যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যৎ কি?
জামায়াতের আমির ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মীর কাশেম আলীসহ জামায়াতে ইসলামীর মোট পাঁচজন শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো। দলটির প্রথম সারির যেসব নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ছিল সেই নেতাদের যুগেরও অবসান হলো বলে মনে করা হচ্ছে। বেশ কিছুদিন যাবৎ দল হিসেবেও জামায়াত ইসলামী একেবারেই নিরব। দলটির শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিতে এখন জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যৎ কি হতে পারে?
রাজনীতির শিক্ষক দিলারা চৌধুরী বলছেন, জামায়াতের নতুন নেতৃত্বকে তাদের ১৯৭১ সালের ভূমিকা স্বীকার করে দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করতে হবে। তবেই দলটির পুনর্জীবন সম্ভব।
তিনি বলছেন, “প্রথম কথা হলো জামায়াতের এই যে মনোভাব আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো অপরাধ করি নি, সেব্যাপারে জনগণের কাছে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। দলের নতুন নেতৃত্বকে এটা করতে হবে। বাংলাদেশকে যে তারা ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার করতে চায়, এটাও পরিবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে মেনে নিতে হবে। এসব পরিবর্তন আনলেই দলটির পুনর্জীবন সম্ভব। কারণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতাই সবচে বড় কথা।”
তিনি মনে করেন, “দলটি ক্যাডার-ভিত্তিক দল এবং তাদের কার্যক্রম বেশ শক্ত। তৃনমূল পর্যায়ে নেতাদের ভাল নেটওয়ার্ক আছে। তাদের দিয়ে পার্টি পুনর্জীবিত করা সম্ভব যদি তারা ঐ পরিবর্তনগুলো আনে।”
জামায়াতে ইসলামীর অর্থের যোগানদাতা ছিলেন মীর কাসেম আলী
জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি অনেকদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছেন বাংলা দৈনিক নয়া দিগন্তের উপদেষ্টা সম্পাদক সালাহউদ্দিন বাবর। তিনি বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর জন্ম নেয়া জামায়াতের তরুণ নেতৃত্ব ইতোমধ্যেই দলটিকে গোছানোর চেষ্টা করছে।
“জামায়াত কখনোই একক নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল দল ছিলো না। দলটি সবসময় কালেকটিভ নেতৃত্বের দল। প্রবীণ যাদের শাস্তি হয়েছে তাদের বাইরে এখন যারা নেতৃত্বে আসবেন তারাও সেই পথেই এগুবে বলে আমার মনে হয়,” বলেন তিনি।
তিনি আরো বলছেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগমুক্ত তরুণদের নিয়েই এখন জামায়াতে ইসলামী গঠিত হচ্ছে। তারা নিজেদেরকে গোছাচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রথম বড় রায় ছিলো জামায়াতের সহকারী মহাসচিব আব্দুল কাদের মোল্লাহর মৃত্যুদণ্ড।
তবে দলটির সিনিয়র নেতা দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পর বাংলাদেশে বড় ধরনের সহিংসতা দেখা গেছে। এই সহিংসতার জন্য ব্যাপক সমালোচিত হয় জামায়াতে ইসলামী।
এরপর পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচনের সময় পর্যন্ত দলটি সক্রিয় ছিলো। কিন্তু এর পর থেকে আর সক্রিয়ভাবে দলটির নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা যায়নি। শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিতে দলটির অবস্থা এখন ভঙ্গুর বলা চলে।
জামায়াতে ইসলামী এখন ওয়েবসাইট নির্ভর দল হয়ে পড়েছে
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকালীন দল হিসেবেও জামায়াতের বিচারের বিষয়টি সামনে এসেছে।
অন্যদিকে দলটির নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত নেতাদের যুগের অবসানের পর আওয়ামী লীগ কি দলটি সম্পর্কে তাদের মনোভাব পরিবর্তন করবে?
আ. লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুহ-উল-আলম লেনিনের বক্তব্যে তা একেবারেই মনো হলো না। তিনি বলছেন, “যে লোকগুলো যুদ্ধাপরাধের সাথে যুক্ত হয়েছে তারা ব্যক্তিগতভাবে নয় বরং দলের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গিয়েই তারা যুদ্ধাপরাধী হয়ে উঠেছে। জামায়াতে ইসলামী কখনোই যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি বা অতীতে তারা ভুল করেছে এই কথাটিও তারা বলেন নি। বরং তারা তাদের অতীতের কর্মকাণ্ডের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা দরকার। দলীয় শাস্তি হিসেবেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা দরকার।”
মি. লেনিন আরো বলছেন, “নির্বাহী আদেশের বলে যেভাবে কয়েকটি জঙ্গিবাদী সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছে জামায়াতকে আমরা সেই মাপে মাপি না বলে আমরা চাই স্বচ্ছতার সাথে জামায়াত সম্পর্কে যে অভিযোগগুলো রয়েছে সেইগুলো বিবেচনায় নিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা দরকার।”
অন্যদিকে, গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কে রায় বা তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর শুধুমাত্র ওয়েবসাইটে হরতাল কর্মসূচি দেয়ার মধ্যেই জামায়াতের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রয়েছে।
ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই সব ধরনের দলীয় বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীকে। তবে জামায়াতের ডাকা হরতাল বা অন্য কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষজনের কাছ তেমন একটা সাড়া পড়তে দেখা যায়নি।