Connect with us

বিশেষ নিবন্ধ

ধর্মোন্মাদনার জন্মকথা!

Published

on

রিয়াদুল হাসান:
রসুলাল্লাহ (স.) ছিলেন মুসলিমদের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি যখন রাষ্ট্রশক্তি অর্জন করেছেন তখন তিনি রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যায়ের ধারকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। সামরিক পদক্ষেপ কোনো ব্যক্তিবিশেষ নিতে পারে না, এটা রাষ্ট্রের কাজ। ব্যক্তি বা সংগঠন পর্যায়ে সশস্ত্র পন্থা গ্রহণ সর্বযুগে সর্বকালে সন্ত্রাসী কর্মকা- বলে পরিগণিত হয়। রসুলাল্লাহর (স.) পরে যারা এ জাতির শাসক হয়েছেন তারা ধর্মীয় বিধি-বিধান কমবেশি মেনেই মুসলিম বিশ্বের নানা অংশে শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। তারা যখন মানুষকে শত্রুর মোকাবেলা করণার্থে আহ্বান জানাতেন তখন জনগণ ইসলামের শিক্ষা মোতাবেক নেতার আনুগত্য করত, সেই আহ্বানে সাড়া দিত। ধর্মব্যবসায়ী আলেম ওলামা শ্রেণির জন্ম হয়েছে রসুলাল্লাহর (স.) ইন্তেকালের কয়েক শ বছর পরে। তারাও রাষ্ট্রের শাসকদের পরামর্শক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণ থাকায় তাদের হাতে ক্ষমতাও ছিল যথেষ্ট, ধর্মনেতা হিসাবে জনগণের উপর যথেষ্ট প্রভাবও ছিল তাদের। কিন্তু ইতিহাসের একটি বাঁকে এসে মুসলিম জনগোষ্ঠী যখন ব্রিটিশসহ ইউরোপের বিভিন্ন জাতির গোলামে পরিণত হলো তখনও এই আলেম ওলামারা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মের কর্তৃপক্ষই থেকে গেছেন আর আগে যেমন মানুষ যেভাবে তাদের ডাকে সাড়া দিত, অন্য জাতির গোলাম হয়ে যাওয়ার পরও সেই প্রবণতা রয়ে গেল। জাতির মধ্যে এই বোধ জাগ্রত হলো না যে, এই আলেমরা এখন আর তাদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ নয়। সুতরাং তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে কোনো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো ন্যায্যতা আর ইসলামের নীতি মোতাবেক নেই, করলে সেটা সন্ত্রাস হবে। আগে জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে। সেই মুরোদ বা সামর্থ্য না থাকায় তাদের মধ্যকার ফতোয়াবাজ কাঠমোল্লারা দুর্বল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তাদের এই ক্ষমতাকে কাজে লাগানো শুরু করল। আর আলেম শ্রেণি নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করার যে সুখ সেই সুখ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তারা রাজত্ব হারালেও যাত্রাপালার রাজা সেজে নেতৃত্বের অভিনয় চালিয়ে যেতে লাগলেন। ভাবখানা হচ্ছে এমন যে, রাজদ- নেই তো কী হয়েছে, ফতোয়া দিলে মানুষতো ঠিকই মানছে। সুতরাং ফতোয়াবাজি যতদিন পারা যায় করতে থাকি। তারা এই মহাসত্যটি জাতির সামনে সম্যকভাবে তুলে ধরলেন না। তারা আজ হিন্দুর বিরুদ্ধে, কাল কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে, পরশু অমুক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নাস্তিকতা বা কাফের-মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে গলা ফাটিয়ে ওয়াজ করে একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করে দেন। ফলে কোনো সংখ্যালঘু দুর্বল শ্রেণি ধর্মোন্মাদ তওহীদী জনতার রোষাণলে ভস্মীভূত হয়ে যায়। বিগত সময়ে কত মানুষকে তারা হত্যা করেছে, কত মানুষের বাড়িঘর তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এটাই হচ্ছে ফিতনা। আমাদের দেশে স্বাধীনতার ৪৬ বছরে না হলেও অর্ধশত ঘটনা ঘটেছে যেখানে মাইকে জনগণকে ডেকে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং জনগণ মার মার কাট কাট করে ছুটে এসে জ্বালাও পোড়াও, হত্যাকা-, সম্প্রদায় বিশেষকে উচ্ছেদসহ নৃশংস কর্মকা- ঘটিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এই ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ কাজটি বার বার করেছেন এবং এর যেন কোনো বিরতি নেই। তারা যেটা করছেন এটা আল্লাহর রসুল কখনও করেন নি, তাঁর সাহাবিরাও কখনও করেন নি। কিন্তু জনগণ তো আর সেটা জানে না, জনগণ আলেম সাহেব যা বলেন সেটাই ইসলাম মনে করে অন্ধবিশ্বাস নিয়ে পালন করে। বিশেষ করে ধর্মীয় নৃশংসতায় যখন কারো বাড়িঘরে হামলা করে লুটপাট করা, নিষ্ঠুরভাবে মানুষ মেরে বীরত্ব দেখানো, নারীদের ধর্ষণ করার মওকা পাওয়া যায় তখন তাতে অংশ নেওয়ার মত বর্বর স্বার্থান্বেষী মানুষের কোনো অভাব এ জাতির মধ্যে হয় নি। যখন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে তখন তা চলে যায় স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতে। তারা এটা নিয়ে নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতে ওঠে। প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা তো বহু আগেই হারিয়ে গেছে। ধর্ম হয়ে গেছে স্বার্থান্বেষী শ্রেণির হাতিয়ার আর ধর্মবিশ্বাসী জনগণ হয়ে গেছে তাদের অন্ধ আনুগত্যকারী মাত্র যা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।
এই ফেতনা সৃষ্টিকারীদের পরিণতি কী হবে?
আল্লাহর রসুল এ কথাটিও সুস্পষ্টভাবে বলে গেছেন যে তাঁর উম্মাহর মধ্যে কারা ফেতনা সৃষ্টি করবে। তিনি বলেছেন, এমন সময় আসবে যখন- (১) ইসলাম শুধু নাম থাকবে, (২) কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, (৩) মসজিদসমূহ জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না, (৪) আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব, (৫) তাদের তৈরি ফেতনা তাদের ওপর পতিত হবে। [আলী (রা.) থেকে বায়হাকী, মেশকাত]
ধর্ম থেকে ফায়দা হাসিলকারীদের হৃদয় কেমন হবে সেটাও রসুলাল্লাহ সুস্পষ্টভাষায় বলে গেছেন। তিনি বলেন, শেষ যামানায় কিছু লোকের উদ্ভব হবে যারা পার্থিব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ধর্মকে প্রতারণার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করবে। তারা জনগণের সামনে ভেড়ার পশমের মত কোমল পোশাক পরবে। তাদের মুখের ভাষা হবে চিনির চেয়ে মিষ্টি; কিন্তু তাদের হৃদয় হবে নেকড়ে বাঘের মত হিংস্র। আল্লাহ তা’আলা তাদের বলবেন: তোমরা কি আমার বিষয়ে ধোঁকায় পড়ে আছ, নাকি আমার প্রতি ধৃষ্টতা দেখাচ্ছ? আমার শপথ! আমি তাদের উপর তাদের মধ্য হতেই এমন বিপর্যয় আপতিত করব, যা তাদের খুবই সহনশীল ব্যক্তিদের পর্যন্ত হতবুদ্ধি ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ছাড়বে (আবু হোরায়রাহ রা. থেকে তিরমিজি)।
ফেতনা অর্থাৎ দাঙ্গা হাঙ্গামা এমন একটি ভয়ংকর বিষয় যা হাজার হাজার যুদ্ধের জন্ম দেয়। আমাদের মুক্ত মন নিয়ে চিন্তা করতে হবে যে কোনো আলেমরা মানবসমাজে ফেতনা সৃষ্টি করছে। এরা হচ্ছে সেই আলেম দাবিদার গোষ্ঠী যারা ধর্মকে তাদের ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করছে। ধর্ম এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আর আল্লাহ হলেন সত্যের চূড়ান্ত রূপ। মানুষ যখন তাঁর থেকে আগত সত্যকে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামগ্রিক জীবনে ধারণ করে তখন সমাজ শান্তিময় হয়, ন্যায়বিচারে পূর্ণ হয়। তিনি স্বয়ং ধর্মের মাধ্যমে মানব সমাজে মূর্ত হন, প্রকাশিত হন। যারা ধর্মের শিক্ষা দিয়ে, ধর্মের কাজ করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করে, ধর্মকে জীবিকার হাতিয়ারে পরিণত করে তারা সমাজে প্রচলিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যভাষণের শক্তি ও যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। সে যখন একজন অসাধু ব্যক্তির থেকে সুবিধা গ্রহণ করে তখন তার মস্তক সেই টাকার কাছে বিকিয়ে যায়, সেই সাথে ধর্মও বিক্রি হয়ে যায়। সে ঐ অসাধু ব্যক্তির অপকর্মের প্রতিবাদ তো করতেই পারে না, উল্টো কীভাবে অসাধু ব্যক্তির স্বার্থরক্ষায় ধর্মের ফতোয়া ব্যবহার করা যায় সেই ফিকির করতে থাকে। এভাবে ধর্মের নামে অধর্ম সমাজে প্রচলিত হয়ে যায়। যে ধর্ম এসেছিল মানুষের কল্যাণের জন্য, সেই ধর্মের নামেই মানুষের অকল্যাণ করা হয়। যে ধর্ম এসেছিল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সেই ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হয়।
ইসলামকে পণ্য বানিয়ে আল্লাহ ও রসুলের যে অবমাননা এই জনগোষ্ঠীর আলেম নামধারী ধর্মব্যবসায়ীরা করেছেন শত শত বছর ধরে, সেটা আর কেউ করতে পারে নি। তারা মানুষের ধর্মানুভূতিকে উত্তেজিত করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষিপ্ত করে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে খুব পটু। বস্তুত তাদের এছাড়া আর কোনো ক্ষমতাও নেই। তাদের ওয়াজের কোনো ইতিবাচক প্রভাব সমাজে নেই। শীতকাল আসলে তারা ওয়াজ করবেন, মানুষ শুনবে, তাদের আহ্বানে উদ্বেলিত হয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেবে পরকালীন মুক্তির আশায় এটা একটি রেওয়াজ হয়ে গেছে। তাদের ওয়াজে কোনো সুদখোর মহাজন সুদ ছেড়ে দেয় না, কোনো মাদকব্যবসায়ী ব্যবসা ছেড়ে দেয় না, ব্যভিচারী ভালো হয়ে যায় না। অর্থাৎ ইসলাম যেভাবে বর্বর আরবদের চরিত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সৃষ্টি করেছিল এই ওয়াজশিল্পীরা সেটা করতে পারছেন না, তারা সমাজের অন্যায় অবিচার দূর করতে পুরোপুরি অক্ষম। এখন তারা এটুকুই পারেন, একটু গুজব তুলে দিয়ে সাময়িক একটি হুজুগ সৃষ্টি করে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ধর্মানুভূতিকে উসকে দিয়ে একটি উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে। সে উত্তেজনারও মেয়াদ খুব সীমিত। এই জাহেলিয়াতের, মূর্খামির অবসান তখনই হবে যখন ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষের সামনে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, আদর্শ সুস্পষ্ট হবে। তারা জানতে পারবে যে দাঙ্গা ও জেহাদ, যুদ্ধ কখনও এক নয়। যুদ্ধের নীতি থাকে দাঙ্গায় কোনো নীতি থাকে না। আল্লাহর রসুল যতগুলো যুদ্ধ করেছেন সবগুলোতে তাঁর সৈন্যবাহিনী থেকে প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনী ছিল কয়েকগুণ বড়। দাঙ্গায় হয় এর উল্টো। দুর্বল একটি গোষ্ঠীর উপর সংখ্যাধিক্যের শক্তিতে সংগঠিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া হয়। মানুষের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়, হত্যাকা- হলে সেটাকে গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, উসকানিদাতা ধর্মব্যবসায়ীরা লেবাসের আড়াল নিয়ে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ সত্ত্বেও আইনের হাত থেকে পার পেয়ে যান। রাজনৈতিক নেতারাও এই ভ- ধর্মনেতাদের সমীহ করে চলেন কেবলমাত্র ভোটের জন্য। এভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মের নামে এই অন্যায় আমাদের সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তথাপি চিন্তাহীনতা, যুক্তিহীনতা, কূপম-ূকতা আজ মুসলিম জাতির ধর্মবোধ, ধর্মচিন্তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে তারা তাদের পালিত ধর্ম আদতে তাদের কতটুকু কাজে আসছে, আখেরাতে তা তাদেরকে জান্নাতে নিতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তা করার, নিজের কাছে সেই প্রশ্ন উত্থাপনের সাহসিকতা ও মানসিকতাও হারিয়ে ফেলেছে।
তাদের এই চিন্তার জড়ত্ব থেকে মুক্তি দিতে প্রয়োজন হচ্ছে আরেকটি রেনেসাঁর (জবহধরংংধহপব)। তারা তো ১৩০০ বছর আগে পথ হারিয়েছে, গন্তব্য ভুলে গেছে। শরিয়ত, মারেফত, ফেরকা, মাজহাবের গভীর অরণ্যে হারিয়ে গিয়েছে। এখন বহু ধরনের মত-পথ সৃষ্টি হয়েছে। কেউ হয়েছে স্বার্থোদ্ধারকারী পীর, কেউ হয়েছে ভয়ানক জঙ্গি, কেউ হয়েছে রাজনৈতিক ইসলামপন্থী, কেউ আবার ব্যক্তিগত আমলের জোরে জান্নাতে যেতে চাচ্ছেন। এমতাবস্থায় মানুষ কোন ব্যবস্থার চর্চা করে দুনিয়াতেও শান্তি পাবে আখেরাতও জান্নাত পাবে, সে সঠিক পথ কোনটি? সেই পথের সন্ধান করা এখন মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *