Connect with us

বিশেষ নিবন্ধ

এ পৈশাচিকতার শেষ কোথায়? ভয়াবহ পৈশাচিকতা ও নিষ্ঠুরতা! মানুষগুলো এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? এ থেকে বাঁচার উপায় কী?

Published

on

এ পৈশাচিকতার শেষ

রাকীব আল হাসান : 

মানুষ একটি সাধারণ প্রাণী হিসাবে জন্মগ্রহণ করে আস্তে আস্তে মনুষ্য ধর্ম প্রাপ্ত হয়ে মানুষের স্তরে ওঠে। এই মনুষ্য ধর্ম হলো মানবতা। এক পিতার মধ্যে সন্তানের প্রতি যে ভালোবাসা থাকে তা পিতৃধর্ম, ছেলে-মেয়ের প্রতি মায়ের মমতা হলো মাতৃধর্ম, ভায়ের প্রতি ভায়ের যে প্রেম তা ভ্রাতৃধর্ম। আর মানুষের প্রতি মানুষের যে প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা সেটি হলো মনুষ্যধর্ম। সন্তান কষ্টে থাকলে মা-বাবার মনেও সুখ থাকে না, সন্তানের কষ্ট দূর করার জন্য সে আপ্রাণ চেষ্ট করে। বাবা-মা হিসাবে এটা তাদের কর্তব্য। মানুষ কষ্টে থাকলে অপর মানুষও কষ্টে থাকবে, অপরের কষ্ট দূর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে- এটা মানুষ হিসাবে তার কর্তব্য, এটাই তার ইবাদত। এই ইবাদতের জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা। সন্তানকে কষ্ট দিয়ে কি কখনো তার বাবা-মায়ের ভালোবাসা পাওয়া যায়? ঠিক একইভাবে আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি মানুষকে কষ্টে রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া সম্ভব নয়।

মানবসমাজের প্রধান উপাদানই হলো এই মনুষ্য ধর্ম তথা মানবতা, মনুষ্যত্ব। মনুষ যখন এটি হারিয়ে ফেলে তখন সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়। আর সমাজ ধ্বংস হয়ে গেলে মানুষের সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা সব ভূলুণ্ঠিত হয়। আজ মানুষ তার মানবতা, মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়ে গেছে, ফলে আমাদের সমাজ যেন আজ হিংস্র জন্তু-জানোয়ারে পূর্ণ গহীন অরণ্য।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ কবি ও ঔপন্যাসিক স্যার উইলিয়াম গোল্ডিং বলেছেন, “মানুষের আদিমতা ও হিংস্রতা সহজাত। সেরকম বুনো পরিবেশ পেলে মানুষ তার সভ্যতার লেবাস খুলে হিংস্র হয়ে ওঠে।” এ সমাজের মানুষগুলি যেন বুনো পরিবেশ পেয়ে সভ্যতার লেবাস খুলে বুনো উল্লাসে মেতে উঠেছে।

সম্প্রতি দেশে একের পর এক যেভাবে পৈশাচিক নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে তা মানুষরূপী দু’পেয়ো জানোয়ার বাদে অন্য কোনো জন্তুর পক্ষেও সম্ভব নয়। গত সোমবার বিকেলে খুলনার টুটপাড়ার এক মোটর গ্যারেজে রাকিব (১৩) নামের এক শিশুকে কমপ্রেসর মেশিনের মাধ্যমে মলদ্বার দিয়ে বাতাস ঢোকানো হলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। একপর্যায়ে মৃত্যুই হয় তার নিয়তি। ওই গ্যারেজের কাজ ছেড়ে দিয়ে আরেকটি গ্যারেজে কাজ নিয়েছিল। দোষ বলতে এটুকুই!

সোমবারই গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক¤পাউন্ডে লাগেজের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় ৭ থেকে ৮ বছরের এক শিশুর লাশ। হাসপাতালের বহির্বিভাগ সংলগ্ন নার্সিং কলেজের সামনে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় কালো রংয়ের ওই লাগেজটি। পুলিশ বলেছে, শিশুটির শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছাড়াও আয়রনের ছ্যাঁকার দাগ রয়েছে। হত্যার পর ওই শিশুটির লাশ কে বা কারা সেখানে ফেলে রেখে গেছে। এ ছাড়া ঐ দিন ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীতে পৃথক ঘটনায় চারজনের অপমৃত্যু হয়।

পরদিন মঙ্গলবার চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার তারাপুর গ্রামের কামারবাড়িতে কবিরাজি চিকিৎসার নামে বাবা এমরান হোসেন ও মা আমেনা বেগম বেদম পিটুনি দিয়ে মেরে ফেলেছেন তাঁদেরই শিশু সন্তান সুমাইয়াকে (১০)। কী করেছিল সুমাইয়া? ওকে জিনে ধরেছে! এই ‘জিন তাড়ানো’র পিটুনি খেয়েই রক্তক্ষরণে মারা গেছে মেয়েটি।

এর কিছুদিন আগে মাত্র ২৫দিন বয়সী শিশু সন্তানকে হাসপাতালের সাত তলা থেকে ছুড়ে ফেলে নির্মমভাবে হত্যা করে ফজলুল হক নামের এক পাষণ্ড পিতা। পরে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে সে বলে “স্যার আমিই হত্যা করছি আমার বাচ্চারে। ভাবছিলাম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতে ও এমনিতেই মারা যাবে। মরলো না। বরং ডাক্তারদের সেবায় অলৌকিকভাবে বেঁচে উঠলো। তাই বাচ্চারে হাসপাতাল থেকে যাবার আগে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করি।” স্ত্রী বাকপ্রতিবন্ধী। সন্তানটিও জন্মের পর মারাÍক অসুস্থতায় পড়েছে। হয়তো সন্তানটিও প্রতিবন্ধী হবে- এমন আশঙ্কা থেকেই শিশুটিকে হত্যা করে ঐ পাষণ্ড।

গত ২৩ জুলাই মাতৃগর্ভ থেকেই গুলিবিদ্ধ হয় এক শিশু। হাসপাতালে ভূমিষ্ঠ হবার পর যার নাম দেওয়া হয়েছে সুরাইয়া। এর কিছু দিন আগে সিলেটে অমানুষিক নির্যাতনে মারা যায় শিশু রাজন। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল ভিত্তিহীন চুরির অভিযোগ। এধরনের পৈশাচিক শিশু নির্যাতনসহ নানা রকম সামাজিক অপরাধ, রাজনীতিক দাঙ্গা, বহুমুখী অন্যায়-অবিচারের ঘটনা ঘরে-বাইরে অহরহ ঘটছে। এর স্থায়ী কোনো সমাধান কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। ঘটনার রেশ ধরে কিছুদিন প্রতিবাদ, অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন, মিছিল ইত্যাদি চলে। এর ফলে অপরাধীরা গ্রেপ্তারও হয়, মামলা হয়, দিনের পর দিন ঝুলে থাকে তা, কখনো কখনো বিচারও হয়। কিন্তু অপরাধ কমে না। এর মধ্যেই ঘটে চলে শিশুকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা, শিশুকে মেরে লাশ সুটকেসে ভরে ফেলে দেওয়া, ফুঁসলে নিয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো। শান্তির জন্য এত চেচামেচি, এত লেখা, এত কথা, এত শান্তির প্রচার- কিছুই হচ্ছে না। শুধু হচ্ছে না নয়, সমস্ত রকম পরিসংখ্যান (ঝঃধঃরংঃরপং) বলে দিচ্ছে যে, একমাত্র যান্ত্রিক উন্নতি ছাড়া আর সমস্ত দিক দিয়ে মানুষ অবনতির পথে যাচ্ছে- এবং দ্রুত যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে খুন, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি সর্বরকম অপরাধ প্রতি বছর বেড়ে চলেছে বরং বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এমন কোন দেশ নেই যেখানে অপরাধের সংখ্যা কমছে। এর শেষ কোথায়? এর পরিণতি চিন্তা করে সুস্থ মস্তিষ্ক মানুষ আজ দিশাহারা। তাহলে উপায় কী? মানুষের ভবিষ্যৎ নিদারুণ পরিণতিকে এড়াবার পথ কী?

মানুষের তো কথা ছিল নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার। কথা ছিল সমাজের একটি মানুষের দুঃখ, দুর্দশায় পুরো সমাজের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠার। তাহলে কীসে মানুষকে তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখছে?

অন্যায়, অবিচার, হিংসা, বিদ্বেষ, রক্তপাত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে, ভবিষ্যৎকে করছে আরও বিপদজনক। মানবসমাজে পারস্পরিক আস্থা বিকল্পহীন একটি অমূল্য সম্পদ, অথচ আজ কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসহীনতা এমন এক হাহাকারের রূপ নিয়েছে যে, রাস্তা-ঘাটে, অলি-গলিতে হেঁটে চলা মাত্র দু’জন মানুষও একে অপরকে ছিনতাইকারী বলে সন্দেহ করতে থাকে। আর যার ব্যবসায়িক বা রাজনীতিক প্রতিপক্ষ আছে তার প্রতিটি মুহূর্তই কাটে আতঙ্কে। একটা মেয়ে কোথাও পথ হারিয়ে ফেললে কাউকে জিজ্ঞেস করতেও ভরসা পায় না। মানুষগুলো যে সুস্থ শরীরে জীবিত আছে, সেটাই যেন তার অনেক বড় পাওয়া। বস্তুত সমাজ যখন স্বার্থচিন্তার মোহে অন্ধ হয়ে অনিরাপত্তায় ছেয়ে যায়, নৈতিক শিক্ষার অবমূল্যায়নের ফলে যখন প্রতিটি মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে তখন যে কোনো মানুষই অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হতে পারে।

এমতাবস্থায় এর সঠিক সমাধান হলো- মানুষের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে তার হারানো গুণগুলো অর্থাৎ সহযোগিতা, সহমর্মিতা, পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা ইত্যাদি ফিরিয়ে আনা। নিশ্চিত ধ্বংস থেকে সমাজকে রক্ষা করার আর কোনো উপায় নেই। মানুষের চরিত্রের মেরুদণ্ড তার শিক্ষা, তাই তার চরিত্র পরিবর্তন করতে সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। সেই নৈতিক ও চারিত্রিক শিক্ষায় ধর্মের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মানুষের মনে যদি সর্বদা স্রষ্টার উপস্থিতির বোধ জাগ্রত থাকে, আখেরাতে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ভয় জাগ্রত থাকে তাহলে আল্লাহর ভয়ে সে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে। মানুষের মনে যদি দেশপ্রেম জাগ্রত থাকে তাহলে তার চোখের সামনে দেশ ও জাতির কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। মানুষ যদি বুঝতে পারে যে, দুর্বৃত্তকে বাধা দিতে গিয়ে বা বিপন্ন মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলেও সেটা শাহাদাত, এর বিনিময়ে সে আল্লাহর কাছ থেকে জান্নাতে আশা করে তাহলে মানুষ অন্যের বিপদে এগিয়ে যাবে। তখন সমাজে ঐ কথাটি প্রতিষ্ঠিত হবে যে, “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।”

বাংলাদেশেরপত্র/এডি/এ

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *