৭ মাসে ইয়াবা সেবন বেড়েছে ৪৭ শতাংশ
স্টাফ রিপোর্টার:
দেশে আবারও বেড়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দৌরাÍ। চলতি বছরের শুরুতে কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান চালায় র্যাব-পুলিশ। এরপর র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে তালিকাভুক্ত দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত হলে অন্যরা গা-ঢাকা দেন। এর পর কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েন তারা। এর ফলে বেড়ে যায় ইয়াবার মূল্য। তবে কয়েক মাস পরই আগের অবস্থা ফিরে আসে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ইয়াবা সেবন ৪৭ শতাংশ বেড়েছে। সূত্রমতে, বর্তমানে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, চট্টগ্রামসহ মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা আসছে রাজধানীতে। ব্যাপকভাবে চাহিদা বাড়ায় মূল্যও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। গত ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে দেশে এনেছেন অবৈধ ব্যবসায়ীরা। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখেও তারা একই রকম প্রস্তুতি নিয়েছেন। এখন ইয়াবার চালান রাজধানীতে আসছে পাজেরোর মতো বিলাসবহুল গাড়িতে। কোরিয়ারের পার্সেলে করে ছোট ছোট চালান পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বিক্রেতাদের হাতে। পরিবহণের ঝুঁকি এড়াতে কোনো কোনো কারবারি রাজধানী ও চট্টগ্রামে ইয়াবা তৈরির কারখানা স্থাপন করেছেন। পুলিশ, র্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ফের তৎপর হওয়ার খবরে অভিযানে নেমেছে সংশ্লিষ্টরা। গত দুই দিনে অভিযান চালিয়ে ৫৭ হাজার ইয়াবাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও ডিএনসি। আবদুল্লাহ জোবায়ের নামের এক শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী পাজেরো গাড়িতে করে কক্সবাজার থেকে নিয়ে আসেন ইয়াবার চালান। শুধু তাই নয়, রাজধানীর নিকেতন এলাকায় আবাসিক বাড়িতে ইয়াবা তৈরির সরঞ্জামও এনেছেন তিনি। র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, “সম্প্রতি গ্রেপ্তারকৃত কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ইয়াবা ব্যবসার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। ঈদ সামনে রেখে তারা আবার অপতৎপরতা শুরু করেছে। আমারও নজরদারি বাড়িয়েছি।” ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ইয়াবা আনার পথে ঝুঁকি এড়াতে শীর্ষ ব্যবসায়ীরা এখন ঢাকায় কারখানা গড়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। গ্রেপ্তার হওয়া জোবায়ের আগে চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে ইয়াবা তৈরি করেছেন। সেখানে সফল হওয়ার পর তারা ঢাকাতেই ইয়াবা উৎপাদনের পরিকল্পনা করেন। ডিবির উপকমিশনার (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর জানান, জোবায়ের নামে কক্সবাজারের এক ইয়াবা ব্যবসায়ী প্রতি মাসে চার-পাঁচটি ইয়াবার চালান ঢাকায় আনতেন। প্রতি চালানে কমপক্ষে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা থাকতো। প্রতি পিস ইয়াবা কক্সবাজার সীমান্তে তারা কেনেন ১৩০ টাকায় এবং ঢাকায় পাইকারি বিক্রি করেন ১৮০ টাকায়। তবে খুচরা ক্রেতা পর্যায়ে একটি ইয়াবা ট্যাবলেট মানভেদে তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। প্রচুর লাভ হওয়ায় অনেক অসাধু ব্যক্তিই ইয়াবা ব্যবসায় ঝুঁকেছেন। জোবায়ের এরই মধ্যে গুলশানের নিকেতনে দুটি ফ্ল্যাট ও একটি পাজেরো কিনেছেন। বনশ্রীতে একটি ফ্ল্যাট কিনে বা ভাড়া নিয়ে সেখানে কারখানা করার পরিকল্পনা ছিল তার।
সম্প্রতি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকা থেকে প্রায় ৩০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও ১২ লাখ টাকাসহ চার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। অভিযান পরিচালনাকারী র্যাব-১০ এর মেজর তৌফিকুল বারী বলেন, “দলনেতা হেলালের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফের পশ্চিম লেদায়। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ হয়ে ইয়াবার চালান নিয়ে এরা ঢাকায় ঢোকে। এর আগেও একাধিকবার গ্রেপ্তার হয় হেলাল। তিনি ঢাকার একটি বাসায় ইয়াবা মজুদ করে তা সারা দেশে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করে। এরা কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে বছরের বিভিন্ন সময় ইয়াবার বড় বড় চালান ঢাকায় আনে। ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে এরা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। এর পরপরই সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের একটি পার্সেলের ভেতরে সাড়ে চার হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করেন র্যাব-৩ এর সদস্যরা। সম্প্রতি কমলাপুর থেকে তিনটি ইয়াবার চালান জব্দ করা হয়।” ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক আবু তালেব বলেন, “মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে ছড়িয়ে দেয়া মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে। এ তালিকা ধরে র্যাব-পুলিশ কক্সবাজার-টেকনাফে ব্যাপক অভিযান চালায়। এরপর অনেক ব্যবসায়ী গা-ঢাকা দেন। এ বছরের শুরুতে র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিয়ের ঘটনায় তালিকাভুক্ত দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহতও হয়েছেন। তবে সম্প্রতি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এসব চক্র।”
ডিএনসির এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১২ সালে দেড় হাজার শতাংশের বেশি ইয়াবা সেবন বেড়েছে। একই হারে বিক্রি বেড়েছে। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে তা বেড়েছে ৩২ শতাংশের বেশি। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। ২০০৯ সাল থেকেই বাংলাদেশ ইয়াবা পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারত ও গোল্ডেন ট্রায়েঙ্গেল এর শীর্ষ স্থানীয় গডফাদাররা ব্যাপক অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণেই মাদক ব্যবসার জন্য ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছেন। র্যাব-পুলিশের তথ্যমতে, মিয়ানমার থেকে এক পিস ইয়াবা ৭৫ টাকা কিনে দেশে ঢোকার পরই সর্বনিন্ম পাঁচশ’, সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।