Connect with us

জাতীয়

পাঠক প্রতিক্রিয়া: আপনার সন্তানকে নিয়ে একটু ভাবুন

Published

on

শ্রদ্ধেয় মুরুব্বীগণ, আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানবেন। আমি আপনাদের পুত্র ও পৌত্রসম একজন তরুণ হিতাকাক্সক্ষী। বহুদিনের অব্যক্ত কিছু বাস্তব অনুভূতি ও সঞ্চিত অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে বসেছি নিছক দায়বদ্ধতাবশত। অবশ্য এই দায়বদ্ধতা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি নয়, আমার বিবেক-বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব ও আমার ধর্মের প্রতি। সে দায়মোচনের লক্ষ্যেই এ খোলাচিঠির আশ্রয়।
বহুবার শুনেছি, জেনেছি- শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, শিক্ষা ছাড়াও তেমন বিশ্বদরবারে কোনো জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, বারবার তাকে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। শিক্ষা মানুষের দৃষ্টিসম। একটি মানবশিশু মায়ের গর্ভ থেকেই চর্মচক্ষু লাভ করে, কিন্তু জগতে ওই চর্মচক্ষুই যথেষ্ট নয়। দৃষ্টির সাথে সাথে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি। শিক্ষা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে, ন্যায়-অন্যায়, করণীয়-বরণীয়, বৈধ-অবৈধ জ্ঞান প্রদান করে। চিন্তাশক্তি, বোধশক্তির দুয়ার উন্মোচন করে। সুবিস্তীর্ণ নীলাকাশ দেখে কেউ ভূত-প্রেতের নিবাস কল্পনা করে, আবার কেউ গ্রহ-নক্ষত্র-তারকারাজী দেখে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ভ্রমণের নকশা আঁকে, মহাবিশ্বের বিশালতা দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে স্রষ্টার মাহাত্ম কীর্তন করে। দৃষ্টিভঙ্গির এই ব্যবধান শুধুই শিক্ষাপ্রসূত। এখন দেখার বিষয় হলো আমরা যে শিক্ষা লাভ করছি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা রেখে যাচ্ছি তা কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করছে।
আজ আমাদের বাস্তবতা হলো, কোনো তরুণ-তরুণী অসম্ভব প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে নামকরা একটি দেশীয় বা ভিনদেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেলে তার পরিবার-পরিজনের আনন্দের অন্ত থাকে না। এই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবেশিদের কাছে, যাচিত বা অযাচিত উভয়প্রকারেই। কার ছেলে কোন ভার্সিটিতে পড়ে, কার মেয়ে কোন নামকরা বিদ্যাপীঠে স্থান পেল অভিভাবকরা সেটাকেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে ভালোবাসেন। কিন্তু এ আত্মতৃপ্তির সঞ্জিবনী রস যে কবে শুকিয়ে গেছে সে খবর কি তারা রাখেন? বিনীত অনুরোধ- আগেই আনন্দে আটখানা হবেন না। আপনার আনন্দের সময় এখনও আসে নি। প্রতিষ্ঠানের নাম-যশ আপনার কোনো কাজে আসবে না যদি না প্রিয় সন্তানের সুশিক্ষা লাভ হয়। যখন দেখবেন আপনার ছেলে বা মেয়ে সুশিক্ষা লাভ করে মানুষের মতো মানুষ হতে পেরেছে, এই জগৎ-সংসারকে কিছু দিতে পারছে, কেবল তখনই আপনার আনন্দের সময় আসবে। তখন আপনি গর্ব করে বলতে পারবেন- আমার সন্তান শিক্ষিত এবং অবশ্যই সুশিক্ষিত; আমার সন্তান দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করছে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে মানবতার কল্যাণে কাজ করছে। আমি গর্বিত, আমি আমার সন্তানকে নিয়ে গর্বিত। কিন্তু যদি দেখেন আপনার প্রাণপ্রিয় সন্তান দেশের জন্য নয়, মানুষের জন্য নয়, এমনকি পরিবার-পরিজনের জন্যও নয়- নিছক নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, নিজের এতটুকু সুবিধা অর্জনের জন্য দেশ-জাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে, কিংবা কোনো দেশবিরোধী অসাধু স্বার্থান্বেষী মহলের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তখন আর গর্ব নয়, আপনার পুত্রের সেই শিক্ষা আপনাকে লজ্জায় ডোবাবে। তাই বলছি, আগেই খুশিতে আটখানা হবেন না, সন্তানের দিকে দেখুন, শুধু বাবা হিসেবে নয় একজন দেশপ্রেমিকের দৃষ্টিতে বিচার করুন।
আমিও একজন বাবার সন্তান, আমার বাবাও আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, সন্তানের সাফল্যে বাবা-মায়ের নিঃস্বার্থ আনন্দ পুরোটা অনুভব না করলেও, কিছুটা বুঝি। আপনিও আপনার সন্তানকে নিয়ে সীমাহীন আশাবাদী, সন্দেহ নেই। সেই আশার আলো যাতে অশুভ শক্তির দমকা হাওয়ায় মুহূর্তেই নিভে না যায় সে কারণেই বলছি- ভার্সিটি-কলেজে পড়–য়া সন্তানটিকে আরও একবার দেখুন। চর্মচক্ষুর পাশাপাশি অন্তরের চোখ দিয়ে দেখুন। ছেলে লেখাপড়া করছে, লেখাপড়া শেষে একদিন চাকরি-বাকরি করবে বা ব্যবসা করবে, কাড়ি কাড়ি টাকা রোজগার করবে, অর্থ-বিত্তের প্রাচুর্য তৈরি করবে- যদি এই হয় আপনার বাসনা তাহলে আমার কিছুই বলার নাই। আপনি অপেক্ষা করুন। নিশ্চয়ই আপনার আশা পূরণ হবে, কারণ যুগের হাওয়া ওদিকেই বইছে। তবে আপনার মনস্কামনা যদি হয় এমন, একদিন আপনার সন্তান এই দেশ, সভ্যতা, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে উন্নত করবে, মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়াবে তাহলে সেই আশা মিছে।
আপনি লক্ষ্য করেছেন কি, যে সন্তান কিছুদিন পূর্বেও আপনার পা ছুঁয়ে সালাম করত আজ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার পর সে আপনার সাথে কেমন আচরণ করছে? লক্ষ করেছেন কখনও- যে ধর্মের জন্য জীবন বাজি রাখতেও আপনি কুণ্ঠিত নন, যে সংস্কার কাল থেকে কালান্তরে আপনার পরিবার ও সমাজকে সমৃদ্ধি ও সোহাগের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে সেই ধর্ম, সেই সংস্কার-সংস্কৃতির ব্যাপারে আপনার সন্তানের দৃষ্টিভঙ্গী কেমন? যে দেশের মাটির জন্য দলবেঁধে মা-মাটি-মানুষের গান গেয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেন, সহযোদ্ধাদের হাসিমুখে দাফন করে এলেন, সেই দেশের মাটি ও মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আপনার সন্তানের হৃদয়ে প্রভাব ফেলতে পারছে কি? স্মরণ করুণ আপনার স্কুল-কলেজ-পাঠশালার শিক্ষকদের কথা যারা এখনও আপনার হৃদয়ের মণিকোঠায় সম্মানের সাথে পূজিত হন। আর বিবেচনা করুন আজ শিক্ষকদের প্রতি আপনার সন্তানের শ্রদ্ধা-সম্মানের পূর্ণতা বা ঘাটতির কথা। আপনার সন্তান কি তার শিক্ষকের পায়ে হাত দিয়ে সাফল্যের সাথে জীবন নদী পার হবার প্রেরণা কামনা করছে নাকি উচ্ছৃঙ্খলতা আর ঔদ্ধত্বপূর্ণতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষককে গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ করে রাখছে? জুতাপেটা করছে? এসিড নিক্ষেপ করছে?
নিজেকে প্রশ্ন করুন, বিবেকের কাঠগড়ায় বিচার করে দেখুন আপনার প্রাণের চেয়ে প্রিয় সন্তানটির গতিপথ কোন দিকে? আর চোখ-কান বন্ধ করে থাকবেন না। চারপাশটা একবার ভালোভাবে দেখে নিন। ভবিষ্যত কল্পনা করুন। দেখবেন গা শিউরে উঠবে। ভয়ঙ্কর এক অতল গহ্বরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপনার সন্তানকে, আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। আমি শিক্ষার বিরুদ্ধে নই। শুরুতেই বলেছি, শিক্ষা ছাড়া যে কোনো জাতি অন্ধ। জ্ঞানের আলো যতক্ষণ না ছড়াবে ততক্ষণ সে অন্ধকার ঘুঁচবে না, সমাজ ও দেশ আলোকিত হবে না। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, শিক্ষার নাম করে অশিক্ষা-কুশিক্ষা চালু থাকলে সেটা সমাজের অন্ধকারকে আরও ঘনীভূত করবে।
এ কেমন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চলছি আমরা? শিক্ষাব্যবস্থায় যে রাহু প্রবেশ করেছে তার গ্রাস আমাদের ভবিষ্যতকে দিনদিন পঙ্গু করে ফেলছে, অথচ আমরা নিশ্চুপ! শুধু কি নিশ্চুপ, বরং এই ভয়ানক শিক্ষাব্যবস্থার করাল থাবায় ছেলে-মেয়েকে বন্দী করে রেখে আনন্দে আটখানা হচ্ছি, তাদের সুনিশ্চিত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তা করে পুলকিত হচ্ছি। ভাবছি- এই বুঝি জ্ঞানের সূর্য উদিত হয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা অন্ধকারগুলো দূর করে দিবে, পৃথিবী সেই আলোর ঝলকে বিমোহিত হয়ে রবে। কত উদাসীন আমরা, কত অদুরদর্শী আমরা, সেই সাথে কত নির্বোধ আমরা!
আরো লক্ষ্য করুন, একদা সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা আজ ক্লাসে আপনার ছেলেকে কী শেখাচ্ছে, কী পড়াচ্ছে। আপনার সরল ছেলেটির কানে কত জঘন্য বিষ ঢেলে দিচ্ছে, কীভাবে এক শ্রেণির শিক্ষক বিদেশি এজেন্ডা বাস্তাবায়ন করছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে? আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি একদিনের জন্যও আপনি আপনার সন্তানকে একথা বলেন নি যে, বাবা তোমার ক্লাসে কী পড়ানো হয়, কী কথা শোনানো হয় একটু বল তো। জিজ্ঞাসা করেন নি, কারণ হয়তো ভেবেছেন- আমি ওসবের কী বুঝব? খুব বুঝবেন। যদি সন্তান বোঝাতে চায় অবশ্যই বুঝবেন। আর যদি নেহায়েত অবজ্ঞাবশত আপনাকে এড়িয়ে যায় তাহলে অন্তত এটুকু বুঝবেন যে, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের কোনো শিক্ষা তাদেরকে দেওয়া হয় না।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম আপনার বংশে কোনো নাস্তিক নেই, ধর্মবিদ্বেষী নেই। আপনি নিজেও স্রষ্টার প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ ও তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করে থাকেন। আল্লাহ, আল্লাহর রসুল, ধর্মগ্রন্থকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় কষ্টের রোজগার থেকে গরীব-দুঃখীকে দান করেন, জায়গা-জমি বিক্রি করে হজ্ব করে আসেন, সমাজের কল্যাণে অবদান রাখেন। কিন্তু আপনার সন্তান আজ এমন কী শিক্ষা লাভ করল যে, খোদ স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রশ্নেই সে সংশয় বয়ে বেড়াচ্ছে? এক শ্রেণির শিক্ষক শিক্ষা প্রদানের নাম করে আপনার ছেলে বা মেয়ের মনে-মগজে একটু একটু করে ধর্মবিদ্বেষ প্রবেশ করাচ্ছে, ফলে একটি পর্যায়ে পৌঁছে আপনার সন্তান শুধু নাস্তিকই হচ্ছে না, ঘোর ধর্মবিদ্বষী কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে, যার সূত্র ধরে রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ পরিসরে ভয়াবহ সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। যারা ধর্মবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে তাদের দলে হয়তো আপনার বিশ্ববিদল্যায় পড়–য়া বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা সন্তানটিও আছে, কিন্তু আপনি তার কিছুই জানেন না। একবার চিন্তা করুন তো, ধর্মপ্রাণ একটি ছেলেকে মগজ ধোলাই করে ঘোর ধর্মবিদ্বেষী বানাতে একটি শ্রেণি কতটা বদ্ধ পরিকর ভূমিকা পালন করেছে? অথচ আপনি ঘুনাক্ষরেও তা টের পান নি। আজ এই ধর্মবিদ্বেষী ছেলেগুলো আপনার-আমার বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহ, আল্লাহর রসুল ও ধর্মগ্রন্থকে কতটা অরুচিকর ভাষায় গালাগালি করছে, প্রকাশ্যে লিখে বেড়াচ্ছে তার একটু নমুনাও যদি আপনি দেখতেন লজ্জা ও গ্লানিতে মরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকতো না। সন্তান কিন্তু আপনার, তাকে শিক্ষা-প্রদান করে মানুষের মতো মানুষ করার দায়িত্বও ছিল আপনারই, এটা আপনার এবাদতের অংশ ছিল, সেটা করতে আজ আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। একদিন এর জবাবদিহি আপনাকেও করতে হবে।
আপনি রাত-দিন পবিত্র কোর’আনকে ভালোবেসে চুমু খাচ্ছেন, আর আপনারই সন্তান আল কোর’আনকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে, কী দাম রইল আপনার ভালোবাসার? যে নবীর নাম শুনলে আপনার চোখের কোন ভিজে যায় সেই নবীর শত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় নিয়ে আপনারই সন্তান যখন অকথ্য-অশ্লীল ভাষায় লেখালেখি করে, তখন আপনার ওই নবীপ্রেমের কোনোই মূল্য থাকে না। আপনার সন্তান তো এমন ছিল না? কে তাকে এমন বানালো? ভাবুন। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করুন। আর এড়িয়ে চলার উপায় নেই, বিষয়টি এড়িয়ে যাবার মতো নয়। জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আপনার সিদ্ধান্তের উপর। এখনই যদি না ভাবেন তাহলে অপেক্ষা করুন এর চেয়েও ভয়ংকর কোনো পরিণতির জন্য। কবরে গিয়েও শান্তি পাবেন না। হাশরের ময়দানে সর্বশক্তিমান ও চূড়ান্ত বিচারক আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে শুধু এই নিস্পৃহ-নির্জীব থাকার জন্য। আল্লাহ আপনাদের বোধোদয় ঘটিয়ে জাতিকে রক্ষা করুন।

রাশেদুল হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *