Connect with us

মতামত

ভিক্ষুকদের ভিক্ষাবৃত্তি প্রসঙ্গে

Avatar photo

Published

on

এড বাবুল রবিদাস:
ভিক্ষাবৃত্তি কখন কোন সময় হতে প্রচলিত বা শুরু হয়েছে তার কোন সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয় যে, মানুষ যখন মৌলিক অধিকার বা চাহিয়া পূরণে ব্যর্থ হয়েই লজ্জা শরম ত্যাগ করে পেটের দায়ে বঞ্চিত এক মানুষ অন্য মানুষের কাছে হাত পেতে সাহায্য প্রার্থনা করাকেই সাধারণ ভাষায় ভিক্ষুক (ইবমমধৎ) বলে। ভিক্ষুকদের কোন কোন ভাষায় ফকির, মিসকিন, কাংগাল বা নিঃস্ব ব্যক্তি বলা হয়। একারণেই সম্ভবত ইংরেজী ভাষায় বলা হয় A beggar begs from door to door.

তাদের মধ্যে দেখা যায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পঙ্গু, অক্ষম, অন্ধ, বিকলাঙ্গ বা শারীরিকভাবে অক্ষম এতিম ব্যক্তিদের। অর্থাৎ যারা সম্পদ অর্জন করতে পারে না বা নিজের ও পরিবারের ভরন পোষন বহন করতেও পারে না তাদেরকেই ভিক্ষুক বলে গন্য করা যায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে-এক শ্রেণীর পাষন্ড মানবতা বহির্ভূত হৃদয়হীন মানুষ ভাল মানুষকে অপহরণ করে ভিক্ষাবৃত্তি করিয়ে অর্থ উপার্জন করে। বিভিন্ন সিনেমা, নাটকে দেখা যায় ঐ সকল হৃদয়হীন নিম্নমানের ব্যবসায়ীগণ নাবালক সন্তানদের সাবালকদের ধরে অঙ্গহানী করে রাস্তায় ভিক্ষা করায়।

এছাড়া আমরা বিগত পত্র পত্রিকায় দেখেছি যে, লালমনিরহাট জেলায় ‘ভিক্ষুক সম্মেলন’। এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনার উপ মন্ত্রী আহসান হাবিব দুলু। পৃথিবীতে আর কোথাও নজির আছে কিনা জানা নেই। তবে এ প্রসঙ্গে মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাহিনীটি মনে পড়ে গেল-কাহিনীটি নিম্নরুপঃ

একজন ভিক্ষুক এসে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে ভিক্ষা চান। তিনি বলেন তোমার কি কোন সম্বল আছে? ভিক্ষুক বললেন আমার একটি কম্বল আছে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার কম্বল আনতে বললেন। কম্বলটি বিক্রয় করে দিয়ে সেই অর্থ দিয়ে একটি কুড়াল ক্রয় করে দিলেন। আর উপদেশ দিলেন বন হতে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রয় করে যে অর্থ পাবে, সেই অর্থ দিয়েই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করবে। পরবর্তীতে বাস্তবে দেখা গেল উক্ত উপদেশ পালনের ফলে ভিক্ষুকের আর কোন অভাব থাকলো না। ভিক্ষুক ভিক্ষা থেকে বিরত থাকলো। এভাইে ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করেছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।

ভিক্ষুকদের পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ ও টিভি সংবাদ পাঠে দেখা যায়। প্রকৃত পক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর সংবিধানে আমরা দেখি যে, “মৌলিক অধিকার” এর কথা উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ যে জিনিসগুলো না হলে জীবন অচলের মতো হয়। যেমন-অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, মৌলিক অধিকার গুলোর মধ্যে অন্ন খাদ্য, বস্ত্র (কাপড়-চোড়র) না পেলেই মানুষ ক্ষুধায় কাতর হয়ে পরে এবং কাপড় ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারেনা।

এসকল ভিক্ষুকেরা খাদ্যের জন্য বা কাপড়ের জন্য পথে পথে সাহায্য সহযোগিতার করুণভাবে সহানুভুতির আবেদন করে। দয়ালু ব্যক্তিরা নিঃস্ব ব্যক্তিদের টাকা পয়সা এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি দান করে থাকেন। দান গ্রহিতাকারীরাই মূলতঃ ভিক্ষুক বলে সমাজে চিহ্নিত, উপেক্ষিতে ও নিন্দিত। ভিক্ষুকদের সাথে আমাদের সমাজ জীবনে যে ব্যবহার করা হয় তাহা ‘মানুষ’ কবিতায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভিক্ষুকদের সাথে আমাদের সমাজে মানুষের আচার আচরণের কথা তুলে ধরেছেন। তার ‘মানুষ’- কবিতার মধ্যে পরিস্কার ভাবে ফুটে উঠেছে যে, আমাদের সমাজে ভিক্ষুক বা নিঃস্ব ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভুতি না দেখিয়ে তাদের প্রতি খারাপ আচরণ করা হয়। তাই কবি নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন যেমন পূজারী দুয়ার খোল, ক্ষুধার ঠাকুর দাড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো! স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয় দেবতার বরে আজ রাজা টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয়! জীর্ণ-বস্ত্র, শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ-ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোলো বাবা, খাইনি তো সাত দিন!’ সহসা বন্ধ হলো মন্দির, ভুখারি ফিরিয়া চলে, তিমিররাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে! ভূখারি ফুকারি’ কয়, ‘ঐ মন্দির পুজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়! পক্ষান্তরে আরও লিখেছেন মসজিদে কাল শিরনি ছিল-অঢেল গোস্ত রুটি বাঁছিয়া গিয়াছে মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি, এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন বলে, বাবা আমি ভুখা আছি আজ নিয়ে নিয়ে সাত দিন! তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা ভ্যালা হলো দেখি ল্যঠা, ভুখা আছ মর গো-ভাগারে গিয়ে নমাজ পরিস বেটা ? ভুখারি কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল-‘তা হলে শালা সোজা পথ দেখ!’ গোস্ত-রুটি নিয়ে মসজিদে দিল তালা। ভূখারি ফিরিয়া চলে, চলিতে চলিতে বলে আশিটা বছর কেটে গেল আমি ডাকিনি তোমায় কভূ, আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করেনি প্রভূ।

আমরা জানি মানুষের জীবনে উত্থান পতন আসে। নদীর এক কূল ভাঙ্গে আর অপর কূল গড়ে। ভিক্ষুকেরাও আমাদের সমাজের মানুষ। তাদের প্রতি ঘৃনা নয়, অত্যন্ত সহানুভূতির মাধ্যমে দেখা দরকার। তাদের মৌলিক অধিকার দিয়ে বিকশিত করে তুলতে হবে। তারাও দেশের নাগরিক, ভোট প্রদান করেন। তাই তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে বলে অনেক সুধী জনই তা মনে করেন। এই ভিক্ষা বৃত্তি দূরীকরণের জন্য নিম্নলিখিত উপায়ে ভিক্ষুক সমস্যা সমাধানকল্পে পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

১। প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে সর্ব প্রথমে প্রকৃত ভিক্ষুকদের তালিকা তৈরী করতে হবে। প্রথা ভিত্তিক, মহল্লা ভিত্তিক, ওয়ার্ড ভিত্তিক প্রকৃত গরীব, ফকির, মিছকিনদের একটি তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। তবে দেখা যাবে যখনই তালিকা তৈরী করার কাজ চলছে তখনই ধিরে ধিরে ভিক্ষুকদের খাতায় নাম তালিকাভুক্ত হোক তা চাবেনা। যার ফলে যারা ছদ্মবেশে ভিক্ষা করে তাঁরা ধরা পরে যাবে।

২। আর একটি নিয়ম চালু করা যায়। তালিকা অনুযায়ী এলাকা ভিত্তিক ফকির বা ভিক্ষুককে ভিক্ষা প্রদান করতে হবে এবং আলাদা বা অঞ্চলের ফকির অন্য এলাকায় যেতে পারবেনা। প্রয়োজনে হলে সরকার কর্তৃক আইন প্রনয়ন করে এলাকা ভিত্তিক ভিক্ষার অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে বাস্তবে দেখা যায় ভিক্ষুকেরা নিজেরাই অলিখিত ভাবে মৌখিক তালিকা তৈরী করেছে। তার ফলে প্রকৃত ভিক্ষুকেরা যার যার এলাকা ভিত্তিক ভিক্ষা করে।

৩। উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আপনা আপনি ভিক্ষুকের সংখ্যা কমে যাবে। যখন ভিক্ষুকের সংখ্যা কমে যাবে তখন সমস্যা সমাধান করতে সহজ হবে, ছদ্মবেশী ভিক্ষুকেরা ধরা পরে যাবে।

৪। এক জরীপ থেকে জানা গেছে অনেকে ছদ্মবেশে অন্য এলাকায় অথবা অন্য জেলায় গিয়ে ভিক্ষা করে। তারপর একটি কাপড় চোপড় পরে নিজ গ্রামে এসে প্রকাশ করে সে চাকুরী করে। এই ভাবে ছদ্মবেশে অনেকেই ভিক্ষা বৃত্তিকে বেছে নেয়।

৫। আমাদের দেশে যেরুপ রাজনীতিকে ব্যবসা হিসাবে অনেকেই বেছে নিয়েছে তদরুপ পাশাপাশি ভিক্ষা বৃত্তিকেও অনেকে বেছে নিয়েছে। রাজনীতিতে যদি এরুপ ব্যবস্থা থাকতো রাষ্ট্রে বিজ্ঞান পরে জ্ঞান চর্চার করে রাজনীতি করতে হবে। তৎপর শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়সসীমা ইত্যাদি নিয়ম কানুন থাকলে রাজনীতিতে এতো বেশী লোকের ভীড় দেখা যেত না। যে সে রাজনীতি করতো না। তখন উচ্চ শিক্ষিত রাষ্ট্রে বিজ্ঞানের উপর ডিগ্রীধারী জ্ঞানীগুনি বয়স্ক লোকের আবির্ভাব হত। তদরুপ প্রকৃত ফকিরের তালিকা তৈরী করে ভিক্ষুক কমাতে হবে। সখ করে অথবা ব্যবসা হিসাবে অথবা ছদ্ম বেশে কেউ আর ভিক্ষাবৃত্তিতে আসবে না। ফলে ভিক্ষুকের সংখ্যা কমে যেত এবং তাদের সমস্যা সমাধান করতে সহজ হতো।

৬। সরকারিভাবে, বেসরকারী ভাবে বিভিন্ন এনজিও এর মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য সাহায্য সহানুভুতির প্রয়োজন আছে। সুদ মুক্ত ক্ষুদ্র লোনের মাধ্যমে ও ভিক্ষা বৃত্তি হতে মানুষকে ফিরিয়ে আনা যায়।

৭। ভিক্ষুকদের কল্যানে শিল্প ও কলকারখানার স্থাপন করে তথায় তাদের বিভিন্ন চাকুরী দিয়ে ও ভিক্ষা বৃত্তি দমন করা যেতে পারে।

৮। সরকারী খাস জমি ও রেলওয়ের পরিত্যাক্ত জমি ও পতিত আবাদযোগ্য ভূমি বা জমি ভিক্ষুকদের মধ্যে বন্টন করা যেতে পারে এবং তা হবে তালিকা ভিত্তিক ভিক্ষুকদের মধ্যে।

৯। আমরা জানি মানুষ শুধু পেট নিয়ে জন্ময় না-তাদের সাথে হাত পা ও জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে। কাজেই ভিক্ষুকদের কর্মঠ করে তৈরী করতে হবে। ভিক্ষা করতে করতে তারা অলস হয়ে পড়ে। সেই অভ্যাস হতে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। চিত্ত বিনোদন, বিভিন্ন এলাকায় সফর ও অন্যান্য পদ্ধতিতে তাদের কর্মমুখী করতে হবে। ভিক্ষা বৃত্তির উপর তাদের যেন আর নেশা না থাকে সেই ভাবে তৈরী করতে হবে। নিজের শক্তি বলে চলার মধ্যে যে সাধ আছে তা তাদের বুঝার মত মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। কর্মের মধ্যে থাকতে যেন তারা আনন্দ পায় সেইভাবে গড়ে তুলতে হবে। অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানায় যেন পরিণত না হয়।

১০। যারা প্রকৃত ভিক্ষার ফকির তারা নিজ এলাকায় থাকবে। অন্য এলাকায় যেতে পারবে না। এ আইন বলবৎ করতে হবে। ধনী দানশীল ব্যক্তিরা যেন নিজ নিজ এলাকার ফকির ব্যতিত অন্য এলাকার ফকিরদের ভিক্ষা প্রদান না করে এবং নিজ নিজ এলাকায় যেন শিল্প কারখানা তৈরী করে তালিকাভুক্ত ভিক্ষুকদের চাকুরী বাকুরী কাজ কর্মের ব্যবস্থা করে দেয়।

১১। আমাদের অবশ্যই ভিক্ষুক পরিবারকে সাহায্য প্রদান করে নিয়ন্ত্রন করতে হবে।

১২। সচ্ছল, অবস্থাশালী ধনী ব্যক্তিরা যে সাহায্য প্রদান করে থাকে।

মতামত- উক্ত সাহায্য প্রদান যেন তালিকাভুক্ত প্রকৃত ভিক্ষুকদের মধ্যে ব্যয় করা হয় এবং ধনী ব্যক্তিরা যেন সাহায্য প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন ফার্ম, কল কারখানা স্থাপন করে প্রকৃত অভাবী ভিক্ষুকদের চাকুরীতে নিয়োগ প্রদান করেন এমন ব্যবস্থা করতে হবে। ভিক্ষুক কোন বিশেষ ধর্মের ভেতর থেকে সৃষ্টি হয়না-ভিক্ষুক সর্ব দলীয় সর্ব ধর্মীয়, সকল শ্রেণীর হতে পারে। তাই নিরপেক্ষ ভাবে তাদের মঙ্গল এবং দেশ ও দশের মঙ্গলের জন্য সমবেত ভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভিক্ষুক সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে।

লেখক: এডভোকেট

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

মতামত

সাঁওতালদের জন্য ‘‘অলচিকি লিপি ও রোমান লিপি’’ বিতর্কের অবসান প্রয়োজন

Avatar photo

Published

on

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৮৪ হাজার। সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আছে প্রায় ৪০টি। এগুলোর মধ্যে ৫টি দ্রাবিড়, ১৫টি চীনা তিব্বতি, ৯টি অস্ট্রো এশিয়াটিক, ১১টি ইন্দো-ইউরেপিয় ভাষা পরিবারভুক্ত। দেশের কত মানুষ মাতৃভাষা হিসাবে ঐসব ভাষা ব্যবহার করে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক সমীখ্যায় কয়েকটি ভাষার জনগোষ্ঠী সংখ্যা পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলো-২৫টি ভাষায় কথা বলে ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯৭ জন। ৮টি গোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ কথা বলেন তাঁদের মাতৃভাষায়। ৪০টি ভাষার মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন। যেমন বিপন্ন ভাষার মধ্যে রয়েছে প্রায় এক হাজার জনগোষ্ঠীর খারিয়া ভাষা। সৌরা ভাষা ব্যবহার করে প্রায় এক হাজার ব্যক্তি। কোড়া ভাষায় কথা বলে ২ হাজার ৮ শ ৪৩ জন। ৮ হাজার মানুষ ব্যবহারকরে মালতো ভাষা। খুমি ভাষায় কথা বলে ৩ হাজার ৬৬৯ জন। কন্দ ভাষাভাষি প্রায়৭০০ জন। পাংখো ভাষা ব্যবহার করে ২ হাজার ২৭৪ জন। চাক ভাষা ব্যবহারকারী ২ হাজার ৮৩৫ জন। প্রায় ৪ হাজার মানুষের কথ্য ভাষা খিয়াং/লালেং/ …ভাষায় কথা বলে ২হাজার ৩৩ জন। মাত্র ৯৫ জনের কথ্য ভাষা লুসাই। এছাড়া আরো এক তথ্যে জানা যায় ‘‘রেংমিটচ্য’’ ভাষা বলতে পারা ক্ষুদ্র নৃৃ-গোষ্ঠী মাত্র ছয়জন বেঁচে আছেন। বাংলাদেশে সাঁওতালী ভাষার হরফ নিয়ে খৃষ্টান ও নন-খৃষ্টান দ্বন্দ্বে আটকে আছে দীর্ঘকাল থেকে। সাঁওতাল এক গ্রুপ চান ‘বাংলা’ হরফ, অপর গ্রুপ চান রোমান হরফ এবং আরো এক গ্রুপ চান ‘‘অলচিকি’’ হরফ। ফলে সাঁওতালী ভাষার পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে আটকে আছে। এটা সাঁওতাল জাতির জন্য অমঙ্গলজনক ও বিভক্তির কারণও বটে। এমন সিদ্ধান্তে বলা যায় যে, নিম্নলিখিত হেতুবাদে ‘‘রোমান লিপি’’ (হরফ) চালু করাই যুক্তিসঙ্গত হবে। কারণ রোমান হরফের সাথে ইংরেজি হরফের মিল আছে। বর্তমান যুগ জ্ঞান বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তির যুগ। সকল কিছূ আবিস্কার হচ্ছে ইংরেজি মিডিয়ামে। আমি সামাজিক পেশাগত সুবিধার জন্য শিক্ষাদান, লেখালেখি, জ্ঞান চর্চায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করলে ভাল ফল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রীরা করবে ভবিষ্যতে। কোন কোন যুক্তিতে ‘‘অলচিকি’’ ভাষা গ্রহণ যোগ্য নয়, তা ভারতের বিভিন্ন তথ্য থেকে নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

১। ‘‘অলচিকি’’ লিপি একটি মৌর্য যুগের ব্রাহ্মী লিপিমালা, গথিক লিপিমালা, দক্ষিণ ভারতীয় লিপিমালা ইত্যাদি থেকে সংগৃহীত
২। অলচিকি লিপির উচ্চারণ প্রকৃত সানতালী বর্ণমালার উচ্চারণ নয়।
৩। সি.এস উপাসক লিখিত ‘দ্য’ হিস্ট্রি এ্যান্ড প্যালিওগ্রাফি অফ মোরিয়ান ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্ট’ গ্রন্থের।১৯১,২৪১,২৮৪,২৮৮,২৮৯,৩০৯ পৃষ্ঠায় দর্শিত লিপিমালার সঙ্গে অলচিকি লিপির হুবহু মিল আছে।
৪। গোথিক লিপিমালার ‘ডি’ এবং ‘পি’ প্রতিরূপ লিপি অলচিকি ‘ইর’ এবং‘ ই্ঞ’ লিপির হুুবহু মিল আছে।
৫। এল, ব্লুমফিল্ড এর ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে অবস্থিত চারটি লিপির সঙ্গে অলচিকি লিপির মিল দেখতে পাওয়া যায়।
৬। অবশিষ্ট অলচিকির লিপিগুলি দক্ষিণ ভারতীয় লিপিচিত্রের সঙ্গে অবিকল মিল দেখা যায়।
৭। রঘুনাথ মুরমু ‘দ্য’ হিস্ট্রি এ্যান্ড প্যালিওগ্রাফি অফ মোরিয়ান ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্ট’ ও অন্যান্য গ্রন্থের লিপিমালা থেকে অবৈজ্ঞানিকভাবে লিপি সংগ্রহ করেছেন এবং রোমান সানতালী ধারা ও চিহ্ন অনুকরণ করেছেন।
৮। অলচিকিতে ‘ক’ কে ‘আক্’, ‘জ’ ‘আজ্’, ‘ল’ কে ‘অল্’, ‘গ’ কে ‘অগ্’, ‘র’ কে ‘ইর’, ‘দ’ কে উদ্, ‘প’ কে ‘এপ্’, ‘ন’কে এন্’, ‘ত’ কে ‘অত্’, ‘ঙ’কে ‘অং’, ‘ম’কে ‘আম্’, ‘ঞ’ কে ‘ইঞ’ ইত্যাদি উচ্চারণ করা হয়।
৯। অলচিকি কোন ভাষা নয়, এটি একটি উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক লিপিমাত্র। সানতালদের মাতৃভাষা সানতালী, যা বহুকাল থেকে রোমান বাংলা দেবগণাগরী লিপিতে লেখা হয়ে আসছে। অলচিকির আগে ও পরে ১৭ জন ব্যক্তি সানতালী ভাষার জন্য নিজ নিজ বিভিন্ন ধরণের লিপি অথবা অক্ষরগুলোকে তৈরী করেছেন। সানতালী ভাষাতে ৪৭টি ধ্বণি আছে। এ জন্যে ৪৭টি অক্ষরের প্রয়োজন । কিন্তু ১৭ জন ব্যক্তির লিপিতে ৪৭ টি ধ্বনির জন্য ৪৭টি অক্ষন নেই। এছাড়া শুধু ঝাড়খন্ড বাসি শ্রী বাবুধন মুর্মু-এর ‘‘নাওয়া সানতালী আখর’’ বইতেই সানতালী ভাষাতে যতগুলি ধ্বনি আছে ততগুলো অক্ষরই তৈরী করেছেন। যদি আমরা অলচিকি লিপিকে গ্রহণ করি, তবে প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র এবং উচ্চ শিক্ষিত সানতাল সমুদয় একই বিন্দুতে অর্থাৎ অ, আ, ক, খ স্তরেই আবদ্ধ হয়ে থাকবে। যদি উপরি লিখিত অক্ষরগুলো দ্বারা অথবা অলচিকি লিপিতে সানতালী ভাষা সাহিত্যের উন্নতি হতে শুধু ১০০ (একশো) বছরই কেন ১০০০(এক হাজার) বছর পিছিয়ে যেতে হবে। অতএব মূল কথা হলো এক রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যের মানুষের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপন এবং সানতালী ভাষা সাহিত্যের উন্নতি, শুধু রোমান লিপিতেই সম্ভব এবং আগেও হবে।
১০। ধ্বনি বিদ্যা অনুযায়ী সানতালী ভাষায় ৪৭টি ধ্বণি আছে। সানতালী ভাষা যথাযথভাবে প্রকাশের জন্য রোমান, বাংলা ও দেবনাগরী লিপিতে ৪৭টি পৃথক অক্ষর বর্তমান। কিন্তু অলচিকি বর্ণমালায় মাত্র ৩০টি অক্ষর আছে, যাতে ১৭টি অক্ষরের অভাব থাকায় অলচিকি অক্ষরের সানতালী ভাষা যথাযথভাবে লেখা যায় না। বানান ও উচ্চারণগত বিকৃতি ঘটে।
১১। অলচিকি বর্ণমালায় একটি ধ্বনিকেই দুইটি পৃথক অক্ষর দ্বারা এবং দুই টি পৃথক ধ্বনিকে একটি মাত্র অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ভাষাবিজ্ঞান বা ধ্বণিবিদ্যা সম্মত নয়।
১২। অবদমিত ব্যঞ্জন ধ্বণি ‘ক্’, ‘চ্’, ‘ত্’ (ৎ), ‘প্’-এর পরিবর্তে অলচিকিতে ‘গ’, ‘জ’, ‘দ’, ‘ব’ লেখা হয়। এতে উচ্চারণ নিরূপণে অবাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়েছে এবং ভাষার বিকৃতি ঘটেছে। (যেমন- ‘দাক্’ কে ‘দাগ্’, ‘লাচ্’ কে লাজ্’, ‘মেৎ’ কে ‘মেদ্’,‘উপ্’কে ‘উব্’, ‘আপ্’কে ‘আব’, ‘দেচ’ কে ‘দেজ্’, ‘রেচ্’ ‘রেজ’ ইত্যাদি।
১৩। ডায়াক্রিটিকেল মার্কস্ ( টুডীক্ আর টয়ৎ) ব্যবহারেও রোমান সানতালী লিপির অনুকরণ ঘটেছে।
১৪। অলচিকি অক্ষরগুলির নামকরণ এবং তাদের উচ্চারণ শুধু যে বিদ্ঘুটেমাত্র তা নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে অক্ষরগুলির নামের সানতালী অর্থ অশ্লীল শব্দও বোঝায়। যেমন -এড় (ব), উপরোক্ত কারণে সানতাল জনসাধারণ অলচিকি লিপিকে অস্বীকার করেন এবং গ্রহণও করেন না। অবৈজ্ঞানিক অলচিকি লিপি সানতালী ভাষার পক্ষে উপযোগী নয়। সানতালী ভাষার ধ্বনি অনুযায়ী অলচিকি লিপির ধ্বনি বিন্যাস নেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অলচিকি লিপির বাস্তব গ্রহণ যোগ্যতা না থাকা স্বতে¦ও, সংকীর্ন রাজনৈতিক কারণে অলচিকির সমর্থকের দ্বারা অবৈজ্ঞানিক, ত্রুটিপূর্ণ এবং অনুকরণকৃত অলচিকি লিপিকে সানতালী ভাষার সাধারণ জনগণের উপর জোড় করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আশ্চয্যের কথা হলো, যারা না বুঝে অলচিকির প্রচার প্রসারে লেগে আছেন, ঐ সব লোকেরা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার (হক) কে না বুঝে হনন করে চলেছে। অলচিকির সমর্থকেরা নিজেরাই অলচিকি জানেন না এবং তাদের নিজেদের সন্তানরাও অলচিকি লিপির মাধ্যমে সানতালী ভাষা লিখতে পড়তে জানে না। এই তথাকথিত অলচিকি সমর্থক সমাজ দরদীরা গরীব ও সরল গ্রামীণ জনতার সন্তানদের জন্য অলচিকি লিপিতে সানতালী ভাষায় পঠন-পাঠনের কথা বলে থাকে, কিন্তু অলচিকি সমর্থকেরা ক্রিশ্চিয়ান মিশনের ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে রোমান লিপিতে নিজের সন্তানদের পড়াশুনার জন্য পাঠায়। এঁরা রোমান লিপির মাধ্যমে নিজ সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে কোনও চেষ্টাই আর বাকি রাখেননি, অথচ রোমান লিপির মাধ্যমেই সানতালী শিক্ষা দানের ব্যবস্থার কথা উঠলেই এনাদের গা জ্বলে ওঠে কেন? পরিবর্তনের পর, আশা করা গিয়েছে যে সানতালী ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি এই সরকারী বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, কতিপয় ভেকধারী তথাকথিত সমর্থকদের দ্বারা এই জনদরদী সরকারও ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন। এই ভেকধারীরা পরিবর্তনের পরে রাতারাতি ডিগবাজি খেয়ে নিজেদের বর্তমান সরকারের প্রকৃত সমর্থক বলে তুলে ধরতে সক্ষম হন, এবং আগের মতোই অবৈজ্ঞানিক, ত্রুটিপূর্ণ ও অনুকরণকৃত অলচিকি লিপিকে সাধারণ সানতালী ভাষী জনগণের উপর চাপিয়ে দেবার কাজে বর্তমান সরকারকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
১৫। কোনও ভাষা লেখার জন্য কি লিপি বা কি কি লিপি সরকার বা আম জনতা দ্বারা ব্যবহৃত হবে, এই বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানের ‘রাজ্য তালিকা’’ বা ‘যৌথ’ ( রাজ্য-কেন্দ্র) তালিকায় কখনও অন্তুর্ভূক্ত করা হয়নি। এটি সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়।
১৬। অলচিকির সমর্থকেরা এবং নেতা, নেত্রী, মন্ত্রীরা দুটি মিথ্যা কথা পরিষ্কার ভাবে বলে থাকেন-(ক) অলচিকি ভাষা এবং (খ) অলচিকি লিপি সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অলচিকি লিপি সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি, কিন্তু শুধু সানতালী ভাষা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। ভাতরীয় সংবিধানে অষ্টম তপশীলে অদ্যাবধি মোট ২২টি ভাষা ‘সরকারী ভাষা’ রূপে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, যার মধ্যে সানতালী ভাষা একটি। এই ভাষাগুলি মধ্যে ভারত সরকার কেবলমাত্র ‘হিন্দী’ এবং ‘ইংরেজি’ ভাষা দুটি সরকারী কাজকর্ম লেখার ক্ষেত্রে লিপি হিসাবে যথাক্রমে ‘দেবনাগরী’ এবং ‘ রোমান’ লিপি দুটিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, বাকি ভাষাগুলি লেখার ক্ষেত্রে তেমন কোনও কেন্দ্রীয় সরকারী আদেশনামা নেই। অর্থাৎ, সানতালী ভাষাসহ অন্যান্য ‘সরকারী ভাষা’গুলি লেখার ক্ষেত্রে কোনও একটি ‘ বিশেষ’ লিপি নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই, এবং দেশে ‘(ভারত বর্ষে) প্রচলিত সবকটি লিপিই এই ক্ষেত্রে সমানভাবে স্বীকার করা হয়েছে।
১৭। অলচিকির সমর্থকেরা বলে থাকেন যে, ‘রোমান’ লিপি একটি অ-সানতাল লিপি, যা কিনা ‘সাহেবদের দ্বারা’, তাঁদের ভাষা চর্চার কাজে ব্যবহৃত না হলে নাকি সানতালদের জাত যাবে, মানে, তাঁরে জাতীত্ত্বাই নাকি বিপন্ন হয়ে পড়বে, এই কথাটা ঠিক নয়, এটি অসত্য কথা।
১৮। এই কু-যুক্তি শুনে মনে প্রশ্ন জাগে-বহুকাল থেকেই তো আসাম, মণিপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যের অ-বাঙালী জনগণ বাংলা লিপিকে আশ্রয় করেই তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা করে আসছেন, কই তাঁরাতো নিজেদের জাতিসত্ত্বা হারিয়ে বাঙ্গালি হয়ে যাননি? একইভাবে দেখা যাবে, পশ্চিম বাংলার সানতাল জনগণ বহুদিন থেকেই বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপির মাধ্যমে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশুনা করে আসছেন, অনেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, কই তাঁরা তো নিজেদের জাতকূল হারিয়ে মুরমু থেকে মুখার্জী, বেসরা বা বাস্কে থেকে ব্যানার্জী হয়ে যাননি! একই কথা খাটে ঝাড়খন্ড বিহারের সানতালদের ক্ষেত্রে, যাঁরা হিন্দী ভাষা ও দেবনাগরী লিপির মাধ্যমে পড়াশুনা করেও সেই সানতালী রয়ে গেছেন। কই তাঁরা তো সানতাল থেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ, হিন্দু পণ্ডিত বা হিন্দু কায়স্তে পরিনত হননি? তবে? রোমান লিপির বিরোধীতায় এরকম সংকীর্ণ মনোভাব কেন? রোমান লিপি তো রোমানদের কাছ থেকে নেওয়া, কই ইংরেজ, ফরাসী, স্পেনীয়, ডাচ্, ওলন্দাজ, স্কট, জার্মান প্রভৃতি জাতির লোকেরা তো রোমীয় বা ইতালীয় হয়ে যাননি। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতি রোমান লিপির মাধ্যমে ইংরেজি পড়াশুনা করছে, সেই সব জাতি তো ইংরেজ হয়ে যাননি? অথচ সানতালদের ক্ষেত্রেও তাঁদের মাতৃভাষা চর্চার জন্য রোমান লিপি ব্যবহার তাঁদেরকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে উন্নতির পথিক করে তুলবে, তাঁদের জাতিসত্ত্বা বিপন্ন হবার পরিবর্তে আরোও উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
১৯। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এখানে যেকোনও ব্যক্তি নিজ রুচি ও ইচ্ছা অনুযায়ী অবাধে যে কোনও ধর্ম পালন করতে পারেন। রাজনৈতিক নেতাটি সরলমতি সানতাল আদিবাসীদের এই বলে বিভ্রান্ত করছেন যে, সানতালদের একমাত্র স্বীকৃত ধর্মের নাম হলো ‘সারণা’ যে বা যারা এই ধর্ম পালন করেন না তাঁরা সানতাল বা আদিবাসী বলে পরিগণিত হতে পারে না। অথচ , সত্যি কথাটা হলো-সানতালদের আদি ধর্মের নাম হলো ‘সৗরি ধরম’, ‘সারণা’ নয়। এছাড়াও সানতালরা বর্তমানে অন্যান্য বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস অনুশীলন করছেন, যে অধিকার ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী প্রশ্নাতীতভাবে তাঁদের বা যে কারোরই রয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ থাকে যে, মহামান্য পাটনা হাইকোর্টের রায়ে বহু পূর্বেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে- একজন আদিবাসী সানতাল তাঁর পছন্দ অনুযায়ী যে কোনও ধর্ম পালন করতে পারেন, তাতে তাঁর আদিবাসীত্বের বা তদানুযায়ী অধিকারসমূহের কোনও হেরফের ঘটে/ঘটবে না। এই বিভ্রান্তকারী ও বিভেদকারী রাজনৈতিক অশুভ শক্তির ধারক, বাহক ও দালালদের থেকে সাধারণ সানতাল জনগণ সতর্ক থাকুন।
২০। অনেক ভাষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞের মতে , অলচিকিলিপি একটি বিকলাঙ্গ শিশুর মতো,শুনতে, বলতে, দেখতে, ঘ্রাণে, স্পর্শে ও চলতে অক্ষম। অলচিকির সমর্থকগণ অলচিকিকে সরকারী সহায়তায় জীবনদায়ী ভেন্টিলেটরে রেখেছেন বটে, কিন্তু নিকটভবিষ্যৎতে এর মৃত্যূ সুনিশ্চিত। অলচিকির নির্মাণকর্তা রঘুনাথ মুর্মুর ধ্বনি বিজ্ঞান এবং অক্ষর বিজ্ঞানে কোন জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিল না। জ্ঞান না থাকার কারণে তিনি সানতালী ভাষার ৪৭টি অক্ষরের পরিবর্তে মাত্র ৩০টি অক্ষরই বানাতে পেরেছেন, এই কারণেই অক্ষরের উচ্চারণও কাল্পনিক এবং আন্দাজে তৈরী করেছেন। সানতালী ভাষাতে কত স্বরবর্ণ এবং কত ব্যঞ্জণবর্ণ আছে তা রঘুনাথ মুর্মুর জানা ছিল না। অলচিকি একটি অবৈজ্ঞানিক (Unscintific) লিপি, তাতে কোন আধার (Base) ও নিয়ম-নীতি(System) নেই। রঘুনাথ মুর্মূকে পণ্ডিত উপাধি ফুটবল খেলার সময় দেওয়া হয়েছিল। কোন বিশ্ব বিদ্যালয় তাঁকে পণ্ডিত উপাধি দেয়নি।

সানতালী ভাষার জন্য প্রচলিত বিভিন্ন লিপির মধ্যে কেবলমাত্র রোমান লিপিরই ব্যবহারিক উপযোগীতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এই লিপিটি কোনো দেশ বিশেষ, কোনো জাতি বিশেষ, কোনো ধর্ম বিশেষ ও কোনো রাজনৈতিক দল বিশেষের নয়। রোমান লিপির কার্যকারিতা এবং সার্বজনিন গ্রহণযোগ্যতা আজ কারোরই সুপারিশের অপেক্ষা রাখে না, তা এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। মানবসভ্যতার অধিকাংশ জ্ঞানভাণ্ডার, সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা চর্চা, সবই প্রায় এই বিশ্বজনিন লিপিকে আশ্রয় করেই উন্নতির পথে এগিয়েই চলেছে। মানব জাতির ভবিষ্যতেও এই লিপিতে নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে এবং এগিয়ে চলছে, ইতিহাসের অমোঘ গতিকে রুখবে, প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থান্বেষীদের সেই সাধ্য কোথায়? জয় চিরকালই সত্যের হয়েছে এবং হবেই। তথ্যসূত্র: ভারত পত্রিকা/ লিফলেট অবলম্বনে।

আরো বিষদে জানার জন্য নিম্নলিখিত বইগুলি অবশ্যই পড়ুন-
১। অলচিকি একটি মৌর্য্যযুগীয় লিপি-দুরবীন সরেন, ২। অলচিকি কী ক্রটিয়াঁ- সুকুমার হেমব্রম, ৩। সানতালী ভাষার জন্য লিপির নির্বাচন- ড. অনিমেষ কান্তি পাল,৪। অলচিকি এক অবৈজ্ঞানিক লিপি- হানুক হাঁসদাক, ৫। সানতালী ভাষার জন্য অলচিকি কেন?-ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক, ৬। ‘‘সংবিধানের অষ্টম তপশিলীতে সানতালী ভাষার স্বীকৃতি’’ ২২ ডিসেম্বর ২০০৩ সরকারী আদেশনামা দেখুন।

বাবুল রবিদাস
এ্যাডভোকেট
জজকোর্ট, জয়পুরহাট।

Continue Reading

মতামত

কোথা থেকে এল বাংলা লিপি

Avatar photo

Published

on

এড. বাবুল রবিদাস
মনের ভাব প্রকাশের জন্য লিখিত খোদিত বা অঙ্কিত সাংকেতিক চিহ্নকে লিপি বলে। মাটির ঘর লেপন করতে গিয়ে দাগ সৃষ্টি হয়। এই লেপা থেকে জন্ম হয়েছে লিপি শব্দের। লেপনের কাজে যখন রং বা বর্ণের ব্যবহার শুরু হয়, তখন তার আরেক নাম হলো বর্ণ। বর্ণ যখন গাছের পাতায় বা পত্রে লাগানো হতো, তখন তা হলো পত্রলেখা। লেখায় বা রেখায় ধ্বনি স্থায়ী রুপ লাভ করায় এর নাম হয়ে গেল অক্ষর। অর্থাৎ, যার কোনো ক্ষরণ বা ক্ষয় নেই। অক্ষর, বর্ণ আর লিপি শব্দগুলো তাই প্রায় সমার্থক হয়ে রয়েছে।

১০-১২ হাজার বছর আগের গুহাচিত্র দেখে সিদ্ধান্তে পৌছানো গেছে, চিত্রলিপি থেকে বর্ণলিপির উৎপত্তি হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে ছবি আঁকা ছাড়া অন্য পদ্ধতিও প্রচলিত ছিল। যেমন দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে পাওয়া যায় গ্রন্থিলিপি। দড়িতে গিট দিয়ে তারা মনের ভাব ধরে রাখত। বাংলা লিপির উৎপত্তি সম্পর্কে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় The Origin of the Bengali Script (১৯৬৯) গ্রন্থে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন। ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপির জন্ম হয়েছে। অশোকের সময়কার ব্রাহ্মী লিপি গুপ্ত যুগে এসে নানা আঞ্চলিক বিশিষ্টতা লাভ করে। পূর্ব ভারতের বিশেষ ব্রাহ্মী বর্ণমালার পূর্ব প্রান্তীয় রুপের নাম কুটিল। এই কুটিল লিপি থেকে দশ এগারো শতকে বাংলা, উড়িয়া, অসমিয়া, নেওয়ারি, মৈথিলী ইত্যাদি বর্ণমালার উদ্ভব ঘটে। অবশ্য বাংলা-অসমিয়ার কোনো কোনো বর্ণ দশ শতকের অনেক আগেই দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বর্ণমালার গুচ্ছ বা সেট মোটামুটি এই সময়ে একটা নির্দিষ্ট আকার নেয়।

চিত্রলিপি থেকে বর্ণলিপি-
ভাবনাকে ধরে রাখার জন্য গুহাবাসী মানুষ পর্বতের গায়ে ছবি আঁকত। গুহায় আঁকা ছবিগুলো ছিল বাক্যনির্ভর। অর্থাৎ, প্রতিটি ছবি একটি কথা বা ভাবকে প্রকাশ করত। কিন্তু এর সমস্যা ছিল-অল্প কথা বোঝানোর জন্য অনেক বেশি আঁকতে হতো। প্রকৃত বর্ণনার যথাযথ চিত্রণও সহজ ছিল না। এর পরবর্তী পর্যায়ে তৈরী হয় Pictogram বা চিত্রলিপি। উত্তর আমেরিকার আদিম মানুষের লেখায় চিত্রলিপির নিদর্শন পাওয়া গেছে। চিত্রলিপি পদ্ধতিতে একেকটি চিত্র হতো এককটি বস্তুর প্রতীক। পরপর আঁকা কয়েকটি বস্তুচিত্রের মাধ্যমে কোনো বক্তব্য বা ভাবকে প্রকাশ করা হতো। এই পদ্ধতিতে মনের সূক্ষ্ম অনুভূতি বোঝানো সম্ভব ছিল না। এর ধারাবারিকতায় Ideogram বা ভাবলিপির জন্ম হয়।

ভাবলিপিতে একেকটি প্রতিকৃতি সংক্ষিপ্ত বা সাংকেতিক হয়ে একটি বিশেষ চিহ্ন হয়ে দাড়ায়। চিত্রলিপিতে প্রতিটি চিত্র ছিল বস্তুচিত্র। ভাবলিপিতে প্রতিটি চিহ্ন সে বস্তুকে না বুঝিয়ে বস্তুর নামবাচক শব্দকে নির্দেশ করত। যেমন, প্রাচীন সুমেরীয় লিপিতে প্রথমে ‘মাছ’ বোঝাতে মাছের চিত্রই আাঁকা হতো। পরবর্তীতে স্তরে লিপি বিবর্তনের ফলে মাছের চিত্র একটি বিশেষ চিহ্নে রুপান্তরিত হয়, যার সঙ্গে মাছেরআকৃতির কোনো মিল নেই। লিপিবিজ্ঞানীরা এই স্তরের লিপিকে Logogram বা শব্দলিপি আখ্যা দিয়েছেন।

শব্দলিপি বিবর্তিতত হয়ে নাম নিল অক্ষরলিপি। শব্দলিটিতে ভাষায় ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের জন্য আলাদা প্রতীক বা চিহ্ন মনে রাখা সহজ ছিল না। পরবর্তী সময়ের লিপিতে বিভিন্ন ‘চিহ্ন’ একটি শব্দের সব ধ্বনিকে না বুঝিয়ে একটি Syllable বা অক্ষরকে নির্দেশ করতে থাকে। এই লিপিই Syllabogram বা অক্ষরলিপি নামে পরিচিত। অক্ষরলিপিতে চিহ্ন ব্যবহারের সংখ্যাও অনেক কমে আসে। অক্ষরলিপির পরিবর্তিত রুপের নাম হলো ধ্বনিলিপি বা Alphabetic Script প্রথমে একেকটি শব্দকে চিহ্নিত করা হতো একেকটি প্রতীক বা চিহ্ন হিসেবে। তারপর শব্দের প্রথম অংশ বা প্রথম সিলেবল ধরে একেটি প্রতীক বা ছবি ব্যবহৃত হতো। পরে প্রথম ধ্বনির প্রতীক হয়ে ওঠে সেই চিহ্ন। এভাবে লিপির বিকাশের চুড়ান্ত পর্যায়ে পাওয়া গেল বর্ণলিপি।

ভারত ছাড়া অধিকাংশ দেশের ভাষার লিপিতে ধরা পড়ে ধ্বনিমূলক বর্ণ। আর ভারতীয় লিপি সম্পূর্ণ ধ্বনিমূলকও নয়, সম্পূর্ণ অক্ষরমূলকও নয়। বাংলা লিপিও তা-ই। সাতটি লিপিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম লিপি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো সুমেরীয় লিপি, মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপি, ক্রিট দ্বীপবাসীর লিপি, হিত্তিলিপি, চীনালিপি, এলামবাসীর প্রাচীন লিপি ও সিন্ধু লিপি।

সিন্ধু লিপি-
সিন্ধু লিপি এ উপমহাদেশের প্রাচীনতম লিপি। সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া বিভিন্ন সিলমোহরে এই লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে জন মার্শাল সম্পাদিত Mohenjo-daro and the Indus Civilisation (১৯৩১) গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে সিন্ধু লিপির উৎস ও পাঠ সম্পর্কে প্লিতদের মন্তব্য বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। লিপিতত্ত্ববিদ গ্যাডগিল মনে করেন, সিন্ধু লিপি লেখা হতো ডান থেকে বাঁ দিকে। লিপিতত্ত্ববিদেরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের প্রাচীন লিপির সঙ্গে সিন্ধু লিপির সাদৃশ্য পেয়েছেন। সুমেরীয়, আফ্রিকা ও আরব দেশের কোনো কোনো ভাষার অক্ষরের সঙ্গে এই লিপির সাদৃশ্য রয়েছে।
খরোষ্ঠি লিপি-

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম বর্ণমালা দুটি-খারোষ্ঠি ও ব্রাহ্মী। ‘খারোষ্ঠি’ শব্দের মূল-খরপোস্তা। ভারতীয় আর্য ভাষার শব্দ ‘খর’ এবং ফারসি ভাষার শব্দ ‘পোস্তা’ মিলে খরপোস্তা শব্দ তৈরী হয়েছে। শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ গাধার চামড়া। খরোষ্ঠি লিপির প্রাচীনতম যে কয়েকটি নির্দশন মধ্য এশিয়ায় পাওয়া গেছে, তার অধিকাংশই উট, ঘোড়া বা গাঁধার চামড়ার পান্ডুলিপি। পাকিস্তানের প্রাচীনতম লিপি খরোষ্ঠি। খ্রিষ্টপূর্ন তিন শতক থেকে খ্রিষ্টীয় পাঁচ শতক পর্যন্ত খরোষ্ঠি লিপির ব্যবহার ছিল। বিভিন্ন স্থানে আবিস্কৃত খরোষ্ঠি লিপির নিদর্শন এ লিপির বহুল ব্যবহার প্রমাণ করে। খরোষ্ঠি লিপি ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লিখতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে মধ্য এশিয়াও খরোষ্ঠি লিপির প্রচলন ছিল।

ব্রাহ্মী লিপি-

ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানে প্রচলিত প্রায় সব লিপিই ব্রাহ্মী বর্ণমালা থেকে উদ্ভৃত। উপমহাদেশের বাইরের কয়েকটি লিপি, যেমন সিংহলী, বর্মি, যবদ্বীপি ও তিব্বতি লিপি এই বর্ণমালা থেকে এসেছে। খ্রিষ্টপূর্ব তিন শতকে সম্রাট অশোকের সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে উত্তর-পশ্চিমাংশ ছাড়া সব জায়গায় ব্রাহ্মী লিপির প্রচলন ছিল। এই লিপি ‘অশোক লিপি’ নামেও পরিচিত। অনেকের মতে, ব্রহ্মার কাছ থেকে পাওয়া বলে এর নাম ‘ব্রাহ্মী’। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, ব্রাহ্মণদের লিপি বলে এর নাম ‘ব্রাহ্মী’। ব্রাহ্মী লিপির নামকরণের সঙ্গে ব্রহ্মা বা ব্রাহ্মণদের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা, এটা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

কানিংহামের মতে, ব্রাহ্মী লিপি ভারতীয় উপমহাদেশেই উদ্ভূত। তিনি এ যুক্তির সমর্থনে বিভিন্ন বর্ণের সঙ্গে কোনো না কোনো বস্তুর আকৃতিগত সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, ধনুকের চিত্রের সঙ্গে ব্রাহ্মী লিপির ‘ধ’ মাছের আকৃতির সঙ্গে ‘ম’ বর্ণের সাদৃশ্য রয়েছে। ব্রাহ্মী লিপির পূর্ববর্তী কোনো লিপ এ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ-এ লিপি, লিপিকর, বর্ণ, অক্ষর প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, পাণিনির সময়ে খ্রিষ্টপূর্ব চার শতকে লিপির প্রচলন ছিল। অশোকের অনুশাসনে ব্রাহ্মী লিপির যে নির্দশন পাওয়া যায, তা সুগঠিত ও পরিণত। সুতরাং, এর আগে ব্রাহ্মী লিপির কোনো প্রাচীনতর রূপ থাকা স্বাভাবিক।

ব্রাহ্মী লিপি বাংলা লিপি-
ভারতে প্রচলিত ব্রাহ্মী লিপি দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে পরিবর্তিত হয়ে আজকের বাংলা লিপিতে রুপান্তরিত হয়েছে। খ্রিষ্টীয় এক শতক থেকে লিপির বিবর্তন শুরু হয়। ব্রাহ্মী লিপির বিবর্তনের ইতিহাসে পরবর্তী দুটি স্তরের নাম-কুষাণ লিপি ও গুপ্ত লিপি। খ্রিষ্টীয় এক থেকে তিন শতক পর্যন্ত কুষাণ রাজাদের আমলে কুষাণ লিপি প্রচলিত ছিল। এই লিপিতে ব্রাহ্মী লিপির বিভিন্ন বর্ণের বির্তন লক্ষ করা যায়। কুষাণ লিপির ছ, জ, থ, ধ, ট, ঠ বর্ণ ব্রাহ্মী লিপির অনুরুপ। এি লিপিতে ক, চ, ঝ, ড, দ, ন, প য বর্ণে সংক্ষিপ্ত মাত্রার ব্যবহার দেখা যায়। কুষাণ লিপির চ এবং ঢ বর্ণ দুটিতে বাংলা চ এবং ঢ বর্ণের আদিরূপের সন্ধান পাওয়া যায়।

খ্রিষ্টীয় চার ও পাঁচ শতকে গুপ্তলিপি ভাতরীয় উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল। গুপ্তবংশীয় রাজাদের দ্বারা এ লিপি প্রচারিত হওয়ায় এর নাম হয়েছে গুপ্ত লিপি। গুপ্ত লিপির অধিকাংশ বর্ণ সংক্ষিপ্ত মাত্রাবিশিষ্ট। এই লিপির কোনো কোনো বর্ণে কুষাণ লিপির প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু অধিকাংশ বর্ণেরই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে।

খ্রিষ্টীয় ছয় শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে যেসব লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে পূর্বাঞ্চল লিপি, উত্তরাঞ্চল লিপি ও দক্ষিণাঞ্চল লিপি। সাত শতকে পূর্বাঞ্চল লিপির দুটি ভাগ দেখা যায়া-পূর্বী ও পশ্চিমী। পশ্চিমী শাখার নগর লিপির প্রসার ঘটে সমগ্র উত্তর ভারতে। পরে এই নাগর লিপি থেকে দেবনাগরী লিপির জন্ম হয়। ৯ শতক পর্যন্ত ভারতের পূর্বাংশে পূর্বী লিপির প্রচলন ছিল। বর্ণের আকৃতি কিছুটা জটিল বা কুটিল ছিল বলেই এ লিপির নামকরণ করা হয় কুটিল লিপি। এই লিপির ব, ম, ন, জ, ক বর্ণে বাংলা বর্ণের প্রাচীন রূপ বিদ্যমান।

পূর্বী শাখার লিপি-
দশ শতকের শেষ দিকের রাজা প্রথম মহীপালের সময়ের কিছু পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে। এর অনেক অক্ষরের রূপ বাংলার কাছাকাছি। এই লিপিকে ১০ শতকের বর্ণলিপির নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। ১১ শতকের বাংলা লিপির নমুনা পাওয়া যায় বিজয় সেনের দেওপাড়া লিপিতে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এ সময়ের লিপির প্রায় ২২টি বর্ণে বাংলা হরফের রূপ পরিণত অথবা প্রায় পরিণত। ১২ শতকের লিপির নিদর্শন দেখা যায় লক্ষ্মণ সেনের আনুসুয়া লিপি, বিশ্বরূপ সেনের দানপত্র লিপি প্রভৃতি উপকরণে। ১৫ শতকের লিপির নমুনা মেলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ‘পুঁথিতে’।

১৬ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত বাংলা লিপির কিছু বৈচিত্র্য দেখা যায়। হস্তলিখনের দ্রুততার জন্য বা লিপিকারের লিপি-বিশিষ্টতার জন্য এ সময় কোনো কোনো বর্ণের আকৃতিগত পার্থক্য তৈরী হয়েছে। উনিশ শতকে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যাপক প্রচলনের পর বাংলা হরফ স্থায়ী রূপ লাভ করে। এর আগে ১৭৭৮ সালে নাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের ব্যাকরণ গ্রন্থে প্রথম বাংলা অক্ষর মুদ্রিত হয়। (তথ্য সূত্রঃ বিজ্ঞান চিন্তা, ফেব্রুয়ারী-২০২১।

লেখক: আইনজীবি, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট।

Continue Reading

মতামত

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আনন্দ মোহন কলেজে আনন্দ র‍্যালি

Avatar photo

Published

on

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্রলীগের আনন্দ র‍্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সোমবার সকালে আয়োজিত র‍্যালিটি আনন্দ মোহন কলেজের ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় আনন্দমোহন কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. নাজমুল ইসলাম সাকিব নেতৃত্ব দেন।

এ সময় তিনি বলেন, জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাবে ও শেখ মুজিবের আদর্শে কাজ করে যাবে ছাত্রলীগের প্রতিটি ইউনিট। সকল অপশক্তিকে রোধকল্পে আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্রলীগ ইউনিট সবসময় প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি।

Continue Reading