দেশজুড়ে
বড়াইগ্রামের ১২ খ্রিষ্টান পল্লীতে হত্যা আতঙ্ক, সন্ধ্যা নামলেই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ
বড়াইগ্রাম (নাটোর) প্রতিনিধি: নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া খ্রিষ্টান ধর্মপল্লীর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করার আটদিন অতিবাহিত হলেও এখনও হত্যা আতঙ্ক কাটেনি বনপাড়াসহ উপজেলার বারোটি খ্রিষ্টান পল্লীর বাসিন্দাদের মধ্যে। দিনে বা সন্ধ্যায় ষাটোর্ধ প্রবীণদেরকে একা রাস্তায় ছাড়ছেন না বাড়ির অন্যান্য লোকজন। সন্ধ্যা হলেই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিচ্ছেন বাসিন্দারা এবং এই সময় ওই এলাকাগুলোর সড়কে খুব কম সংখ্যক মানুষের চলাচল চোখে পড়েছে। ৫ জুন সুনীল হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার পর খ্রিষ্টান ধর্মপল্লীগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও পুলিশ প্রশাসনের নিয়মিত টহল না থাকায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে খ্রিষ্টান পল্লীর বাসিন্দারা।
রোববার সন্ধ্যা সাতটার দিকে স্থানীয় চার সাংবাদিক নিহত সুনীলের স্ত্রী জাসিন্তা রিবেরুর সাথে কথা বলতে বনপাড়া মিশন পাড়ায় তাদের বাড়িতে গেলে সেখানে দেখা গেছে বাড়ির সকল দরজায় তালা ঝুলছে। আশে-পাশের কমপক্ষে ৮ বাড়িতে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করলেও বাসিন্দারা কেউ দরজা খুলেননি। এমনকি কথাও বলেননি। পরে সরেজমিনে কালিকাপুর, বাহিমালী, সাতেনগাছা, শ্রীখন্ডি এলাকায় গেলে সেখানেও দেখা গেছে অধিকাংশ বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ। ২/১জনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে অনেক ডাকাডাকির পর জানায় দিনের বেলায় আসেন কথা বলতে পারবো। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই অবস্থা বিরাজ করছে বর্ণি, জোনাইল, বাগবাচ্চা. সংগ্রামপুর, রাজাপুর, ভবানিপুর, কুমুল্লু খ্রিষ্টান পল্লীতে। পরের দিন সোমবার সকালে ওইসব এলাকায় পুনরায় সরেজমিনে গেলে অনেকেই জানায়, তাদের মধ্যে এখনও ভীতি কাজ করছে। গ্রামের অনেক বাড়িতে বাইরে প্রসাব-পায়খানার জন্য টয়লেট রয়েছে যা রাতে ব্যবহার করার প্রয়োজন হলে বাড়ির সকল সদস্যকে ডেকে তুলতে হয়। ৮/৯ বছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য প্লাষ্টিকের পট কিনে ঘরের মধ্যে রেখেছে কেউ কেউ। ধনী বা মধ্যবিত্ত অনেকেই বাড়ির নিরাপত্তার জন্য ইতিমধ্যে বারান্দায় গ্রিল দেয়া, বাউন্ডারি করা বা লোহার গেট করার কাজ শুরু করেছে।
এদিকে সুনীল গোমেজ (৬৫) হত্যার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে ডিবি পুলিশ রোববার মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে ঢাকার বাড্ডা এলাকা থেকে আতœগোপনে থাকা সুনীলের বাড়ির নারী ভাড়াটিয়া মনোয়ারা খাতুন ওরফে মনি (২৫) কে আটক করে নাটোর আদালতের মাধ্যমে ৫ দিনের রিমান্ডে আনে। আটক মনোয়ারা মনি বনপাড়া কালিকপুরের রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ও মফিজুদ্দিন ওরফে মফিজ কসাইয়ের মেয়ে। সে সুনীলের বাড়িতে ভাড়া থাকতো এবং তার স্বামী ঢাকায় থাকতো। নাটোর জেলা গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) ওসি ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল হাই তালুকদার জানান, মনিকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের পর হত্যার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি আশা করেন শীঘ্রই হত্যার সাথে জড়িতদের আটক করা সম্ভব হবে।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক সুনীলের বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়া ও প্রতিবেশীরা জানায়, মনোয়ারা মনির ওই বাসায় দিনে ও রাতে চলতো ইয়াবা-হেরোইনসেবীদের আড্ডা। অনেকেই সন্দেহ করে বলেন, তাদের মধ্যে অনেকের সাথে মনি টাকার বিনিময়ে দৈহিক মেলা-মেশাও করতো। মূলত: ডিবি পুলিশ এই সব তথ্য পাওয়ার পর মনিকে আটক করেছেন। বনপাড়া ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত ফাদার বিকাশ হিউবার্ট রিবেরু বলেন, পুলিশ কাকে আটক করলো সেটা মুখ্য বিষয় নয়। তবে নির্দোষ কাউকে আটক করে সমাজের কাছে হেয় ও অসম্মান করা হলে সেটা হবে দুঃখজনক। এক্ষেত্রে পুলিশ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও একই সাথে প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করতে পারলে আসল খুনীদের খুঁজে বের করতে খুব একটা সময় লাগবে বলে আমার মনে হয় না। তিনি আরও বলেন, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ করে নারী ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশী আতঙ্কগ্রস্থ অবস্থায় রয়েছেন। এই আতঙ্ক কাটতে বেশ কিছু সময় লাগবে। তবে এই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্ত হলে এই আতঙ্ক ও ভীতিকর অবস্থা আরও চরম পর্যায়ে যাবে।