দেশজুড়ে
টেংরাগিরি বনাঞ্চলে মরা গাছের সারি
বরগুনা প্রতিনিধি:
বরগুনায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলজুড়ে এখন চোখে পড়ে কেবর মৃত গাছের সারি। শ্বাসমূলে বালু জমা এবং প্রবল ঢেউয়ে গোড়ার মাটি-বালু সরে যাওয়ায় মারা যাচ্ছে বনের গাছ। আর কাঠচোরদের কবলে পড়েও ধীরে ধীরে উজাড় হচ্ছে উপকূলীয় টেংরাগিরি সংরক্ষিত এই বনাঞ্চল। ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ।
সরেজমিনে দেখা যায়, বরগুনার তালতলী উপজেলার টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নলবুনিয়া, নিশানবাড়িয়া, আশারচর ও নিদ্রা-সখিনা এলাকায় মড়ক ও নিধন দুই কারণেই বনের গাছ ধ্বংস হচ্ছে। দূর থেকে ঘন বন মনে হলেও ভেতরটা ফাঁকা করে ফেলেছে চোরাকারবারীরা। কয়েক কিলোমিটার এলাকার বনের গাছ স¤পূর্ণ উজাড় হয়ে গেছে। আর অসংখ্য গাছের বাকল ও ডালপালা ছেঁটে ফেলায় সেসব গাছ মৃত্যুর প্রহর গুণছে। অন্যদিকে নিদ্রা ও আশারচর এলাকায় কয়েক হাজার গাছ কেটে সাবাড় করার পর পড়ে আছে সেসব গাছের গোড়া। এসব গাছ মরার অন্যতম কারণ গোড়ায় বালু জমে যাওয়া। বালুতে ঢাকা পড়েছে এসব গাছের শ্বাসমূল। টেংরাগিরি বনের দক্ষিণ দিকের শেষ সীমানায় সোনাকাটা সৈকতের বালিয়াড়িতে অসংখ্য মৃত রেইনট্রি, কেওড়া ও ছৈলা গাছ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে আরও অসংখ্য গাছের গোড়ার মাটি সরে গিয়ে শিকড় বের হয়ে গেছে। বালুতে এসব গাছের শ্বাসমূল ঢাকা পড়েছে। গাছগুলোর পাতা ও কাণ্ড হলদেটে হয়ে গেছে। ঢেউ ও জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্লাবন ভূমির আওতা বেড়ে যাওয়ায় বনের মধ্যে জোয়ার ঢুকে ভূমির ক্ষয় ত্বরান্বিত করছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গাছ মরার পাশাপাশি বন উজাড় হওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে কাঠচোরদের উৎপাত। নিদ্রা, সখিনা, আশারচর, নলবুনিয়া বনসংলগ্ন গ্রামগুলোতে অনেক চোরচক্র সক্রিয় রয়েছে। এরা বিভিন্ন চোরাকারবারী ও বনরক্ষীদের যোগসাজশে বন উজাড় করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কেওড়া ও গেওয়া গাছ চেরাই করে জ্বালানি কাঠ এবং সুন্দরী গাছ গৃহনির্মাণ ও আসবাব তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ৪/৫ বছর আগেও জোয়ারের পানি সৈকতের কাছাকাছি থাকত। এখন তা বনের তিন-চার কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে। এতে বনের গাছগাছালির গোড়ার মাটি ক্ষয় হয়ে বনের অস্তিত্ব বিপন্ন করছে। বনভূমি রক্ষায় শিগগির কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পুরো বন হুমকিতে পড়বে। গাছের গোড়ায় বালু জমে যাওয়া ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গাছগুলো মারা যেতে পারে বলে মনে করছে পরিবেশবিদরা।
বে-সরকারি সংস্থা এনএসএর নির্বাহী পরিচালক এ্যাড. শাহাবুদ্দিন পান্না বলেন, গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখা দরকার। সংরক্ষিত এ বনের গাছগুলো মারা গেলে ব্যাপকভাবে ভাঙন দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কর্মকর্তা সুকুমার বিশ্বাস বলেন, কোনো গাছ মারা যাক সেটা আমাদের কাম্য নয়। কি কারণে শ্বাসমূলীয় বনের গাছ মারা যাচ্ছে তা আমার জানা নেই। এসব গাছ বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় মানুষের কাছে এই বন ফাতরার বন হিসেবে পরিচিত হলেও সরকারিভাবে বন বিভাগের খাতায় এর নাম টেংরাগিরি বনাঞ্চল। সুন্দরবনের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন। আর দ্বিতীয় বৃহত্তম এ বনে দেখা দিয়েছে মড়ক রোগ। পরিবর্তিত পরিবেশে প্রতিদিন মরে যাচ্ছে অসংখ্য গাছ। বনবিভাগ জানায়, সংরক্ষিত এ বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা টেংরাগিরি একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। ১৯২৭ সালের বন আইনের জরিপ অনুযায়ী, ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। পরে, ১৯৬৭ সালে এটিকে টেংরাগিরি বনাঞ্চল হিসেবে নামকরণ করা হয়। এ বনের গাছের মধ্যে রয়েছে গেওয়া, জাম, ধুন্দল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই কেওয়া, তাল, কাঁকড়া, বনকাঁঠাল, রেইনট্রি, হেতাল, তাম্বুলকাটা, গরান। সংরক্ষিত এ বনে রয়েছে হাজার প্রজাতির প্রাণি। যার মধ্যে রয়েছে- কাঠবিড়ালি, বানর, প্রায় ৪০ প্রজাতির সাপ, শজারু, শুকর, কচ্ছপ, শেয়াল, ডোরাকাটা বাঘ, বনমোরগ, মধু কাঁকড়া প্রভৃতি। সখিনা বিটের বিট কর্মকর্তা সজিব কুমার মজুমদার বলেন, টেংরাগিরি বনের গাছ মরে যাওয়ার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তবে, কাঠচোরেরা বন উজাড় করছে কিনা, আমার জানা নেই। কাঠ চুরির সঙ্গে বন বিভাগের কমকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মিহির কুমার দো বলেন, যেকোনো শ্বাসমূলীয় বনের গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তর আছে। শুরুতে উপকূলে ভূমি গঠনের পর উড়িগাছ জন্মায়, তার পর ভূমি কিছুটা শক্ত হলে উড়িগাছ মরে গিয়ে কেওড়া-গেওয়া জন্মায়। মাটি আরও শক্ত হলে আগের গাছগুলো মরে গিয়ে সেখানে সুন্দরী, গড়ানসহ অন্যান্য গাছ জন্মায়। তাই ফাতরার বনে গাছ কেন মারা যাচ্ছে তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্রুত এর অনুসন্ধান প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এটা শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চলের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য গবেষণা দরকার। জরুরি ভিত্তিতে ঝাউবাগান লাগানোর মাধ্যমে ভূমিক্ষয় রোধের বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। তবে, কাঠচুরির অভিযোগ ভিত্তিহীন। কেউ যদি কাঠ চুরি করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।