ভূ-বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, হিমালয়ে ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে তিনটি খাঁজ রয়েছে। আর এর মধ্যে প্রধান প্রান্তীয় (মেন বাউন্ডারি) খাঁজটি অনেক আগে থেকেই সবচেয়ে অস্থির হয়ে আছে।
শনিবারের এতদাঞ্চলে ৭.৯ রিখটার স্কেলের যে ভূমিকম্পটি হয়েছিলো সেটিও ঘটে এই খাঁজে। ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, এতে আরও অস্থির হয়ে পড়েছে খাঁজটি। তারা বলেছেন ওই খাঁজের এলাকার দু’টি প্লেটের মধ্যেকার ছোট ছোট চ্যুতি-বিচ্যুতিগুলো শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটাতে শুরু করেছে।
এছাড়াও শনিবারের ভূমিকম্পের পর কোথায় কোথায় ফাটল ধরেছে, তা স্পষ্ট হওয়া যাচ্ছে না। ওই সব ফাটলেও শক্তি সঞ্চিত হতে পারে। আর এই শক্তি যত বাড়বে, ভূমিকম্পের আশঙ্কা ততই বাড়তে থাকবে।
এদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, হিমালয় অঞ্চলে ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশীয় প্লেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে ভূমিকম্পপ্রবণ খাঁজ ও চ্যুতিগুলিকে ইতিমধ্যে শনাক্ত করেছেন ভারতীয় ভূ-পদার্থবিদ্যার গবেষকেরা।
তারা আশঙ্কা করছেন, সেগুলোয় সঞ্চিত বিপুল পরিমাণ শক্তি নেপাল, সিকিম, কাশ্মীর কিংবা অাসম-অরুণাচল এলাকায় অদূর ভবিষ্যতে একাধিক অতি প্রবল ভূমিকম্প ডেকে আনতে পারে।
গোটা হিমালয় অঞ্চলের পরিস্থিতি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে বলেই মত এই ভূ-গবেষকদের। তারা বলছেন, ব্যাপকভাবে বন-জঙ্গল ধ্বংস আর ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বিধি ভেঙে যত্রতত্র বাড়ি-সেতু-হোটেল ইত্যাদি গজিয়ে ওঠায় ঝুঁকি আরও বাড়ছে।
নেপালে শনিবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত ছিল, তাতেই ৯ মাত্রার কম্পন হতেই পারত এমনটা মত দিয়ে ভূ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে সিকিমের যে অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়েছিল, সেখানেও যে কোনও দিন ৯ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প তৈরি হতে পারে।
হিমালয় অঞ্চলে ঘটে যাওয়া বড় ভূমিকম্পের মধ্যে সবচেয়ে শীর্ষে ১৯৫০ সালের আসমের ভূমিকম্প (মাত্রা ৮.৬ রিখটার)। দ্বিতীয়টি ১৯৩৪ সালে নেপাল-বিহারের (৮.১)। তৃতীয় সর্বোচ্চটি ঘটে গেলো ২০১৫ এর ২৫ এপ্রিল (৭.৯)। এর আগে ২০০৫-এ কাশ্মীরের (৭.৬) আর ঠিক এর ১০০ বছর আগে ১৯০৫-এ হিমাচলে কাংড়ার (৭.৫) মাত্রার ভূমিকম্প। এসব ক’টি ভূকম্পেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০১১-র সিকিমের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৯। সে ভূমিকম্পেও ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি কম হয়নি।
হিমালয় অঞ্চলে এ পর্যন্ত ৯ রিখটার মাত্রার ভূমিকম্পের কোনও রেকর্ড নেই। তবে তা সত্যিই কখনও হলে কল্পনাতীত বিপর্যয় হতে পারে বলে হিমালয় সংলগ্ন গোটা অঞ্চলে।
এ ব্যাপারে বারবার সতর্ক করেছেন ভূ-বিজ্ঞানীরা।
এদিকে মূল ভূমিকম্পের ধাক্কা কাটলেও আগামী ক’দিন নেপাল কাঁপবে পরাঘাতে (আফটার শকস)। পর পর দুই দিনের দুটি ভূমিকম্পের পর মাটির তলায় ওলট-পালট অনেক কিছুই ঘটে গেছে। এখন সেগুলো ঠিক ঠিক মতো বসতেও বারবার কাঁপবে মাটি, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূ-বিজ্ঞানীরা জানিয়ে দিয়েছেন, পুরো বিষয়টি একটা স্বস্তির জায়গায় ফিরতে সময় লাগবে। আফটার শকগুলোর মাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও আগামী সাত দিন রাত-বিরেতেও ছোটখাটো কম্পন চলতেই থাকবে।
শনিবারের ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার পর ছোট ছোট যেসব কম্পন হয় তা পরাঘাত হলেও ঠিক ২৫ ঘণ্টা পর রোবার দুপুরের ৬.৭ মাত্রার কম্পনটি ছিলো সরাসরি নতুন ভূমিকম্প। এটাই ভাবিয়ে তুলেছে ভূ-বিজ্ঞানিদের।
রোববারের কম্পনটির উৎসও সেই নেপালে— কাঠমান্ডুর দেড়শো কিলোমিটার দূরে, কোদরায়। আর শনিবারের ভূকম্পনটি ছিলো কাঠমান্ডুর ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পোখরায়।
শনিবার যে ভূমিকম্পটি তৈরি হয়েছিল, তার জেরে রবিবার সকাল পর্যন্ত অন্তত তিরিশ বার কেঁপে উঠেছে নেপালের মাটি। ভূ-বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন সেগুলো সব আফটারশক। এর একটার মাত্রা ছিল ৬.১ পর্যন্ত উঠলেও তা আফটার শকই ছিলো।
রবিবার দুপুরের কম্পনের পরেও প্রাথমিক ভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল, এটাও আফটারশক। কিন্তু সঠিক অবস্থান, মাত্রা ও উৎসস্থল বিশ্লেষণ করে ভূ-বিজ্ঞানীদের বুঝতে পারেন, এটি একটি নতুন ভূমিকম্প।
সেটানেই লাগে খটকা। কোথাও বড় মাপের ভূমিকম্প হয়ে গেলে কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে আর একটা বড়-সড় ভূকম্প প্রায় নজিরবিহীন। তা হলে মাত্র ২৫ ঘণ্টার ব্যবধানে তা ঘটল কিভাবে?
ভারতীয় ভূ-বিজ্ঞানীরা অবশ্য এর একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
আইআইটি খড়গপুরের ভূমিকম্প-বিশেষজ্ঞ শঙ্করকুমার নাথের মতে, শনিবার ভারতীয় প্লেটটি ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার সময় দু’জায়গায় ফাটল তৈরি হয়। তবে শক্তি নির্গত হয় কাঠমান্ডুর কাছের ফাটল দিয়ে। আর এর চব্বিশ ঘণ্টা বাদে অন্য ফাটলটিও নিজের সঞ্চিত শক্তি বের করে দেয়। আর তাতেই নতুন ভূমিকম্পের উৎপত্তি।
আফটারশক কেনো হয়? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিশেষজ্ঞেরা জেনেছেন, একটা বড় ভূমিকম্পের প্রভাবে ভূগর্ভের বিভিন্ন প্লেট অস্থির হয়ে পড়ে। প্লেটে প্লেটে ঘর্ষণ বাড়তে থাকে। এসময় প্লেটগুলো তাদের অবস্থানও বদলায় ঘন ঘন। ফলে গোটা এলাকা বেশ কয়েকদিন থেমে থেকে কেঁপে ওঠে।
উদাহরণ হিসেবে ২০০৪-এর সুনামির প্রসঙ্গ টেনে ভূ-বিশারদেরা জানিয়েছেন, ওই বিপর্যয়ের এক মাস পর্যন্ত আন্দামানে ঘন ঘন আফটারশক হয়েছে।