Connecting You with the Truth

সাজা কমিয়ে সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড, প্রতিবাদে দুই দিনের হরতাল ডেকেছে জামায়াত

sayde picস্টাফ রিপোর্টার:
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ গতকাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই রায় ঘোষণা করে। বেঞ্চের বাকি চার সদস্য বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী এ সময় এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর আজ ও আগামীকাল সারাদেশে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।
এই মামলায় সাঈদী ও রাষ্ট্রপক্ষের দুটি আপিল ছিল। আদালত উভয়টির আংশিক মঞ্জুর করে। রায়ে ১০, ১৬, ১৯ নম্বর অভিযোগে জামায়াতের এই নায়েবে আমিরকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। আর ৮ নম্বর অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৭ নম্বরের জন্য ১০ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। ৮ নম্বর অভিযোগের অপর অংশসহ ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে আগুন দেয়ার দু’টি অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাত্তরের রাজাকার সাঈদীর ফাঁসির রায় দিয়েছিল।
একাত্তরে ‘স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা’র কারণে দেইল্যা রাজাকার নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমানোর রায় আসায় তাৎক্ষণিকভাবে আদালতের বাইরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা ছিল মৃত্যুদণ্ড। ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছিল তা বহাল থাকবে এটাই ছিল প্রত্যাশা। সেটা থাকেনি। আমার খুব খারাপ লাগছে।” তবে আপিল বিভাগের রায়ের পর ‘ধর্মীয় নেতা’ হিসাবে সাঈদীর মুখোশ খুলে গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাইনি। হাতে পেলে বুঝতে পারব কোন কোন জায়গায় আরো তথ্য প্রমাণ প্রয়োজন ছিল।” তিনি বলেন, “সর্বোচ্চ শাস্তি আমাদের প্রত্যাশিত ছিল। তবে আমরা আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।” সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, “আমরা এ রায়ের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। খালাস আশা করেছিলাম।”
এই জামায়াত নেতার ছেলে মাসুদ সাঈদী রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “ফাঁসি কমে আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে। তারপরও আমরা বলব যে ন্যায়বিচার পাইনি। আমাদের প্রত্যাশা ছিল নির্দোষ প্রমাণ হয়ে বেকসুর খালাস পাব। আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর রিভিউ আবেদন করব।” এই রায়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে দ্বিতীয় আসামির মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো। এর আগে তার দলেরই নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার আপিল নিষ্পত্তির পর গত বছরের ডিসেম্বর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাঈদীর বিচার শুরু হয় ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো অপরাধে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের পর সারা দেশে সহিংস বিক্ষোভে নামে জামায়াতকর্মীরা। তাদের তাণ্ডবে প্রথম তিন দিনেই নিহত হন পুলিশসহ অন্তত ৭০ জন। গাড়ি, বাড়ি এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্রও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে শুনানি শেষে গত ১৬ এপ্রিল তা রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখে আপিল বিভাগ। তার পাঁচ মাস পর এই রায় এলো।
এদিকে আজ ও আগামী রোববার সারা দেশে মোট ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ গতকাল রায়ের পর এক বিবৃতিতে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, প্রথম দফায় বৃহ¯পতিবার (আজ) ভোর ৬টা থেকে শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা এবং দ্বিতীয় দফায় রোববার ভোর ৬টা থেকে সোমবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা সারা দেশে হরতাল হবে। এছাড়া শুক্রবার সাঈদীর জন্য দোয়া অনুষ্ঠান এবং শনিবার সারা দেশে বিক্ষোভ করবে দলটি।
মকবুল আহমাদ বিবৃতিতে বলেন, “বারবার তিনি (সাঈদী) এ সরকারের চরম জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সরকারের সাজানো মিথ্যা মামলায় আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও তিনি ন্যায় বিচার বঞ্চিত হয়ে চরম জুলুমের শিকার হলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়ে ন্যায় বিচার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এ রায় বহাল থাকলে কোটি কোটি জনতার প্রাণপ্রিয় এ মানুষটিকে জেলের ভিতরেই ইন্তেকাল করতে হবে।” বিবৃতিতে তিনি আরো দাবি করেন, “সরকার এ মামলায় তাকে (সাঈদী) ফাঁসানোর জন্য নানান ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। বেলজিয়াম থেকে পাঠানো জনৈক জিয়াউদ্দীনের পাঠানো চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারের উপর ভিত্তি করে চার্জ গঠন করা হয়। ধান চোর, কলা চোর, ট্রলার চোর, যৌতুক আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত ও বিভিন্নভাবে সরকারি সুযোগ সুবিধা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করে সরকার।” জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির বলেন, “সরকারের সকল প্রকার উস্কানি চরম ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা ও সকল ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের বিরুদ্ধে সজাগ ও সতর্ক থাকার জন্য জামায়াতের সর্বস্তরের কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্খী ও দেশপ্রেমিক জনতার প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।”
গত মঙ্গলবার রায়ের দিনক্ষণ ঘোষণার পর থেকেই সারা দেশে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানীসহ সারা দেশে আদালত, সরকারি দপ্তর, পেট্রোল পা¤পসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনায় মঙ্গলবার থেকেই নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়। রায় ঘিরে সুপ্রিম কোর্ট এলাকাতেও নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। আর্চওয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা করে আইনজীবী-সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতে ঢুকতে দেয়া হয়। ৭৪ বছর বয়সী সাঈদী বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে কারাবন্দি তিনি। তবে এর মধ্যে মা ও ছেলের মৃত্যুর পর দুই দফায় কয়েক ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন পিরোজপুর থেকে দুই বার নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর একে একে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় তাদের, চলতে থাকে বিচার। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম রায়ে ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক থাকায় তিনি এর বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেননি। এর পরের মাসের ৫ তারিখে দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আপিল শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট গত বছরের ১৭সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ১২ ডিসেম্বর ওই দণ্ড কার্যকর হয়। ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের আজীবন কারাদণ্ড হয়। মৃত্যুদণ্ড হয় দলটির নেতা আলী আহসান মো. মুজাহিদ, মো. কামারুজ্জামানের।

 

 

Comments
Loading...