Connect with us

বিশেষ নিবন্ধ

জনপ্রতিনিধিতে দেশ গিজগিজ করছে কিন্তু জনসেবার মানসিকতা নেই কেন? – মো. রিয়াদুল হাসান

Published

on

Untitled-7শ্রদ্ধেয় প্রাবন্ধিক আবুল মকসুদ প্রথম আলোয় প্রকাশিত “বাঙালি প্রতিভাবান- সেবাধর্ম ছাড়া সব জানে” শিরোনামের লেখাটিতে বাঙালির চারিত্রিক বিপর্যয়ের একটি দুঃখজনক রূপ তুলে ধরেছেন। হতাশার সুরে তিনি বলেছেন, সেই সময়ও নেই, সেসব মানুষও নেই। উদাহরণস্বরূপ বন্যা দুর্গত মানুষের পাশে সে সময়ের বাঙালি কীভাবে সেবার মনোভাব নিয়ে ত্রাণ বিতরণে ঝাঁপিয়ে পড়তো তা তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর বক্তব্য থেকে বিবৃত করেছেন।
মওলানা ভাসানী লিখেছেন, “বাংলা ১৩২৯ সালে উত্তরবঙ্গে এক অভাবনীয় বন্যা হইয়াছিল। অতিবৃষ্টির দরুন সান্তাহার জংশনে কোমর-সমান পানি হইয়া গিয়াছিল। রিলিফের কাজে আমরা কয়েকজন সেখানে পৌঁছিয়া কীভাবে কী করা যায় ভাবিতেছিলাম। এদিকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন আসিয়া হাজির, সঙ্গে ছিলেন বাংলার বিপ্লবী সন্তান সুভাস বসু। দেশবন্ধুর হাতে দশ সের চিঁড়ার একটি পোটলা ছিল। উহা লইয়া তিনি যখন পানিতে নামিয়া পড়িলেন তখন আমরা কেহ দাঁড়াইয়া থাকিতে পারি নাই। এই ঘটনা আমার রাজনৈতিক জীবনে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।’
উত্তরবঙ্গের বিশের দশকের বন্যায় ত্রাণ তৎপরতায় শুধু চিত্তরঞ্জন দাস বা সুভাসচন্দ্র বসু নন, রাত-দিন কাজ করেছেন আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো বিজ্ঞানী, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবি। ১৯৭৬-এর নভেম্বরে মৃত্যুর দুই মাস আগেও মওলানা ভাসানী যেখানে বন্যার কথা শুনেছেন সেখানেই ছুটে গেছেন দুর্গত ব্যক্তিদের পাশে। শুধু তিনি নন, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে প্রধান-অপ্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রায় সবাই বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দুর্গতের সাহায্যে এগিয়ে গেছেন। রাজনীতিকে তারা শুধু নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন নি।
অথচ এখন বন্যাদুর্গত এলাকায় কষ্ট করে যাওয়া তো দূরের কথা, বর্তমানের জননেতারা একটি প্রেস রিলিজেও তাদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করা হয় না। মাস খানেক যাবৎ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা বন্যায় প্লাবিত। হাজার নয়, লাখও নয়, কয়েক কোটি মানুষ পানিবন্দী। দুর্বিষহ তাদের জীবন। শুধু মানুষ নয়, ভাষাহীন গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির অবস্থা শোচনীয়। উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় বন্যার খবর গুরুত্ব পাচ্ছে না। কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে বন্যা উপদ্রুত এলাকার বিপন্ন মানুষের কিছু কিছু দুরবস্থার দৃশ্য প্রচারিত হচ্ছে। ত্রাণ তৎপরতার কথা কোনো মিডিয়াতে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আজ জনপ্রতিনিধি প্রচুর। সারা দেশ গিজগিজ করছে জনপ্রতিনিধিতে। তবে যিনি যে এলাকার মানুষের দ্বারাই নির্বাচিত হোন না কেন, রাজধানীর ধানমন্ডি, উত্তরা, গুলশান, বনানীর ফ্ল্যাটবাড়িতে সপরিবারে বাস করতেই তাঁরা পছন্দ করেন। তারা কোনো কোনোরকমে টাকা ঢেলে ও ক্যাডারদের পূর্ণ সহযোগিতায় একবার খেয়া পার হতে পারলে ভোটারদের দেখান কলা। কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক- তারা কেউই নেই দুর্গতদের পাশে। কেউ যদিও বা আসেন টিভি ক্যামেরা না থাকলে ত্রাণ বিতরণ করেন না।
এই আত্মিক অধঃপতনের কারণ কী তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে এবং এই কারণকে দূর করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষের জন্য কাজ করতে হলে প্রথমে নিঃস্বার্থ হতে হবে। সেকালের মানুষেরা জনহিতকর ও সেবামূলক কাজের জন্য যেভাবে এগিয়ে আসতেন তার পেছনে ছিল একটি শিক্ষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, আত্মমর্যাদাবোধ ও জনসম্পৃক্তি। “আমি জনগণের জন্য রাজনীতি করি, নিজের পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য রাজনীতি করি না। তাই আমাকে জনগণের দুঃখ-কষ্টে তাদের পাশে থাকতে হবে- এটা আমার দায়বদ্ধতা”- এই বোধ তাদেরকে তাড়িত করত। রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ধনী ব্যক্তিরা মানুষের কল্যাণের জন্য দুই হাতে নিজের সম্পত্তি বিলিয়ে দিতেন।
নদীর উৎসমুখে বাঁধ দিলে ভাটির দেশ মরুভূমি হবে এটা স্বাভাবিক। তেমনি জাতির চরিত্রে জনসেবার প্রেরণা কেন হারিয়ে গেল তা বুঝতে হলে এই প্রেরণার উৎস সন্ধান করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, নিঃস্বার্থ হওয়ার প্রেরণা, দুর্গত মানুষকে সেবা ও দরিদ্রকে দান করার প্রেরণা মানুষের চরিত্রে ঠাঁই পায় ধর্মীয় শিক্ষা থেকে। যুগ যুগান্তরের ধর্মীয় সভ্যতার চর্চা মানুষের চরিত্রে এই সেবা ও ত্যাগের মানসিকতাকে রোপণ করে দিয়েছে। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ মানবকল্যাণে নিজের সম্পদ থেকে দান করার কথা শত শতবার ঘুরে ফিরে এসেছে। যে ব্যক্তি সম্পদ দান করবে না সে মো’মেনই হতে পারবে না, সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে এমন ঘোষণা বহুবার কোর’আনে এসেছে। অন্যান্য ধর্মেও এই কথাগুলো আছে। বর্তমানে আমরা সেই ধর্মীয় মূল্যবোধকে সেকেলে মনে করে যখন অবঞ্ছিত করে রেখেছি, তখন আমাদের চরিত্র থেকে সেবা ও দান করার জন্য যে আত্মিক শক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি দরকার তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন নীতিবান মানুষকে সেকেলে বলেই অবজ্ঞা করা হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি ও সার্বিক জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে, যা আমাদেরকে ক্রমশ আত্মাহীন জড়পূজারী আত্মকেন্দ্রিক বানিয়ে ফেলছে। কেননা শৈশবেই আমরা শিখছি, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে।’ আমরা বড়লোক হতে চাই, বড় মানুষ হতে চাই না। সফল ব্যক্তি বলতে ধনী ব্যক্তিকেই বুঝি, জনসেবককে বুঝি না। মিথ্যার রাজনীতি আমাদেরকে ওয়াদা খেলাফকারী, প্রতারক বানিয়ে ফেলছে। পশ্চিমা সংস্কৃতির গোলার আঘাত আমাদের চরিত্রের দুর্গকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। মাদক যেমন আমাদেরকে বুঁদ করে দেয় তেমনি স্বার্থচিন্তা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, অশ্লীলতা এ জাতির প্রতিটি মানুষকে বুঁদ করে রেখেছে। তারা নিজেদের অতীত সম্পর্কে নিরুৎসুক।
আমরা ভুলে গেছি হাজী মোহাম্মদ মুহসিন, রনদা প্রসাদ সাহা, ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চান মিয়া সাহেব), নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, নওয়াব সলিমুল্লাহ প্রমুখ ব্যক্তিদের নিঃস্বার্থ দানের বদৌলতেই গড়ে উঠেছে অবিভক্ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠগুলো। তাদের অবিশ্বাস্য দানশীলতার কথা আজ আর কেউ বলে না, তাদের অবদান ও কীর্তি এ নবপ্রজন্মকে শেখানোও হয় না। হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর মায়ের নানা ছিলেন ধনবাড়ির জমিদার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অর্থ যোগান দিতে নিজের জমিদারি বন্ধক রেখেছিলেন। এমামুয্যামনের দাদা ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের ব্যয় যোগাতে পুরো জমিদারিই বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বর্তমানে আবার এমামুয্যামান হেযবুত তওহীদ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছেন সমগ্র দুনিয়ায় সত্য, ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার বিরাট লক্ষ্য নিয়ে। এই কাজে তিনিও তার যাবতীয় সম্পদ উৎসর্গ করে গেছেন, তাঁর অনুসারীরাও তাদের নিজেদের জমি-জমা, বাড়ি, ঘর, খেত-খামার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে মানবতার কল্যাণে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমার বক্তব্যের সার কথা হলো, দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করতে হলে তার পেছনে একটি আদর্শ থাকতে হয়। আদর্শহীন মানুষ কোনোদিন স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে পারে না। সেই আদর্শ হতে পারে দেশপ্রেম, হতে পারে ধর্ম, এমন কি হতে পারে দুটোই। আজকে আমরা যে ব্যবস্থা আমাদের জীবনে ধারণ করেছি তাতে স্বার্থই একমাত্র আদর্শ। তাই এ জাতির মধ্যে যারা হাসপাতাল, স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে তারা নিজের নামের প্রচারের জন্য এবং ব্যবসার উদ্দেশ্যেই করে। যারা সেবামূলক পেশায় আছেন যেমন চিকিৎসক, তারা রোগীদেরকে শোষণ করেন। মহান পেশার শিক্ষকরা আজ হীনস্বার্থে ছাত্রদেরকে মাস্তান হিসাবে ব্যবহার করেন। ফলে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত যে ছাত্ররা পূর্বে সম্ভ্রমে শিক্ষকের চোখের দিকে তাকাতো না, তারা এখন শিক্ষকদেরকে পেটায়।
ধর্মগুলোও হয়ে গেছে ব্যবসায়িক পণ্য। ধর্মগুরুরা মসজিদ মন্দিরে দানের উপদেশ দেন, কারণ সেই দান তাদের ভোগে লাগে। তারা বলেন না যে, বন্যা দুর্গতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করা এবাদত, বলেন না যে রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করা ধর্মের কাজ। এজন্যই নজরুল লিখেছিলেন: হায়রে ভজনালয়/ তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।
আবুল মকসুদ সাহেবের প্রতি আমার প্রশ্ন হচ্ছে, নিমগাছ থেকে আমরা আমের আশা করছি কেন? আমরা লাগিয়েছি স্বার্থের গাছ আর আশা করছি দান ও সেবার সুমিষ্ট ফল? পশ্চিমাদের যে ধর্মহীন, নৈতিক শিক্ষাহীন, আত্মাহীন, ভোগবাদী, স্বার্থবাদী সংস্কৃতি ও ব্যবস্থাগুলো আমরা স্বযতেœ লালন-পালন করছি সেই সংস্কৃতি আমাদেরকে গ্রাস করে ফেলেছে। এখন হাহাকার করে কী লাভ?
ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে একটি জ অর্থাৎ জবষরমরড়হ বাদ দিলে আরেকটি জ অর্থাৎ জধংপধষরঃু (বদমায়েশি) এসে জায়গা করে নেবে। আজকের অবস্থার কারণ যারা খুঁজছেন তারা এই জ্ঞানতাপসের এই উক্তিতেই তাদের প্রশ্নের সমাধান পেয়ে যাবেন।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *