Connect with us

জাতীয়

রাজধানীতে যে দুর্ধর্ষ ব্যাংক লুট নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল

Published

on

২০০৮ সালের ৫ই জানুয়ারি, আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে বাংলাদেশের ঢাকায় এক দুর্ধর্ষ ব্যাংক লুটের ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ঢাকার অন্যতম বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের শুক্রাবাদ শাখায়। সেই অভিনব কায়দায় চুরির ঘটনা যে কোন লোমহর্ষক থ্রিলার গল্পকেও হার মানাবে।

খুবই পেশাদার চোরের কাজ-

সে সময় প্রথম আলোর ক্রাইম বিটের প্রধান ছিলেন কামরুল হাসান। ৬ই জানুয়ারি রোববার দুপুরের দিকে তিনি খবর পান শুক্রাবাদে ব্র্যাক ব্যাংকের বাইরে বেশ হট্টগোল হচ্ছে। ব্যাংকটি ছিল হোটেল নিদমহল ভবনের দোতলায়। ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি দেখেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের কার্যালয়ের দরজা জানালা বন্ধ করে আছেন এবং বাইরে গ্রাহকরা হইচই করছেন।

গ্রাহকদের থেকে তিনি জানতে পারেন যে ব্যাংকের লকার থেকে মূল্যবান জিনিষপত্র চুরি গিয়েছে এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের কেউ গ্রাহকদের এ বিষয়ে কোন তথ্য দিচ্ছে না। “কিছুক্ষণ পর পর দেখা যায় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বেরিয়ে আসছেন, তাদের কাছে কিছু জানতে চাইলেই তারা পরিচয় গোপন করছিলেন। তাদের চেহারায় ভয়, উদ্বেগ ছিল।” বলেন মি. হাসান।

তবে ব্যাংকের ওই শাখার তৎকালীন ম্যানেজার গ্রাহকদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কেউই সাংবাদিকদের তাৎক্ষণিকভাবে কোন তথ্য জানায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লকারে চুরির বিষয়টি নিশ্চিত করে। মি. হাসান পুলিশের সঙ্গে ব্যাংকের লকার রুমে যান।

ব্যাংকের লকার রুমের ছাদে বিশাল গর্ত-

সেখানে তিনি দেখতে পান – ওই লকার রুমের ছাদে তিন ফুট বাই তিন ফুট মাপের এক বিশাল গর্ত কাটা এবং তার ওপর বরাবর দেখা যাচ্ছে হোটেলটির একটি কক্ষ। চুরি হয়েছিল হোটেলের সেই রুমটি থেকেই।

“লকার রুমটা বেশ ছোট। স্টিলের লকারগুলো দেয়ালের সাথে লাগানো ছিল, মাঝখানের অংশটা ফাঁকা। সেই মাঝ বরাবর ছাদে তারা বড় করে কেটেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল খুবই পেশাদার চোরের কাজ এটা।”

পরে তিন তলায় হোটেলে উঠে জানতে পারেন, গর্তটি ছিল ১০৩ নম্বর কক্ষে খাটের নীচে। এ কারণে হোটেল কর্মীরাও বিষয়টি আঁচ করতে পারেননি। তারা প্রতিদিন একটু একটু করে কাটতো এবং কাটা টুকরোগুলো বাইরে নিয়ে ফেলে দিতো যেন কেউ টের না পায়। মেঝেটাও কার্পেট দিয়ে ঢাকা ছিল।-সে সময় সাংবাদিকদের এমন তথ্য জানিয়েছিল পুলিশ।

পরে পরিকল্পনা-মাফিক শনিবার ব্যাংকের ছুটির দিন লকারের কক্ষে লুটপাট চালিয়ে রোববার ভোরে হোটেল ছেড়ে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। শনিবার রাতে ঠিক কয়টার সময় চুরির ঘটনাটি ঘটে তা জানা যায়নি।

ব্যাংক যেভাবে টের পেল-

ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিষয়টি টের পান রোববার সকালে। বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রোববার সকালে রেজোয়ানা খুকু মনি নামে একজন গ্রাহক ব্যাংকে এসে তার লকারটি ব্যবহার করতে চান। তখন এক ব্যাংক কর্মকর্তা আগে লকার কক্ষে ঢোকেন তার পেছনেই ছিলেন ওই গ্রাহক।

ব্যাংক কর্মকর্তা ভেতরে ঢুকেই প্রথমবারের মতো ডাকাতির বিষয়টি আবিষ্কার করেন এবং সাথে সাথে গ্রাহককে ঢুকতে না দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। তৎক্ষণাৎ বিষয়টি ব্যাংক ম্যানেজারকে জানানো হলে, লকার কক্ষে গ্রাহকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

বিষয়টি চেপে যাওয়ায় ওই গ্রাহকের সন্দেহ হয় এবং তিনি হইচই শুরু করেন যে কেন তাকে তার লকার দেখতে হবে না। “এখানে কি চুরি হয়েছে?” এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর তাকে কেউ দেয়নি।

বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরকে দেয়া সাক্ষাতকারে গ্রাহক রেজোয়ানা খুকু মনি জানিয়েছিলেন, “রোববার সকালে ব্যাংকে আসার পর কাস্টমার সার্ভিস অফিসার চৌধুরী হাসান জামাল তাকে বলেন, নতুন লকারের কাজ চলছে। আপাতত সেখানে যাওয়া যাবে না। উনারা সেদিন পুরো বিষয়টি গোপন করে গেছেন। এজন্য আমার সন্দেহ, ব্যাংকের লোকজনই এই এর সঙ্গে জড়িত।”

ওই লকারে প্রায় ৮৫ ভরি অলঙ্কার ছিল বলে জানান তিনি। আরেক গ্রাহক আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া দাবি করেছিলেন তার লকারে, ১০০ ভরিরও বেশি স্বর্ণালঙ্কার ছিল। ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী জানান, তার লকারে একটি সোনার রোলেক্স ঘড়িসহ প্রায় সাড়ে তিনশ ভরি অলঙ্কার ছিল। লকার গ্রাহক মামুন আলী অভিযোগ করেন, ব্যাংকে তিনি ফোন করলে তাকে জানানো হয় চুরির খবর সত্যি নয়।

কেউ কোন তথ্য দিচ্ছিলেন না-

সে সময় ভোরের কাগজের ব্যাংক বিটের প্রতিবেদক ছিলেন সুজয় মহাজন। তিনি ঘটনাস্থলে তার কিছু অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন। তিনি জানান, গ্রাহকদের মূল অভিযোগ ছিল এটাই যে কেউ তাদের কোন পরিষ্কার তথ্য দিচ্ছিলেন না।

“গ্রাহকরা খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারা কোথায় প্রতিকার পাবেন, আইনগত সুরক্ষা পাবেন, সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ব্যাংকাররাও কিছু বলছিলেন না।” তিনি বলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে অন্যান্য গ্রাহকরা ব্যাংকটিতে ভিড় করতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় ব্যাংকের ওই শাখায় সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে তৎকালীন ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তা আবেদুর রহমান জানিয়েছিলেন, “পুলিশের নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা বিষয়টি গ্রাহকদের জানাননি। পুলিশ বলেছে, তদন্তের স্বার্থে বুধবারের আগে লকার রুমে গ্রাহকদের যাওয়া চলবে না।

চুরির পরিমাণ কতো ছিল-

৬ই জানুয়ারী রাতেই ব্র্যাক ব্যাংকের ধানমণ্ডি শাখার ম্যানেজার মনিরুল ইসলাম মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। তখনকার গণমাধ্যমের খবরে বলা হয় যে, সংঘবদ্ধ চোর ভুয়া নাম, ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংকের ঠিক উপরের চারটি রুম ভাড়া নেয়৷

সেখানেই তারা একমাস ধরে অবস্থান করে চুরির নীল নকশা করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সামনে ব্যাংক কর্মকর্তা জানান ডাকাতরা ব্যাংকের ১৩২টির মধ্যে ৭৫টি লকার ভেঙেছে। এর মধ্যে ৬০টি লকারে ভোক্তাদের মালামাল ছিল।

নিয়ম অনুযায়ী, গ্রাহকরা লকারে কি রাখবেন তা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানাতে বাধ্য নন। এ কারণে ঠিক কত টাকার মালামাল খোয়া গেছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। কোনও কোনও ভাঙা লকারে পাসপোর্ট, জমির দলিল বা সঞ্চয়পত্র থাকলেও ডাকাতরা সেগুলো নেয়নি।

মূলত অলঙ্কারের মতো দামি জিনিস সরানোই তাদের লক্ষ্য ছিল। কামরুল হাসান জানান, চুরির ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে ছুটির দিনে চুরি করে পালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। যেন খবর ছড়ানোর আগেই তারা গা ঢাকা দিতে পারে।

এক মাস হোটেলে অবস্থান, অতঃপর..

মামলা দায়ের পর পরই পুলিশ হোটেল নিদমহলের চার কর্মীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। হোটেল নিদমহলের তৎকালীন রিসেপশনিস্ট ওয়াসিম চৌধুরী সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরকে জানিয়েছিলেন, ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে সালাম, আবদুল ও জালাল নামের তিন ব্যক্তি পহেলা ডিসেম্বর অর্থাৎ চুরির এক মাস আগে হোটেলের চার তলার একটি কক্ষ ভাড়া নেয়।

নিবন্ধন বইয়ে তারা চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি ঠিকানা ব্যবহার করে। তাদের বয়স ৪০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরদিন অর্থাৎ ২রা ডিসেম্বর তারা তিনতলার ১০৩ ও ১০৪ নম্বর কক্ষে চলে আসে।

ভেতর দিয়ে চলাচলের জন্য পাশাপাশি ওই দুটি কক্ষের মাঝে একটি দরজা ছিল। একমাসের বেশি সময় তারা ওই দুটি কক্ষেই অবস্থান করে। এরপর রোববার ভোরে ওই তিনজন হোটেল ছেড়ে চলে যায়।

ব্যবসার প্রয়োজনে ও সৌদি এয়ারলাইন্সের টিকেটের জন্য এতো দীর্ঘ সময় থাকার কথা তারা হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। মি. ওয়াসিম জানিয়েছিলেন, “তারা বিভিন্ন অজুহাতে রুম বয়দের খাটের নিচের অংশ পরিষ্কার করতে বাধা দিতেন।”

পরবর্তীতে কী হয়?

ওই ঘটনার পরে ব্যাংকের শাখাটি তুলে দেয়া হলেও নিদমহল হোটেলটি এখনও আছে। জানা যায়, ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সে সময় বেশ কঠোর অবস্থানে যায় এবং তদন্ত করে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

অন্যদিকে ঘটনার পরপর গোয়েন্দা পুলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অন্তত ২৩ জনকে গ্রেফতার করে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। সেইসাথে প্রায় আড়াইশ ভরি স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধারের দাবিও করে পুলিশ। ওই বছরে মার্চে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে চুরির মূল হোতা সন্দেহে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তৎকালীন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক একেএম নাসিরুল্লাহ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, “প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে ডাকাতির পরিকল্পনা এবং তাতে অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করে।”

“তারা কয়েকজন মিলে হোটেলের তৃতীয় তলা প্রায় সবকয়টি কক্ষ ভাড়া নেয়। সুবিধাজনক সময়ে মেঝে কেটে রশি বেয়ে লকার কক্ষে ঢোকে। মালামাল লুট করে রশি বেয়ে আবার হোটেলের কক্ষে ওঠে। ওই কক্ষে বসেই লুণ্ঠিত মালামাল ১৯ ভাগ করা হয়।” তিনি বলেন।

আস্থার ঘাটতি-

ঢাকায় ১৫ বছরের আগের এই ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের জন্ম দিয়েছিল। বিশেষ করে ব্যাংকের লকারের নিরাপত্তা নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে বড় ধরণের আস্থার ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংকের গ্রাহকরা ভয়ে, আতঙ্কে লকার থেকে তাদের জিনিষপত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেন।

কামরুল হাসান জানান “এটা আমার কেরিয়ারের খুবই এক্সক্লুসিভ ঘটনা ছিল। ছাদ কেটে ব্যাংকে চুরির কথা মানুষ ভাবতে পারেনি। মানুষ বাসায় নিরাপদ না বলেই ব্যাংকের লকার ভাড়া করে। সেখানেও চুরির ঘটনায় তারা একরকম অসহায় হয়ে পড়েন।?”

এদিকে যারা তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়েছেন বলে দাবি করেন তাদের বেশিরভাগই কিছু ফেরত পাননি বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ জানান। আবার এমনও অনেকে আছেন যারা মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছে দাবি করলেও সেগুলো ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করেননি।

এ নিয়ে সুজয় মহাজন জানান, “লকার ভাড়া করলে সেটার ভেতরে কী থাকে তার কোন তথ্য ব্যাংককে দেয়ার নিয়ম নেই। একারণে লকার থেকে কিছু খোয়া গেলে সেটা দাবি করার মতো আইনি সুরক্ষা ছিল না। আবার অনেকে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ভয়ে তাদের জিনিস দাবিই করতে আসেনি।”

সব মিলিয়ে সে সময় লকারে মালামাল রাখা সংক্রান্ত নীতিমালা বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে। ওই ঘটনার বিষয়ে জানতে ব্র‍্যাক ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোন সাড়া মেলেনি।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *