Connect with us

Highlights

পরকালে মুক্তির দোহাই দিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ করতো এহসান গ্রুপ

Published

on

বিছানায় শুয়ে থাকা বিমান বাহিনীর সাবেক সদস্য আফসার উদ্দিন (৬৭) এখন অনেকটাই নির্জীব। টাকার অভাবে পায়ের গ্যাংগ্রিন ও প্রোস্টেট গ্লান্ডের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। বিয়ে না করা আফসার এখন ভাই ও বোনের সেবায় জীবনের শেষ দিনগুলো পার করছেন। মুখের কথা জড়িয়ে এলেও তার এমন অবস্থার জন্য এহসান গ্রুপকে দায়ী করেছেন আফসার। বলেছেন, মসজিদের খাদেমের প্ররোচনায় এহসান গ্রুপে সাড়ে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আজ তিনি নিঃস্ব। করাতে পারছেন না নিজের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা।

যশোর শহরের পুরাতন কসবা মিশনপাড়া এলাকার বাসিন্দা আফসার আরও জানান, বিমান বাহিনীতে অফিস ক্লার্ক হিসেবে চাকরি করতেন তিনি। ২০১১ সালে অবসরে যান। ২০১২ সালের শেষদিকে এক মসজিদের খাদেমের কথা শুনে এহসান এস বাংলাদেশে ‘মাসিক মুনাফা’ পাওয়ার চুক্তিতে সাড়ে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। আড়াই বছরের মতো প্রতি মাসে নির্ধারিত মুনাফা পান। তবে ২০১৪ সালের শেষদিকে আর কোনও যোগাযোগ করতে পারেননি তাদের সঙ্গে। সেই থেকে কোনও টাকা-পয়সাও পাননি।

ভাঙা ভাঙা শব্দে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি বরাবরই ধর্মভীরু। শহরের বেজপাড়া জামে মসজিদের একজন খাদেম আমাকে জানান, এহসানে টাকা দিলে তা সুদ হবে না। শরিয়ত অনুযায়ী ব্যবসায়ের লভ্যাংশ পাবেন। মৃত্যুর পর জানাজা পড়াবেন তারা; হাশরের ময়দানে তার জন্যে উনারা সুপারিশও করবেন আল্লাহর দরবারে। এসব কথায় সন্তুষ্ট হয়ে বিনিয়োগ করি।

তিনি জানান, এখন তার প্যাম্পার্স পরিবর্তন করে দেন ছোট ভাই আর দেখভাল করেন তার বোন। চিকিৎসায় প্রচুর টাকা দরকার। এ অবস্থায় বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত চান তিনি।

শুধু আফসার উদ্দিন নন, তার মতো এহসান গ্রুপে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা লগ্নি করে নিঃস্ব হয়েছেন যশোরের হাজারো মানুষ। প্রতারণার ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে অনেকে হয়েছেন শয্যাশায়ী। এরমধ্যে ৫৬ জনের মতো বিনিয়োগকারী মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন তাদের স্বজনরা।

এহসান গ্রুপে এক লাখ থেকে শুরু করে এক কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন বহু মানুষ। যাদের মধ্যে রয়েছেন খড়কীর শামসুর রহমান, আব্দুল মতিনের ছেলে শফিকুল ইসলাম, হামিদপুর এলাকার কামরুজ্জামান, রূপদিয়া এলাকার শের আলী, বারান্দীপাড়া এলাকার বিধবা আমিরুননেছা, কুলসুম বেগম, সীতারামপুরের আবুল কালাম, বালিয়া ভেকুটিয়া এলাকার মোহাম্মদ হানিফ, রাজারহাট এলাকার শাহাজাদী বেগম, বারান্দীপাড়ার আলেয়া বেগম, পূর্ববারান্দী মাঠপাড়ার নাছিমা খাতুন, একই এলাকার রায়হানুল ইসলাম, নাজির শংকরপুর এলাকার তরিকুল ইসলাম, চাঁচড়ার রাজা বরদাকান্ত রোডের আম্বিয়া, ঝুমঝুমপুর মুক্তিযোদ্ধা কলোনির রহিমা খাতুন, রুপদিয়ার নুর ইসলাম, বাঘারপাড়া ঘোষ নগরের শেফালী রানী শীল ও একই গ্রামের দুর্গা রানী অধিকারী প্রমুখ।

ভুক্তভোগীরা জানান, ধর্মের দোহাই দিয়ে মসজিদের ইমাম ও খাদেমদের একটি অংশ এহসান গ্রুপে বিনিয়োগের জন্য গ্রাহক তৈরি করেন। পরে যশোরের গ্রাহকদেরই ৩২২ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। জেলার হাজারো গ্রাহক এহসান গ্রুপের প্রতারণায় জীবনের সব সঞ্চয় হারিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এহসান গ্রুপের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যশোর শহরের বারান্দীপাড়া কদমতলা এলাকার মফিজুল ইসলাম ইমনের পরিবার। তিনি বলেন, আমার বাবা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন মসজিদে। ২০১১ সালের শেষদিকে বাবা জমি বিক্রি করে ১৮ লাখ টাকা পান। সেই টাকা ইসলামি ব্যাংকে রাখেন। বিষয়টি জানতেন সেখানকার এক খাদেম। তিনি বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হন, ব্যাংকে টাকা রাখলে পরকাল বরবাদ হয়ে যাবে। বরং আলেম-ওলামাদের তৈরি প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখলে ব্যাংকের চেয়েও বেশি লভ্যাংশ এবং মেয়াদ শেষে গচ্ছিত টাকার দ্বিগুণ পাওয়া যাবে। বাবা তার কথায় প্রভাবিত হন এবং এহসানে ১৮ লাখ ছয় হাজার টাকা রাখেন। প্রথম দুই বছর মাসিক ১৬শ’ টাকা (লাখে) দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তারপর থেকে শুরু হয় তাদের টালবাহানা।

২০১৪ সালের শেষে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের টাকা আদায়ে গঠিত হয় ‘যশোর এহসান ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক সংগ্রাম কমিটি’। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন মফিজুল ইসলাম ইমন।

ইমন আরও বলেন, এহসান গ্রুপের তিন চারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে এহসান সোসাইটি, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, এহসান ইসলামি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, আল এহসান প্রভৃতি। যশোর ছাড়াও দেশের ৩৯টি জেলায় তাদের ১৮২টি শাখার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে এভাবে টাকা গ্রহণ করেছে তারা।

তার দাবি, বিভিন্ন জেলার গ্রাহকরা এহসান গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আড়াই হাজারের কোটির বেশি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

প্রতারণার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, দুই বছর টাকা দেওয়ার পর আর তাদের কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি এহসানের যশোরের অফিসে (বড়বাজার, সোনাপট্টি এলাকা) যাই। তারা আমাকেসহ অন্য গ্রাহকদের আজ-কাল বলে ঘোরাতে থাকে। একপর্যায়ে তারা সমুদয় সম্পদ বিক্রি করে পালিয়ে যায়। এরপর আমি যশোর কোতোয়ালি থানায় এহসানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নামে জিডি করি। ২০১৫ সালে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। টাকা ফেরতের দাবিতে ভুক্তভোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমরা চার থেকে পাঁচশ’ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ টাকা ফেরতের দাবিতে যশোরে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছি।

তবে এহসানের মাঠকর্মীদের দিয়ে যশোরে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করানো হয়। সেখানে ইমনকে একজন প্রতারক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।

ইমন বলেন, আমার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলাও করা হয়। সেই মামলায় অ্যারেস্ট হয়ে এক মাস সাত দিন জেলহাজতে ছিলাম। ২০১৭ সালে সাভারের এক যৌনকর্মীকে দিয়ে ধর্ষণের মামলা করা হয়। সেই মামলা অবশ্য পরে টেকেনি। যিনি মামলা করেন, পরে তিনি আদালতে বিষয়টি জানালে রক্ষা পাই।

যারা আমার সঙ্গে আন্দোলন সংগ্রাম করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন মামলা করা হয় বলে জানান তিনি।

ইমন জানান, এহসানে যারা টাকা জমা করেন, তাদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। জীবনের শেষ সঞ্চয় তাদের হাতে তুলে দেন। এ পর্যন্ত গ্রাহকদের ৫৬ জন মারা গেছেন; বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েছেন হাজার খানেক। অনেকেই তাদের ছেলের সংসারে আছেন। কিন্তু টাকা-পয়সা সন্তানদের দিতে পারেননি বিধায় সেখানেও মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।

তিনি আরও জানান, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় এহসান গ্রুপের এহসান এস বাংলাদেশ ও রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের মুফতি আবু তাহের নদভীসহ ২৭ জনের নাম বেরিয়ে এসেছে। অন্যরা হলেন এহসান এসের ব্যবস্থাপক শিমুলিয়ার আতাউল্লাহ, প্রধান নির্বাহী ব্যবস্থাপক মাগুরার কাজী রবিউল ইসলাম, অর্থ মহাব্যবস্থাপক মাগুরার মুফতি জুনায়েদ আলী, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সাতক্ষীরার মুফতি আমিনুল হক ওরফে আমজাদ হোসেন, পরিচালক আজিজুর রহমান, মঈন উদ্দিন, আমিনুল হক, আব্দুল মতিন, কালিমুল্লাহ, মিরাজুল ইসলাম, খুলনার মুফতি গোলাম রহমান, মাঠকর্মী যশোরের বাবর আলী, সেলিমুল আজম চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, শামসুর রহমান, মকছেদ আলী।

বিশাল অঙ্কের টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করা এমডি রবিউল ইসলাম, খবিরুজ্জমান, জুনায়েদ আলী, ইউনুস আলী ও আতাউল্লাসহ ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন আন্দোলনকারীরা।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য:

এ বিষয়ে জানতে এহসান এসের অন্যতম পরিচালক মুফতি মো. ইউনুসের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। সে কারণে তার বক্তব্য সংযোজন করা সম্ভব হয়নি।

তবে, মাঠকর্মী (অর্থ সম্পাদক) যশোর মাছবাজার (বড়বাজার) মসজিদের খাদেম মোকসেদ আলী বলেন, আমি নিজেও একজন গ্রাহক। ইতোমধ্যে মাল্টিপারপাসের ৬০ শতাংশ মানুষের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি ৪০ শতাংশ মানুষের টাকা অল্প দিনের মধ্যে পরিশোধ করা হবে বলে জানান তিনি।

যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মুফতি আবু তাহের নদভী বলেন, সুদমুক্ত সমাজ গড়া আমাদের দায়িত্ব। তারা (এহসান গ্রুপ) আমাকে নামকাওয়াস্তে সভাপতি বানায়। আমাকে বেতন-ভাতা দেবে বলে জানিয়েছিল। আমি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। এখন তাদের সেই কাজের দায় আমাকে নিতে হচ্ছে। আল্লাহর কাছে বিচার চেয়েছি, আমি তো কোনও অপরাধ করিনি।

যশোর সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক অসীত কুমার সাহা বলেন, এহসান এস বাংলাদেশের কোনও কার্যক্রম আছে বলে জানি না। তারপরও আমি খুঁজে দেখবো। আসলে না দেখে কিছু বলতে পারছি না।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যশোরের পুলিশ সুপার রেশমা শারমীন বলেন, সম্প্রতি কোর্টে যে মামলা হয়েছে, তার নথিপত্র আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। তবে, এর আগে আমাদের কাছে ১৮টি মামলা আসে। যার মধ্যে ১৭টির রিপোর্ট আমরা জমা দিয়েছি।

২৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা:

দু’জন গ্রাহকের প্রায় ৩২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৩ সেপ্টেম্বর যশোরে এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যানসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে দুটি মামলা দায়ের হয়। অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মারুফ আহম্মেদ অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআিই) আদেশ দেন।

গ্রাহকেরা হলেন, যশোর শহরের চাঁচড়া ডালমিল এলাকার মৃত আব্দুস সামাদের স্ত্রী রহিমা খাতুন (৭২) ও সদর উপজেলার সতীঘাটা কামালপুর গ্রামের তুরফান গাজীর ছেলে ওসমান গাজী (৭০)। তাদের পক্ষে মামলাটি করেছেন শহরের পশ্চিম বারান্দীপাড়া কদমতলা এলাকার রবিউল ইসলামের ছেলে মফিজুল ইসলাম ইমন।

রহিমা খাতুনের পক্ষে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়, আসামি সিরাজুল ইসলাম তার পূর্ব পরিচিত। তার কথায় সরল বিশ্বাসে রহিমা ২০১৩ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ওই কোম্পানিতে মোট ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা লগ্নি করেন। কিন্তু কোম্পানির কর্মকর্তারা তাকে মুনাফা দেননি। এ কারণে তিনি তাদের কাছে আসল টাকা ফেরত চান।

ওসমান গাজীর পক্ষে দায়ের করা মামলায় বলা হয়, আসামিরা প্রতারক, ধাপ্পাবাজ। ধর্মের নাম ভাঙিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে বিভিন্নভাবে অর্থ আদায় করে তা আত্মসাৎ করে থাকেন। আসামি সিরাজুল উল্লিখিত কোম্পানির মাঠকর্মী সেক্রেটারি পরিচয় দিয়ে তাকে অর্থ লগ্নি করতে উৎসাহ দেন। ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় কোম্পানিতে মোট ১৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা লগ্নি করেন। কিন্তু উল্লিখিত আসামিরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাকে মুনাফা দেননি।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *