা সাহিত্যের উন্নতি, শুধু রোমান লিপিতেই সম্ভব এবং আগেও হবে।
১০। ধ্বনি বিদ্যা অনুযায়ী সানতালী ভাষায় ৪৭টি ধ্বণি আছে। সানতালী ভাষা যথাযথভাবে প্রকাশের জন্য রোমান, বাংলা ও দেবনাগরী লিপিতে ৪৭টি পৃথক অক্ষর বর্তমান। কিন্তু অলচিকি বর্ণমালায় মাত্র ৩০টি অক্ষর আছে, যাতে ১৭টি অক্ষরের অভাব থাকায় অলচিকি অক্ষরের সানতালী ভাষা যথাযথভাবে লেখা যায় না। বানান ও উচ্চারণগত বিকৃতি ঘটে।
১১। অলচিকি বর্ণমালায় একটি ধ্বনিকেই দুইটি পৃথক অক্ষর দ্বারা এবং দুই টি পৃথক ধ্বনিকে একটি মাত্র অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ভাষাবিজ্ঞান বা ধ্বণিবিদ্যা সম্মত নয়।
১২। অবদমিত ব্যঞ্জন ধ্বণি ‘ক্’, ‘চ্’, ‘ত্’ (ৎ), ‘প্’-এর পরিবর্তে অলচিকিতে ‘গ’, ‘জ’, ‘দ’, ‘ব’ লেখা হয়। এতে উচ্চারণ নিরূপণে অবাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়েছে এবং ভাষার বিকৃতি ঘটেছে। (যেমন- ‘দাক্’ কে ‘দাগ্’, ‘লাচ্’ কে লাজ্’, ‘মেৎ’ কে ‘মেদ্’,‘উপ্’কে ‘উব্’, ‘আপ্’কে ‘আব’, ‘দেচ’ কে ‘দেজ্’, ‘রেচ্’ ‘রেজ’ ইত্যাদি।
১৩। ডায়াক্রিটিকেল মার্কস্ ( টুডীক্ আর টয়ৎ) ব্যবহারেও রোমান সানতালী লিপির অনুকরণ ঘটেছে।
১৪। অলচিকি অক্ষরগুলির নামকরণ এবং তাদের উচ্চারণ শুধু যে বিদ্ঘুটেমাত্র তা নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে অক্ষরগুলির নামের সানতালী অর্থ অশ্লীল শব্দও বোঝায়। যেমন -এড় (ব), উপরোক্ত কারণে সানতাল জনসাধারণ অলচিকি লিপিকে অস্বীকার করেন এবং গ্রহণও করেন না। অবৈজ্ঞানিক অলচিকি লিপি সানতালী ভাষার পক্ষে উপযোগী নয়। সানতালী ভাষার ধ্বনি অনুযায়ী অলচিকি লিপির ধ্বনি বিন্যাস নেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অলচিকি লিপির বাস্তব গ্রহণ যোগ্যতা না থাকা স্বতে¦ও, সংকীর্ন রাজনৈতিক কারণে অলচিকির সমর্থকের দ্বারা অবৈজ্ঞানিক, ত্রুটিপূর্ণ এবং অনুকরণকৃত অলচিকি লিপিকে সানতালী ভাষার সাধারণ জনগণের উপর জোড় করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আশ্চয্যের কথা হলো, যারা না বুঝে অলচিকির প্রচার প্রসারে লেগে আছেন, ঐ সব লোকেরা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার (হক) কে না বুঝে হনন করে চলেছে। অলচিকির সমর্থকেরা নিজেরাই অলচিকি জানেন না এবং তাদের নিজেদের সন্তানরাও অলচিকি লিপির মাধ্যমে সানতালী ভাষা লিখতে পড়তে জানে না। এই তথাকথিত অলচিকি সমর্থক সমাজ দরদীরা গরীব ও সরল গ্রামীণ জনতার সন্তানদের জন্য অলচিকি লিপিতে সানতালী ভাষায় পঠন-পাঠনের কথা বলে থাকে, কিন্তু অলচিকি সমর্থকেরা ক্রিশ্চিয়ান মিশনের ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে রোমান লিপিতে নিজের সন্তানদের পড়াশুনার জন্য পাঠায়। এঁরা রোমান লিপির মাধ্যমে নিজ সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে কোনও চেষ্টাই আর বাকি রাখেননি, অথচ রোমান লিপির মাধ্যমেই সানতালী শিক্ষা দানের ব্যবস্থার কথা উঠলেই এনাদের গা জ্বলে ওঠে কেন? পরিবর্তনের পর, আশা করা গিয়েছে যে সানতালী ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি এই সরকারী বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, কতিপয় ভেকধারী তথাকথিত সমর্থকদের দ্বারা এই জনদরদী সরকারও ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন। এই ভেকধারীরা পরিবর্তনের পরে রাতারাতি ডিগবাজি খেয়ে নিজেদের বর্তমান সরকারের প্রকৃত সমর্থক বলে তুলে ধরতে সক্ষম হন, এবং আগের মতোই অবৈজ্ঞানিক, ত্রুটিপূর্ণ ও অনুকরণকৃত অলচিকি লিপিকে সাধারণ সানতালী ভাষী জনগণের উপর চাপিয়ে দেবার কাজে বর্তমান সরকারকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
১৫। কোনও ভাষা লেখার জন্য কি লিপি বা কি কি লিপি সরকার বা আম জনতা দ্বারা ব্যবহৃত হবে, এই বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানের ‘রাজ্য তালিকা’’ বা ‘যৌথ’ ( রাজ্য-কেন্দ্র) তালিকায় কখনও অন্তুর্ভূক্ত করা হয়নি। এটি সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়।
১৬। অলচিকির সমর্থকেরা এবং নেতা, নেত্রী, মন্ত্রীরা দুটি মিথ্যা কথা পরিষ্কার ভাবে বলে থাকেন-(ক) অলচিকি ভাষা এবং (খ) অলচিকি লিপি সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অলচিকি লিপি সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি, কিন্তু শুধু সানতালী ভাষা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। ভাতরীয় সংবিধানে অষ্টম তপশীলে অদ্যাবধি মোট ২২টি ভাষা ‘সরকারী ভাষা’ রূপে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, যার মধ্যে সানতালী ভাষা একটি। এই ভাষাগুলি মধ্যে ভারত সরকার কেবলমাত্র ‘হিন্দী’ এবং ‘ইংরেজি’ ভাষা দুটি সরকারী কাজকর্ম লেখার ক্ষেত্রে লিপি হিসাবে যথাক্রমে ‘দেবনাগরী’ এবং ‘ রোমান’ লিপি দুটিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, বাকি ভাষাগুলি লেখার ক্ষেত্রে তেমন কোনও কেন্দ্রীয় সরকারী আদেশনামা নেই। অর্থাৎ, সানতালী ভাষাসহ অন্যান্য ‘সরকারী ভাষা’গুলি লেখার ক্ষেত্রে কোনও একটি ‘ বিশেষ’ লিপি নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই, এবং দেশে ‘(ভারত বর্ষে) প্রচলিত সবকটি লিপিই এই ক্ষেত্রে সমানভাবে স্বীকার করা হয়েছে।
১৭। অলচিকির সমর্থকেরা বলে থাকেন যে, ‘রোমান’ লিপি একটি অ-সানতাল লিপি, যা কিনা ‘সাহেবদের দ্বারা’, তাঁদের ভাষা চর্চার কাজে ব্যবহৃত না হলে নাকি সানতালদের জাত যাবে, মানে, তাঁরে জাতীত্ত্বাই নাকি বিপন্ন হয়ে পড়বে, এই কথাটা ঠিক নয়, এটি অসত্য কথা।
১৮। এই কু-যুক্তি শুনে মনে প্রশ্ন জাগে-বহুকাল থেকেই তো আসাম, মণিপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যের অ-বাঙালী জনগণ বাংলা লিপিকে আশ্রয় করেই তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা করে আসছেন, কই তাঁরাতো নিজেদের জাতিসত্ত্বা হারিয়ে বাঙ্গালি হয়ে যাননি? একইভাবে দেখা যাবে, পশ্চিম বাংলার সানতাল জনগণ বহুদিন থেকেই বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপির মাধ্যমে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশুনা করে আসছেন, অনেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, কই তাঁরা তো নিজেদের জাতকূল হারিয়ে মুরমু থেকে মুখার্জী, বেসরা বা বাস্কে থেকে ব্যানার্জী হয়ে যাননি! একই কথা খাটে ঝাড়খন্ড বিহারের সানতালদের ক্ষেত্রে, যাঁরা হিন্দী ভাষা ও দেবনাগরী লিপির মাধ্যমে পড়াশুনা করেও সেই সানতালী রয়ে গেছেন। কই তাঁরা তো সানতাল থেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ, হিন্দু পণ্ডিত বা হিন্দু কায়স্তে পরিনত হননি? তবে? রোমান লিপির বিরোধীতায় এরকম সংকীর্ণ মনোভাব কেন? রোমান লিপি তো রোমানদের কাছ থেকে নেওয়া, কই ইংরেজ, ফরাসী, স্পেনীয়, ডাচ্, ওলন্দাজ, স্কট, জার্মান প্রভৃতি জাতির লোকেরা তো রোমীয় বা ইতালীয় হয়ে যাননি। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতি রোমান লিপির মাধ্যমে ইংরেজি পড়াশুনা করছে, সেই সব জাতি তো ইংরেজ হয়ে যাননি? অথচ সানতালদের ক্ষেত্রেও তাঁদের মাতৃভাষা চর্চার জন্য রোমান লিপি ব্যবহার তাঁদেরকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে উন্নতির পথিক করে তুলবে, তাঁদের জাতিসত্ত্বা বিপন্ন হবার পরিবর্তে আরোও উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
১৯। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এখানে যেকোনও ব্যক্তি নিজ রুচি ও ইচ্ছা অনুযায়ী অবাধে যে কোনও ধর্ম পালন করতে পারেন। রাজনৈতিক নেতাটি সরলমতি সানতাল আদিবাসীদের এই বলে বিভ্রান্ত করছেন যে, সানতালদের একমাত্র স্বীকৃত ধর্মের নাম হলো ‘সারণা’ যে বা যারা এই ধর্ম পালন করেন না তাঁরা সানতাল বা আদিবাসী বলে পরিগণিত হতে পারে না। অথচ , সত্যি কথাটা হলো-সানতালদের আদি ধর্মের নাম হলো ‘সৗরি ধরম’, ‘সারণা’ নয়। এছাড়াও সানতালরা বর্তমানে অন্যান্য বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস অনুশীলন করছেন, যে অধিকার ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী প্রশ্নাতীতভাবে তাঁদের বা যে কারোরই রয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ থাকে যে, মহামান্য পাটনা হাইকোর্টের রায়ে বহু পূর্বেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে- একজন আদিবাসী সানতাল তাঁর পছন্দ অনুযায়ী যে কোনও ধর্ম পালন করতে পারেন, তাতে তাঁর আদিবাসীত্বের বা তদানুযায়ী অধিকারসমূহের কোনও হেরফের ঘটে/ঘটবে না। এই বিভ্রান্তকারী ও বিভেদকারী রাজনৈতিক অশুভ শক্তির ধারক, বাহক ও দালালদের থেকে সাধারণ সানতাল জনগণ সতর্ক থাকুন।
২০। অনেক ভাষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞের মতে , অলচিকিলিপি একটি বিকলাঙ্গ শিশুর মতো,শুনতে, বলতে, দেখতে, ঘ্রাণে, স্পর্শে ও চলতে অক্ষম। অলচিকির সমর্থকগণ অলচিকিকে সরকারী সহায়তায় জীবনদায়ী ভেন্টিলেটরে রেখেছেন বটে, কিন্তু নিকটভবিষ্যৎতে এর মৃত্যূ সুনিশ্চিত। অলচিকির নির্মাণকর্তা রঘুনাথ মুর্মুর ধ্বনি বিজ্ঞান এবং অক্ষর বিজ্ঞানে কোন জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিল না। জ্ঞান না থাকার কারণে তিনি সানতালী ভাষার ৪৭টি অক্ষরের পরিবর্তে মাত্র ৩০টি অক্ষরই বানাতে পেরেছেন, এই কারণেই অক্ষরের উচ্চারণও কাল্পনিক এবং আন্দাজে তৈরী করেছেন। সানতালী ভাষাতে কত স্বরবর্ণ এবং কত ব্যঞ্জণবর্ণ আছে তা রঘুনাথ মুর্মুর জানা ছিল না। অলচিকি একটি অবৈজ্ঞানিক (Unscintific) লিপি, তাতে কোন আধার (Base) ও নিয়ম-নীতি(System) নেই। রঘুনাথ মুর্মূকে পণ্ডিত উপাধি ফুটবল খেলার সময় দেওয়া হয়েছিল। কোন বিশ্ব বিদ্যালয় তাঁকে পণ্ডিত উপাধি দেয়নি।

সানতালী ভাষার জন্য প্রচলিত বিভিন্ন লিপির মধ্যে কেবলমাত্র রোমান লিপিরই ব্যবহারিক উপযোগীতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এই লিপিটি কোনো দেশ বিশেষ, কোনো জাতি বিশেষ, কোনো ধর্ম বিশেষ ও কোনো রাজনৈতিক দল বিশেষের নয়। রোমান লিপির কার্যকারিতা এবং সার্বজনিন গ্রহণযোগ্যতা আজ কারোরই সুপারিশের অপেক্ষা রাখে না, তা এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। মানবসভ্যতার অধিকাংশ জ্ঞানভাণ্ডার, সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা চর্চা, সবই প্রায় এই বিশ্বজনিন লিপিকে আশ্রয় করেই উন্নতির পথে এগিয়েই চলেছে। মানব জাতির ভবিষ্যতেও এই লিপিতে নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে এবং এগিয়ে চলছে, ইতিহাসের অমোঘ গতিকে রুখবে, প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থান্বেষীদের সেই সাধ্য কোথায়? জয় চিরকালই সত্যের হয়েছে এবং হবেই। তথ্যসূত্র: ভারত পত্রিকা/ লিফলেট অবলম্বনে।

আরো বিষদে জানার জন্য নিম্নলিখিত বইগুলি অবশ্যই পড়ুন-
১। অলচিকি একটি মৌর্য্যযুগীয় লিপি-দুরবীন সরেন, ২। অলচিকি কী ক্রটিয়াঁ- সুকুমার হেমব্রম, ৩। সানতালী ভাষার জন্য লিপির নির্বাচন- ড. অনিমেষ কান্তি পাল,৪। অলচিকি এক অবৈজ্ঞানিক লিপি- হানুক হাঁসদাক, ৫। সানতালী ভাষার জন্য অলচিকি কেন?-ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক, ৬। ‘‘সংবিধানের অষ্টম তপশিলীতে সানতালী ভাষার স্বীকৃতি’’ ২২ ডিসেম্বর ২০০৩ সরকারী আদেশনামা দেখুন।

বাবুল রবিদাস
এ্যাডভোকেট
জজকোর্ট, জয়পুরহাট।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

মতামত

কোথা থেকে এল বাংলা লিপি

Avatar photo

Published

on

এড. বাবুল রবিদাস
মনের ভাব প্রকাশের জন্য লিখিত খোদিত বা অঙ্কিত সাংকেতিক চিহ্নকে লিপি বলে। মাটির ঘর লেপন করতে গিয়ে দাগ সৃষ্টি হয়। এই লেপা থেকে জন্ম হয়েছে লিপি শব্দের। লেপনের কাজে যখন রং বা বর্ণের ব্যবহার শুরু হয়, তখন তার আরেক নাম হলো বর্ণ। বর্ণ যখন গাছের পাতায় বা পত্রে লাগানো হতো, তখন তা হলো পত্রলেখা। লেখায় বা রেখায় ধ্বনি স্থায়ী রুপ লাভ করায় এর নাম হয়ে গেল অক্ষর। অর্থাৎ, যার কোনো ক্ষরণ বা ক্ষয় নেই। অক্ষর, বর্ণ আর লিপি শব্দগুলো তাই প্রায় সমার্থক হয়ে রয়েছে।

১০-১২ হাজার বছর আগের গুহাচিত্র দেখে সিদ্ধান্তে পৌছানো গেছে, চিত্রলিপি থেকে বর্ণলিপির উৎপত্তি হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে ছবি আঁকা ছাড়া অন্য পদ্ধতিও প্রচলিত ছিল। যেমন দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে পাওয়া যায় গ্রন্থিলিপি। দড়িতে গিট দিয়ে তারা মনের ভাব ধরে রাখত। বাংলা লিপির উৎপত্তি সম্পর্কে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় The Origin of the Bengali Script (১৯৬৯) গ্রন্থে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন। ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপির জন্ম হয়েছে। অশোকের সময়কার ব্রাহ্মী লিপি গুপ্ত যুগে এসে নানা আঞ্চলিক বিশিষ্টতা লাভ করে। পূর্ব ভারতের বিশেষ ব্রাহ্মী বর্ণমালার পূর্ব প্রান্তীয় রুপের নাম কুটিল। এই কুটিল লিপি থেকে দশ এগারো শতকে বাংলা, উড়িয়া, অসমিয়া, নেওয়ারি, মৈথিলী ইত্যাদি বর্ণমালার উদ্ভব ঘটে। অবশ্য বাংলা-অসমিয়ার কোনো কোনো বর্ণ দশ শতকের অনেক আগেই দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বর্ণমালার গুচ্ছ বা সেট মোটামুটি এই সময়ে একটা নির্দিষ্ট আকার নেয়।

চিত্রলিপি থেকে বর্ণলিপি-
ভাবনাকে ধরে রাখার জন্য গুহাবাসী মানুষ পর্বতের গায়ে ছবি আঁকত। গুহায় আঁকা ছবিগুলো ছিল বাক্যনির্ভর। অর্থাৎ, প্রতিটি ছবি একটি কথা বা ভাবকে প্রকাশ করত। কিন্তু এর সমস্যা ছিল-অল্প কথা বোঝানোর জন্য অনেক বেশি আঁকতে হতো। প্রকৃত বর্ণনার যথাযথ চিত্রণও সহজ ছিল না। এর পরবর্তী পর্যায়ে তৈরী হয় Pictogram বা চিত্রলিপি। উত্তর আমেরিকার আদিম মানুষের লেখায় চিত্রলিপির নিদর্শন পাওয়া গেছে। চিত্রলিপি পদ্ধতিতে একেকটি চিত্র হতো এককটি বস্তুর প্রতীক। পরপর আঁকা কয়েকটি বস্তুচিত্রের মাধ্যমে কোনো বক্তব্য বা ভাবকে প্রকাশ করা হতো। এই পদ্ধতিতে মনের সূক্ষ্ম অনুভূতি বোঝানো সম্ভব ছিল না। এর ধারাবারিকতায় Ideogram বা ভাবলিপির জন্ম হয়।

ভাবলিপিতে একেকটি প্রতিকৃতি সংক্ষিপ্ত বা সাংকেতিক হয়ে একটি বিশেষ চিহ্ন হয়ে দাড়ায়। চিত্রলিপিতে প্রতিটি চিত্র ছিল বস্তুচিত্র। ভাবলিপিতে প্রতিটি চিহ্ন সে বস্তুকে না বুঝিয়ে বস্তুর নামবাচক শব্দকে নির্দেশ করত। যেমন, প্রাচীন সুমেরীয় লিপিতে প্রথমে ‘মাছ’ বোঝাতে মাছের চিত্রই আাঁকা হতো। পরবর্তীতে স্তরে লিপি বিবর্তনের ফলে মাছের চিত্র একটি বিশেষ চিহ্নে রুপান্তরিত হয়, যার সঙ্গে মাছেরআকৃতির কোনো মিল নেই। লিপিবিজ্ঞানীরা এই স্তরের লিপিকে Logogram বা শব্দলিপি আখ্যা দিয়েছেন।

শব্দলিপি বিবর্তিতত হয়ে নাম নিল অক্ষরলিপি। শব্দলিটিতে ভাষায় ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের জন্য আলাদা প্রতীক বা চিহ্ন মনে রাখা সহজ ছিল না। পরবর্তী সময়ের লিপিতে বিভিন্ন ‘চিহ্ন’ একটি শব্দের সব ধ্বনিকে না বুঝিয়ে একটি Syllable বা অক্ষরকে নির্দেশ করতে থাকে। এই লিপিই Syllabogram বা অক্ষরলিপি নামে পরিচিত। অক্ষরলিপিতে চিহ্ন ব্যবহারের সংখ্যাও অনেক কমে আসে। অক্ষরলিপির পরিবর্তিত রুপের নাম হলো ধ্বনিলিপি বা Alphabetic Script প্রথমে একেকটি শব্দকে চিহ্নিত করা হতো একেকটি প্রতীক বা চিহ্ন হিসেবে। তারপর শব্দের প্রথম অংশ বা প্রথম সিলেবল ধরে একেটি প্রতীক বা ছবি ব্যবহৃত হতো। পরে প্রথম ধ্বনির প্রতীক হয়ে ওঠে সেই চিহ্ন। এভাবে লিপির বিকাশের চুড়ান্ত পর্যায়ে পাওয়া গেল বর্ণলিপি।

ভারত ছাড়া অধিকাংশ দেশের ভাষার লিপিতে ধরা পড়ে ধ্বনিমূলক বর্ণ। আর ভারতীয় লিপি সম্পূর্ণ ধ্বনিমূলকও নয়, সম্পূর্ণ অক্ষরমূলকও নয়। বাংলা লিপিও তা-ই। সাতটি লিপিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম লিপি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো সুমেরীয় লিপি, মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপি, ক্রিট দ্বীপবাসীর লিপি, হিত্তিলিপি, চীনালিপি, এলামবাসীর প্রাচীন লিপি ও সিন্ধু লিপি।

সিন্ধু লিপি-
সিন্ধু লিপি এ উপমহাদেশের প্রাচীনতম লিপি। সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া বিভিন্ন সিলমোহরে এই লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে জন মার্শাল সম্পাদিত Mohenjo-daro and the Indus Civilisation (১৯৩১) গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে সিন্ধু লিপির উৎস ও পাঠ সম্পর্কে প্লিতদের মন্তব্য বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। লিপিতত্ত্ববিদ গ্যাডগিল মনে করেন, সিন্ধু লিপি লেখা হতো ডান থেকে বাঁ দিকে। লিপিতত্ত্ববিদেরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের প্রাচীন লিপির সঙ্গে সিন্ধু লিপির সাদৃশ্য পেয়েছেন। সুমেরীয়, আফ্রিকা ও আরব দেশের কোনো কোনো ভাষার অক্ষরের সঙ্গে এই লিপির সাদৃশ্য রয়েছে।
খরোষ্ঠি লিপি-

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম বর্ণমালা দুটি-খারোষ্ঠি ও ব্রাহ্মী। ‘খারোষ্ঠি’ শব্দের মূল-খরপোস্তা। ভারতীয় আর্য ভাষার শব্দ ‘খর’ এবং ফারসি ভাষার শব্দ ‘পোস্তা’ মিলে খরপোস্তা শব্দ তৈরী হয়েছে। শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ গাধার চামড়া। খরোষ্ঠি লিপির প্রাচীনতম যে কয়েকটি নির্দশন মধ্য এশিয়ায় পাওয়া গেছে, তার অধিকাংশই উট, ঘোড়া বা গাঁধার চামড়ার পান্ডুলিপি। পাকিস্তানের প্রাচীনতম লিপি খরোষ্ঠি। খ্রিষ্টপূর্ন তিন শতক থেকে খ্রিষ্টীয় পাঁচ শতক পর্যন্ত খরোষ্ঠি লিপির ব্যবহার ছিল। বিভিন্ন স্থানে আবিস্কৃত খরোষ্ঠি লিপির নিদর্শন এ লিপির বহুল ব্যবহার প্রমাণ করে। খরোষ্ঠি লিপি ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লিখতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে মধ্য এশিয়াও খরোষ্ঠি লিপির প্রচলন ছিল।

ব্রাহ্মী লিপি-

ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানে প্রচলিত প্রায় সব লিপিই ব্রাহ্মী বর্ণমালা থেকে উদ্ভৃত। উপমহাদেশের বাইরের কয়েকটি লিপি, যেমন সিংহলী, বর্মি, যবদ্বীপি ও তিব্বতি লিপি এই বর্ণমালা থেকে এসেছে। খ্রিষ্টপূর্ব তিন শতকে সম্রাট অশোকের সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে উত্তর-পশ্চিমাংশ ছাড়া সব জায়গায় ব্রাহ্মী লিপির প্রচলন ছিল। এই লিপি ‘অশোক লিপি’ নামেও পরিচিত। অনেকের মতে, ব্রহ্মার কাছ থেকে পাওয়া বলে এর নাম ‘ব্রাহ্মী’। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, ব্রাহ্মণদের লিপি বলে এর নাম ‘ব্রাহ্মী’। ব্রাহ্মী লিপির নামকরণের সঙ্গে ব্রহ্মা বা ব্রাহ্মণদের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা, এটা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

কানিংহামের মতে, ব্রাহ্মী লিপি ভারতীয় উপমহাদেশেই উদ্ভূত। তিনি এ যুক্তির সমর্থনে বিভিন্ন বর্ণের সঙ্গে কোনো না কোনো বস্তুর আকৃতিগত সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, ধনুকের চিত্রের সঙ্গে ব্রাহ্মী লিপির ‘ধ’ মাছের আকৃতির সঙ্গে ‘ম’ বর্ণের সাদৃশ্য রয়েছে। ব্রাহ্মী লিপির পূর্ববর্তী কোনো লিপ এ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ-এ লিপি, লিপিকর, বর্ণ, অক্ষর প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, পাণিনির সময়ে খ্রিষ্টপূর্ব চার শতকে লিপির প্রচলন ছিল। অশোকের অনুশাসনে ব্রাহ্মী লিপির যে নির্দশন পাওয়া যায, তা সুগঠিত ও পরিণত। সুতরাং, এর আগে ব্রাহ্মী লিপির কোনো প্রাচীনতর রূপ থাকা স্বাভাবিক।

ব্রাহ্মী লিপি বাংলা লিপি-
ভারতে প্রচলিত ব্রাহ্মী লিপি দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে পরিবর্তিত হয়ে আজকের বাংলা লিপিতে রুপান্তরিত হয়েছে। খ্রিষ্টীয় এক শতক থেকে লিপির বিবর্তন শুরু হয়। ব্রাহ্মী লিপির বিবর্তনের ইতিহাসে পরবর্তী দুটি স্তরের নাম-কুষাণ লিপি ও গুপ্ত লিপি। খ্রিষ্টীয় এক থেকে তিন শতক পর্যন্ত কুষাণ রাজাদের আমলে কুষাণ লিপি প্রচলিত ছিল। এই লিপিতে ব্রাহ্মী লিপির বিভিন্ন বর্ণের বির্তন লক্ষ করা যায়। কুষাণ লিপির ছ, জ, থ, ধ, ট, ঠ বর্ণ ব্রাহ্মী লিপির অনুরুপ। এি লিপিতে ক, চ, ঝ, ড, দ, ন, প য বর্ণে সংক্ষিপ্ত মাত্রার ব্যবহার দেখা যায়। কুষাণ লিপির চ এবং ঢ বর্ণ দুটিতে বাংলা চ এবং ঢ বর্ণের আদিরূপের সন্ধান পাওয়া যায়।

খ্রিষ্টীয় চার ও পাঁচ শতকে গুপ্তলিপি ভাতরীয় উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল। গুপ্তবংশীয় রাজাদের দ্বারা এ লিপি প্রচারিত হওয়ায় এর নাম হয়েছে গুপ্ত লিপি। গুপ্ত লিপির অধিকাংশ বর্ণ সংক্ষিপ্ত মাত্রাবিশিষ্ট। এই লিপির কোনো কোনো বর্ণে কুষাণ লিপির প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু অধিকাংশ বর্ণেরই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে।

খ্রিষ্টীয় ছয় শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে যেসব লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে পূর্বাঞ্চল লিপি, উত্তরাঞ্চল লিপি ও দক্ষিণাঞ্চল লিপি। সাত শতকে পূর্বাঞ্চল লিপির দুটি ভাগ দেখা যায়া-পূর্বী ও পশ্চিমী। পশ্চিমী শাখার নগর লিপির প্রসার ঘটে সমগ্র উত্তর ভারতে। পরে এই নাগর লিপি থেকে দেবনাগরী লিপির জন্ম হয়। ৯ শতক পর্যন্ত ভারতের পূর্বাংশে পূর্বী লিপির প্রচলন ছিল। বর্ণের আকৃতি কিছুটা জটিল বা কুটিল ছিল বলেই এ লিপির নামকরণ করা হয় কুটিল লিপি। এই লিপির ব, ম, ন, জ, ক বর্ণে বাংলা বর্ণের প্রাচীন রূপ বিদ্যমান।

পূর্বী শাখার লিপি-
দশ শতকের শেষ দিকের রাজা প্রথম মহীপালের সময়ের কিছু পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে। এর অনেক অক্ষরের রূপ বাংলার কাছাকাছি। এই লিপিকে ১০ শতকের বর্ণলিপির নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। ১১ শতকের বাংলা লিপির নমুনা পাওয়া যায় বিজয় সেনের দেওপাড়া লিপিতে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এ সময়ের লিপির প্রায় ২২টি বর্ণে বাংলা হরফের রূপ পরিণত অথবা প্রায় পরিণত। ১২ শতকের লিপির নিদর্শন দেখা যায় লক্ষ্মণ সেনের আনুসুয়া লিপি, বিশ্বরূপ সেনের দানপত্র লিপি প্রভৃতি উপকরণে। ১৫ শতকের লিপির নমুনা মেলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ‘পুঁথিতে’।

১৬ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত বাংলা লিপির কিছু বৈচিত্র্য দেখা যায়। হস্তলিখনের দ্রুততার জন্য বা লিপিকারের লিপি-বিশিষ্টতার জন্য এ সময় কোনো কোনো বর্ণের আকৃতিগত পার্থক্য তৈরী হয়েছে। উনিশ শতকে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যাপক প্রচলনের পর বাংলা হরফ স্থায়ী রূপ লাভ করে। এর আগে ১৭৭৮ সালে নাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের ব্যাকরণ গ্রন্থে প্রথম বাংলা অক্ষর মুদ্রিত হয়। (তথ্য সূত্রঃ বিজ্ঞান চিন্তা, ফেব্রুয়ারী-২০২১।

লেখক: আইনজীবি, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট।

Continue Reading

মতামত

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আনন্দ মোহন কলেজে আনন্দ র‍্যালি

Avatar photo

Published

on

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্রলীগের আনন্দ র‍্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সোমবার সকালে আয়োজিত র‍্যালিটি আনন্দ মোহন কলেজের ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় আনন্দমোহন কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. নাজমুল ইসলাম সাকিব নেতৃত্ব দেন।

এ সময় তিনি বলেন, জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাবে ও শেখ মুজিবের আদর্শে কাজ করে যাবে ছাত্রলীগের প্রতিটি ইউনিট। সকল অপশক্তিকে রোধকল্পে আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্রলীগ ইউনিট সবসময় প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি।

Continue Reading

মতামত

দেশ গড়ায় ও রক্ষায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভূমিকা

Avatar photo

Published

on

সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- দেশ গড়ায় ও রক্ষায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভুমিকা প্রথম ও প্রধান এবং তা সর্বজন স্বীকৃত। কোন দেশ বা জাতি স্¦াধীনতার আলো তখনই দেখেছে, যখন তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চরম উন্নতি হয়েছে। যে জাতির সাংস্কৃতিক রূপরেখা নেই, সাংস্কৃতিক উন্নতি নেই, সাংস্কৃতিক চর্চা নেই সে জাতির কোন উন্নতিও হতে পারে না। এমন কি যে জাতি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে আছে, সে জাতি কোন দিনই স্বাধীনতার আলো দেখতে পায় না। পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে তাদের যুগ যুগ ধরে কাটাতে হয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলেই পৃথিবীর অনেক দেশ, অনেক জাতি স্বাধীনতার সুখ ভোগ করছে এবং উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছে। দেখা গেছে, সাংস্কৃুতিক অনুন্নতির ফলে অনেক দেশ অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশ গড়াতো দূরের কথা, স্বাধীনতা পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পরাধীনতার নাগ পাশে বন্দি হয়ে পড়েছে, হারিয়ে ফেলেছে তাদের জাতীয় স্বত্বা।

বিশেষ করে আমাদের দেশের আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যারা এক কালে বন জংগল কেটে পাহাড় পর্বত কেটে, নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে দেশ গড়ায় সক্রীয় ভূমিকা রেখেছিল, তারা আজ তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অভাবে সব থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। একদা তাদেরও নিজস্ব একটা সাংস্কৃতিক রূপরেখা ছিল। কিন্তু সেগুলোকে তারা চর্চার অভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। দেশ গড়ায় ও রক্ষায় তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভূমিকাকে খাটো করে দেখাকে কারো পক্ষেই উচিত হবে না। আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী জনগণ দেশ গড়ার কাজে প্রথম আত্ম নিয়োগ করেছে এবং দেশ রক্ষার জন্য তাদের ভুমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা। আমাদের দেশে ২৫৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠি রয়েছে এবং তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও ভিন্ন ভিন্ন। এই দেশে যখন পাক-বাহিনীর বে-পরোয়া হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল তখন সকল বর্ণের সকল গোত্রের মানুষ একত্রিতহয়ে তার মোকাবিলা করা কালে বিভিন্ন জাতির সাংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান সমূহ উৎসাহ জুগিয়েছিল। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আঞ্চলিক ভাষায় যে সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো, তাতে বিভিন্ন বাঙালি ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী জাতি উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘‘চরম পত্র’’ নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো যা তখন ছিল বাঙ্গালী জাতিকে জাগানোর মূল মন্ত্র। বিভিন্ন সংগীতে তথা ভাটিয়ালী গান, লোক সংগীত, আঞ্চলিক গান পৌছিয়ে দিয়েছিল বাঙ্গালি জাতিকে স্বাধীনতার চরম শিখরে। বিশ^ কবি কর্তৃক রচিত গান দিয়ে বাঙ্গালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা হতো। যা পরবর্তীকালে জাতীয় সংগীতে স্থান পায়।

বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম(বিদ্রোহী), পল্লী কবি জসীম উদ্দীনসহ আরো অনেক কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, গীতিকার তাদের সাংস্তৃতিক কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার ব্যাপাারে উৎসাহ জুগিয়েছিল এবং উদ্বুদ্ধ করেছিল। দার্শনিক ডেভিড হিউস বলেছেন,‘‘ নিদ্রালস জীবন মৃত জাতিকে উদ্বুদ্ধ ও সঞ্জীবিত করতে হলে সর্বাগ্রে জাতীয় সাহিত্যের উন্নতি করতে হবে।’’ উল্লেখিত প্রবীন দার্শনিকের কথা বিশ্লেষণ করলে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, যে জাতির বা সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক উন্নতি নেই, সেই জাতি কোন দিনই উন্নতি করতে পারে না। আমাদের বাঙ্গালি জাতিই এর প্রকৃষ্ট উদহরণ। পশ্চিমা গোষ্ঠীরা বাঙ্গালী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর চরম আঘাত হেনেছিল এবং তা ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এমনকি এক সময় এদেশ হতে রবীন্দ্র সংগীত, রবীন্দ্র কাব্য উঠিয়ে দিতে প্রাণ পণে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আদি কালের প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে পশ্চিমা জনগোষ্ঠীকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিতে হয়েছে এবং তাদের পরিনতী হয়েছে করুন ও ভয়াবহ। যার ফলে বাঙ্গালির একটি স্থায়ী আবাস ভূমির জন্ম হয়েছে; তার নামই বাংলাদেশ।

বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটি সুর ছিল-আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। আদিবাসী জনগণ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিকে ঠিক রেখে বাঙ্গালির সাথে মিলে মিশে পশ্চিমা সাংস্কৃতিকে চির নির্বাসন দিয়েছে এবং বাংলাদেশেও তাদের এ ব্যাপারে অংশ রয়ে গেছে। আদিবাসীরা অতি সহজ সরল হওয়া স্বত্বেও তাদের নিজস্ব একটা সাংস্কৃৃতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে। তাই বাংলাদেশ গড়ায় ও রক্ষায় তাদের অবদান অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই। তারাও বাঙ্গালির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং দেশকে স্বাধীন করেছিল। যেমন পাঁচবিবি থানায় মুক্তি যুদ্ধের ভাস্কর্য এবং রংপুরের মর্ডান মোড়ে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য পরিলক্ষিত হয়।

আদিবাসী সম্প্রদায় দীর্ঘদিন বাঙ্গালিদের সাথে বসবাস করায় এবং একসাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে , বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ায় তাদের কিঞ্চিত এক মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দেশ গড়ার কাজে এবং দেশ রক্ষার কাজে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভুমিকা রয়েছে। আদিবাসীরাও তাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হতাশাগ্রস্থ মানুষের মাঝে প্রাণের সঞ্চার করেছে। মানুষকে আশার আলো দেখিয়েছে, উৎসাহ -উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে। সাধারণ মানুষের মাঝে শক্তি সঞ্চার করেছে, বিভিন্ন যাত্রা, নাটক, পালা গান, জারী গান, বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাহায্যে সামাজিক অবক্ষয় দূরিভুত করে নতুন ভাবে সমাজ তথা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। আদিবাসী জনগণ তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করে ই ক্লান্ত হয়নি, বরং দেশ রক্ষার কাজেও লিপ্ত রয়েছে।

বর্তমানে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেমন- আদিবাসীর সাংস্কৃতি সংরক্ষনের কোন ব্যবস্থা না থাকা, সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবে সাংস্কৃতি বিলুপ্ত হওয়ার মতো, কারণ সাংস্কৃতি সংগঠনের অভাব। সমাধানের উপায় হলো- সাংস্কৃতিক সচেতনতা গড়ে তোলা। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে এমনকি গ্রাম ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় সরকারি প্রচার মাধ্যমে অনুষ্ঠান মালা নিয়মিত ভাবে প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সাংস্কৃতিক রক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়/পি-স্কুলের পাঠ্যসূচীতে সাংস্কৃতিক বিষয় অন্তভর্’ক্তকরা প্রয়োজন।এর ফলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিকশিত হবে এবং দেশ গড়ায় ও রক্ষায় অংশ গ্রহণ করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ভুমিকা পালন করতে পারবে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দূর্বল থাকায় দেশ গড়া তো দূরের কথা স্বাধীনতাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ পাকিস্তানের কথা বলা যায়-পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল দুটো অংশ নিয়ে। একটি পূর্ব পাকিস্তান, অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। মাঝখানে বিশাল ভারত রাষ্ট্র। পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতির সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কোনরূপ মিলছিল না। শুধু যে অমিল ছিল তা নয়, পশ্চিমা গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল।পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙ্গালির সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসরত জনগণের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, ভাষাও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কাজেই পাকিস্তানের দুই অংশের সাংস্কৃতিক রূপও ছিল ভিন্নতর। যার ফলে দেশ গড়া ও রক্ষা হওয়া তো দূরের কথা, পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম হয়। আজ বাঙ্গালি স্বাধীনভাবে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মনের সুখে চালিয়ে যােেচ্ছ। কোন বাধা বিপত্তি নেই এবং পশ্চিমা গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপ নেই। নিজের দেশ গড়তে এবং রক্ষা করতে বাঙ্গালিরা তথা সকল স্তরের লোক আত্মনিয়োগ করেছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই হচ্ছে তার ধারক ও বাহক। বাংলাদেশে যত জনগোষ্ঠীই থাকুক না কেন; সবাই আমরা বাঙ্গালি এবং এই বাঙ্গালি পরিচয়ে বাংলাদেশের জনগণ গর্ববোধ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে সমস্ত জনগোষ্ঠী একত্রিত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরেছিল এবং তার ফলশ্রুতিতেই অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতার সুখ পেয়েছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সমস্ত বাঙ্গালি তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিশে^র দরবারে তুলে ধরেছিল। বিশ^বাসী দেখেছিল আদিবাসীসহ সকল বাঙ্গালী একত্রিত হয়ে পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং বিশে^র অনেক দেশ খুশি মনে বাঙ্গালিকে তথা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।আজ স্বাধীন বাংলায় বাঙ্গালিরা সকল জাতি ভেদ ভুলে গিয়ে একত্রিত হয়ে বাংলাদেশ গড়ায় এবং রক্ষায় নিজ নিজ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে সক্ষম। এমন বাঙ্গালীরা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকাাণ্ডের মাধ্যমে দেশ গড়ায় ও রক্ষায় ব্যস্ত এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। বাংলাদেশ সরকার সাংস্কৃতির বিষয় চিন্তা-ভাবনা করে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদী সম্পর্কে বিধান প্রনয়ন কল্পে প্রণিত আইন তৈরী করেছেন। আইনটির নাম- ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ্আইন-২০১০।
সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষকে যত দ্রুত উদ্বুদ্ধ করা যায় অন্য কোন কার্যক্রমের মাধ্যমে তা করা যায় না। যুদ্ধের সময় দেখা যায়, সৈনিকদের মধ্যে এবং জনগণের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা বা শক্তি সঞ্চার করার জন্য বীর রসের গান, কবিতা আবৃত্তি প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, শক্তি ও সাহস জুগিয়েছিল, বাঙ্গালিকে একত্রিত করেছিল, বিশ^বাসীকে অবগত করিয়েছিল বলেই আমাদের ন্যায্য দাবী আদায় করতে পেরেছিলাম। যার ফলে মাত্র ৯ মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল এবং পাকিস্তানী বাহিনী পরাজিত হয়েছিল। এখন দেশ গড়া ও রক্ষার জন্য সমাজের সকল স্তরের জনগণ মনযোগী হয়েছে এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখন স্লোগান হয়েছে- কাউকে পিছনে ফেলে উন্নয়ন নয়।

সমাজের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যেমন দেশের উন্নয়ন, তেমনি সাংস্কৃতিক উন্নয়ন মানেই একটি জাতির উন্নয়ন। সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটি জাতি অনুন্নত থাকলে সেই জাতি পৃথিবীর বুকে সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। সাংস্কৃতির প্রধান বাহন হিসাবে সংগীতকে চিহ্নিত করা যায়। যেহেতু স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন শিল্পী, সাহিত্যিক তাদের সংগীতের মাধ্যমে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে ঘুমন্ত মানুষগুলোকে জাগিয়ে তুলেছিল। তখন স্লোগান ছিল- জেগেছে জেগেছে বাঙ্গালি জেগেছে, রক্ত দিয়েছি, আরও দেব, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা যমুনা, তোমার আমার পরিচয় কি, বাঙালি বাঙ্গালি, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১ শে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি? বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। জয়, জয়, জয় বাংলার জয়, হবে হবে হবে নিশ্চয়। এহিয়া ভুট্টো দুই ভাই, এক রশিতে ফাঁসি চাই।’’ ভুট্টোর মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি স্লোগাণ ও গান বাজনার মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন করেছে। পৃথিবীতে যত গুলো দেশ স্বাধীন হয়েছে তার প্রেরণা রয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। এমন কি যুদ্ধের ময়দানে, যুদ্ধের আগে বা পরে উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হওয়ার রেওয়াজ বহুকাল হতে চলে আসছে।

প্রত্যেক দেশে আগের দিনে রাজা বাদশাগণ সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধনের জন্য দেশ গড়ার জন্য বেতন ভাতা দিয়ে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের নিয়োগ করতেন, তাকে বলা হতো রাজ কবি। এখনও রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়- জাতীয় কবি, কাজেই আমরা বলতে পারি যে, দেশ গড়ায় ও রক্ষায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, সাংস্কৃতি একটি জাতির পূর্ন পরিচয় বহন করে, এটি একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের মূল স্বত্বা একটি পূর্নাঙ্গ জীবন বোধ। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পালন, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ করা পবিত্র দায়িত্ব। তবে সংস্কৃতিতে কোন খারাপ দিক বা অবৈজ্ঞানিক কোন বিষয় থাকলে তা অবশ্যই বর্জন করা উচিত, যদি কোন ভাল দিক থাকে যা উন্নয়নমুখী কল্যানকর এবং দেশ গড়ায় এবং রক্ষায় সহায়ক ভুমিকা পালন করে তা অবশ্যই গ্রহণ ও উৎসাহিত করা উচিৎ। তাই আমরা বলিষ্ঠ কন্ঠে বলতে পারি দেশ গড়ায় ও রক্ষায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ভুমিকা খ্বুই গুরুত্বর্পূণ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই মোটেই।

বাবুল রবিদাস
এ্যাডভোকেট
জজ কোর্ট, জয়পুরহাট।

Continue Reading