Connect with us

জাতীয়

গণতন্ত্র যখন হরতালের রক্ষাকবচ ও জনতার মৃত্যুপরোয়ানা

Published

on

মোহাম্মদ আসাদ আলী

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে হরতাল এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। হরতাল কথাটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও, সংঘর্ষের চিত্র; কানে ভেসে আসে সর্বস্ব হারানো অসহায় মানুষের করুণ আর্তনাদ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আমলে আমাদেরকে এতবার হরতাল-অবরোধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে যে, এর উপর সাধারণ মানুষ বিষিয়ে উঠেছে। আইন করে হরতাল-অবরোধ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবও তুলেছেন অনেকে। কিন্তু সে প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি। কারণ হরতাল সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যা-ই ভাবুক, সুশীলরা হরতালকে মনে করেন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন, সেই গণতন্ত্র মানুষের পছন্দ কি না তা তারা বিবেচনায় নিচ্ছেন না। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সরকারের জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সুযোগ না দিলে সরকার ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে, ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে- এমনটাই আশঙ্কা তাদের। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোও হরতাল-অবরোধ আহ্বানের অধিকার হারাতে চায় না। কারণ প্রতিপক্ষকে নিজেদের দাবি-দাওয়া মান্য করাতে (তা ন্যায্য বা অন্যায্য যা-ই হোক) এর চেয়ে ফলপ্রসূ অস্ত্র দ্বিতীয়টি নেই। সব মিলিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় হরতাল অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন-সম্পদ রক্ষার চেয়ে বড় করে দেখা হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষাকে। যুদ্ধে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতির মতো কথিত গণতন্ত্র রক্ষায় ডাকা হরতাল-অবরোধে যে প্রাণগুলো হারাচ্ছে, যে সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সবই যেন আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি (পড়ষষধঃবৎধষ ফধসধমব), যে ক্ষয়ক্ষতি না হলে ভালো, হলে কিছু করার নেই। গণতন্ত্রের যুদ্ধে এটা হয়ে থাকে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রবৃত্তি মানুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। হরতাল এমনই এক প্রতিবাদ মাত্র। অনেকে মনে করেন মহাত্মা গান্ধীই প্রথম হরতাল প্রচলন করেন। এ ধারণা সঠিক নয়। যতদূর জানা যায় হরতাল বা ধর্মঘটের সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১১৫২ সালের ১৪ নভেম্বর। প্রাচীন মিশরের ফারাও শাসক তৃতীয় রামসেসের শাসনামলে দার-আল মদিনার রাজকীয় কারিগররা তাদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে কর্মবিরতি পালন করতে থাকে। শ্রমিকদের এই ধর্মঘট মিশরের তৎকালীন শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ফলে শাসকরা দ্রুত কারিগরদের বেতন বৃদ্ধি করে দেয়। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ সালে ধর্মঘট আহ্বান করে রোমের প্লেবিয়ান সম্প্রদায়। তৎকালীন রোমের প্লেবিয়ানরা গণ্য হতো খুব নিচু শ্রেণি হিসেবে। তারা মূলত ছিল কর্মজীবী। রোমের আইন অনুযায়ী তাদের কোনো নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। সকল অধিকার ভোগ করত অভিজাত সম্প্রদায়। এই অভিজাতরা প্লেবিয়ানদেরকে ঋণের দায়ে আবদ্ধ করে দাসে পরিণত করতে পারত, এমনকি প্লেবিয়ানদের নিপীড়ন-নির্যাতন করতে করতে হত্যা পর্যন্ত করে ফেলত। এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ সালে প্লেবিয়ানরা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে দলে দলে শহর ছেড়ে পার্শ্ববর্তী স্যাক্রেড মাউন্টেনে আশ্রয় নেয়। এদিকে কর্মজীবী সম্প্রদায়ের অভাবে দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, কারখানায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে প্লেবিয়ানদের নির্যাতনের কল তৎকালীন ‘ঋণ আইন’ বিলুপ্ত হয়। এরপরও খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ থেকে ২৮৭ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি ধর্মঘটের মাধ্যমে প্লেবিয়ানরা সব নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা অর্জন করে। একইভাবে শিল্প বিপ্লবের অন্যতম চারণভূমি ব্রিটেনে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের অবনতি ঘটলে মালিকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং শ্রমিকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরপর কয়েকবার ধর্মঘট ডাকা হয়। ১৮৩৭, ১৮৩৮ ও ১৮৪২ সালে শ্রমিকরা ধর্মঘট আহ্বান করে এবং অনেকাংশেই লক্ষ্য অর্জিত হয়। এক পর্যায়ে মিশর, রোম, ব্রিটেন হয়ে বিংশ শতাব্দীতে ন্যায্য অধিকার আদায়ের এই পদ্ধতি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ধর্মঘটকে অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন মহাত্মা গান্ধী।
হরতাল বা ধর্মঘট আহ্বান ও তার সফল বাস্তবায়নের এই ইতিহাসে সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যার কোনো নজির নেই। আরও লক্ষণীয় যে, যুগে যুগে এ প্রতিবাদ কর্মসূচি কেবল নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, রাজনৈতিক অভিসন্ধী পূরণের জন্য নয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা হরতালের যে চেহারা দেখছি সেটার সাথে নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত মানুষের কার্যত কোনো সম্পৃক্ততাই নেই। বরং সাধারণ মানুষের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে, তাদের জীবন-সম্পদের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে হরতালের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে, নাম দেয়া হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন। গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে যদি সাধারণ জনগণই অরক্ষিত হয়ে পড়ে তাহলে ওই গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা কী?
গণতন্ত্র যদি সত্যিকার অর্থেই মানুষের মুক্তি এনে দিতে পারত তাহলে হরতাল, অবরোধ, ঘর্মঘট ইত্যাদি আহ্বানের কোনো প্রয়োজনীয়তাই থাকতো না। হরতাল, অবরোধের কথা তখনই আসে যখন মানুষ তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু মানুষ অধিকারবঞ্চিত হবে কেন? একটি জনমুখী কল্যাণকর সিস্টেম কখনই চাইবে না তার অধীনে পরিচালিত কেউ নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত হোক এবং সে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হোক। কিন্তু প্রচলিত গণতন্ত্র এটা ধরেই নিয়েছে তার অধীন সমাজে জনবিরোধী কর্মকাণ্ড হবেই এবং এ জনবিরোধী কাজ থেকে সংশ্লিষ্ট সরকার বা ক্ষমতাসীনকে বিরত রাখার জন্য হরতাল-অবরোধ-ধর্মঘট পালন অনিবার্য! যেন চোরকে চুরি করতে বলে গৃহস্থকে বলা হচ্ছে সতর্ক থাকতে। কিন্তু এভাবেও কি শেষ রক্ষা হচ্ছে? আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনের ইতিহাস হলো- আমাদের দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কারণে-অকারণে, কখনও নিছক দলীয় দাবি দাওয়া পূরণের লক্ষ্যে হরতাল-অবরোধ আহ্বান করে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তা রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। শুরু হয় সরকারের দমন-পীড়ন ও বিরোধীদের সহিংসতা। মাঝখানে প্রাণ হারায় উলুখাগড়া জনগণ। অর্থাৎ সাধারণ জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য যে আন্দোলন হবার কথা ছিল বাস্তবে সে আন্দোলনের যাতাকলে পিষ্ট হতে হয় সাধারণ জনগণকেই। সব মিলিয়ে, গণতন্ত্রের তত্ত্বকথাকে মিথ্যা প্রমাণ করে একদিকে একটি দল মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, অন্য দল জনগণের অধিকার আদায়ের কথা বলে জনগণের মাথাতেই কাঁঠাল ভাঙছে। উভয়বিচারেই মরছে জনগণ, বেঁচে থাকছে গণতন্ত্র!

লেখক: কলামিস্ট, হেযবুত তওহীদের সদস্য।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *