Connect with us

বিশেষ নিবন্ধ

পাক-ভারত যুদ্ধের দামামা: পারমাণবিক হুমকির মুখে বিশ্ব বাংলাদেশের করণীয়

Published

on

atahar

আতাহার হোসাইন:

উপমহাদেশের পরমাণু শক্তিধর দেশ ভারত এবং পাকিস্তান যুদ্ধের মুখোমুখি। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে জন্মলগ্ন থেকে শুরু হওয়া অর্ধ শতাব্দীকাল ধরে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে দেশ দু’টো। সম্প্রতি বুরহান ওয়ানি নামের একজন কাশ্মীরি তরুণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পুরো কাশ্মির উপত্যকা। লাগাতার কার্ফিউ, বিক্ষোভ চলমান অবস্থায় এ পর্যন্ত ৮৭ জনের বেশি কাশ্মিরী হত্যার শিকার হয়েছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। প্রতিরোধের মুখে আহত হয় সেনাসহ আরো বহু মানুষ। সকল ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা ইন্টারনেট, সংবাদপত্র, টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়ে চলতে থাকে কার্ফিউ। এরই মধ্যে গত ১৮ সেপ্টেম্বর চারজন আত্মঘাতী সদস্য উরির একটি সেনা ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে ১৮ জন ভারতীয় সৈনিককে হত্যা করে। ঘটনায় ভারত বরাবরের মত পাকিস্তানকে দোষারোপ করে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চলতে থাকে উত্তেজিত বাক্য বিনিময়। দুই দেশই পুরোপুরি যুদ্ধংদেহী অবস্থানে চলে যায়। পাশাপাশি দুটো দেশের পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনগুলো যুদ্ধের বাতাবরণ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া ও সাধারণ জনতা প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানে হামলা করার জন্য চাপ দিতে থাকে। প্রতিদিনের সংবাদপত্র ও সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে যুদ্ধের আহ্বান জানানো হয়। পত্র-পত্রিকার নিবন্ধগুলোতে প্রকাশিত হতে থাকে কার কত সামরিক শক্তি আছে, কে কার চাইতে কোনদিক দিয়ে এগিয়ে আছে তার হিসাব-নিকাশ।
এমতাবস্থায় কিছু একটা করে দেখানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে ভারতের। তারই আলোকে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের বেলা ভারতীয় একটি কমান্ডো বাহিনী সজ্জিত হয়ে ‘সীমান্ত রেখা অতিক্রম’ করে পাকিস্তানে হামলা চালানোর দাবি করে। ভারত দাবি করেছে গোয়েন্দা সূত্রের আলোকে তারা নিশ্চিত হয় জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা ভারতে হামলা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাই তারা জঙ্গিদেরকে ধ্বংস করতে সীমানা অতিক্রম করে আস্তানাগুলোতে সার্জিকেল স্ট্রাইক করে। এতে ৩৭/৩৮ জন জঙ্গি নিহত হয়। তবে পাকিস্তান দাবি করেছে সীমান্তে গোলাগুলি হয়েছে মাত্র। এতে তাদের দুই সৈন্য নিহত হয়েছে। একই সাথে বিনা উস্কানিতে এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ।
পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীর হামলার পর পাকিস্তান থেকেও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই হামলা চালিয়ে ৮ ভারতীয় সেনা হত্যা এবং একজন গ্রেফতারের দাবি করেছে পাকিস্তান। দুই দেশের তরফ থেকেই এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দাবি এবং দাবিসমূহ নাকচ করার কথা মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। এ থেকে সত্যিকার অর্থে সেখানে কি ঘটছে তা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে। তবে এভাবে চলতে থাকলে যে কোন সময় বেঁধে যেতে পারে বড় রকম যুদ্ধ। প্রিয় পাঠক, ভারত পাকিস্তানের কার কাছে কত যুদ্ধাস্ত্র আছে তার দিকে আমরা নাই বা গেলাম। এ নিয়ে ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে বিস্তর প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এসব তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক উত্তেজনাও বাড়ানো হয়েছে। যেহেতু আমরা এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চাই না সেহেতু যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট ক্ষতিকর দিকগুলো আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করব। তবে আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না যে দুটো দেশই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। দেশ দুটোর মধ্যে যুদ্ধ পারমাণবিক আক্রমণ পর্যন্ত চলে গেলে গোটা বিশ্বই বিরাট হুমকির মুখে পতিত হবে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও নিরাপদ থাকবে না।
পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধসমূহ:জন্মলগ্ন থেকেই ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে শত্রুতা শুরু হয়। এর মধ্যে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দুটো দেশই ১৯৪৭ সালে প্রথম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এরপর ১৯৬৫, ১৯৭১ ও সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে বড় ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এর মধ্যে তিনটি যুদ্ধই হয় কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে। একমাত্র ১৯৭১ সালে যুদ্ধ হয় বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে।
প্রথম যুদ্ধটি শুরু হয় মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু-কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় হিন্দু মহারাজা হরি সিং শাসিত জম্মু-কাশ্মির ভারত বা পাকিস্তানের অধীন না হয়ে নিজেরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকার সুযোগ পায়। কিন্তু পাকিস্তান আশঙ্কা করে মহারাজা জম্মু-কাশ্মিরকে ভারতের সাথে যুক্ত করে ফেলতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে উপজাতীয় গোত্রসহ পাকিস্তানি আধা সামরিক বাহিনী কাশ্মিরে হামলা করে বসে। পরবর্তীতে রাজা ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্তিকরণ চুক্তিতে সাক্ষরের মাধ্যমে ভারতকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানায়। এ নিয়ে যুদ্ধ বেধে যায়। পরে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১লা জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে যুদ্ধ বন্ধ করা হয়। যুদ্ধ শেষে দেখা যায় ভারত কাশ্মিরের দুই তৃতীয়াংশ (কাশ্মির উপত্যকা, জম্মু এবং লাদাখ) এবং পাকিস্তান বাকি অংশ (আযাদ কাশ্মির, গিলগিট-বালতিস্তান) দখলে নিতে সক্ষম হয়।
১৯৬৫ সালে দেশ দুটোর মধ্যে পুনরায় যুদ্ধ বেধে যায়। এবারেও যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু সেই কাশ্মীরই। ১৯৪৮ সালের কাশ্মির যুদ্ধ, পরবর্তীকালে কাশ্মিরের একাংশে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ, জম্মু ও কাশ্মিরকে ভারতে অন্তর্ভুক্তি, জাতিসংঘের ভেতরে ও বাইরে প্রতিপক্ষের কূটনেতিক আলোচনা ইত্যাদি ঘটনাবলি পাকিস্তানকে তার পছন্দ অনুযায়ী কাশ্মির সমস্যার একটি সমাধান অর্থাৎ কাশ্মিরকে পাকিস্তানের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে ভারতে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক সাহায্য ইত্যাদি ঘটনায় পাকিস্তান হতাশ হয়ে পড়ে এবং কাশ্মির সমস্যার সমাধান সুদূর পরাহত মনে হয়। আইয়ুব খানের মতো একজন সামরিক শাসকের নিকট একমাত্র সামরিক হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধই এই সমস্যার সমাধান বলে প্রতীয়মান হয়। আইউব খান সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, কাশ্মির সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান হলে পাকিস্তান সরকার আর যুদ্ধ করবে না। কারণ কাশ্মির সমস্যা ‘আমাদের নিরাপত্তা ও সমগ্র অস্তিত্ত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।’ ভারত কর্তৃক ‘যুদ্ধ-নয় চুক্তি’ প্রস্তাবের উত্তরে তিনি মন্তব্য করেন, ‘যদি কাশ্মির বিতর্ক থেকেই যায়, তাহলে ভারতের প্রস্তাবিত ‘যুদ্ধ-নয় চুক্তি’ গ্রহণ করা অসম্ভব।’
মাত্র ১৭ দিনের এই যুদ্ধে দুটো দেশই শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। তবে এ যুদ্ধ মূলত বিমান যুদ্ধের পাশাপাশি ট্যাঙ্কের লড়াই-ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তৃতীয় বড় যুদ্ধটি বাধে বর্তমান বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার রায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দল নিরঙ্কুশভাবে বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানী নেতৃত্ব শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করে। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢাকার বুকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে এক অভিযান শুরু করে। এতে ব্যাপক নীরিহ মানুষ নিহত হয়। গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তখন মানুষ দেশব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলা শুরু করে দেয়। গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। ভারত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশে প্রেরণ করে। পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচারে অন্তত ৩০ লাখ মানুষ খুন হয়। ধর্ষিত হয় প্রায় দুই লাখ নারী। আর জ্বালাও পোড়াওয়ের মাধ্যমে অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি তো রয়েছেই। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ডিসেম্বরের ৩ তারিখে পাকিস্তান ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের ১১ টি এয়ারবেসে আচমকা হামলা করে বসে। এতে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। ভারত পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ডের উপর আক্রমণ চালায়। মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ড ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয় স্বীকার করে নেয়।
চতুর্থ যুদ্ধটি বাধে ১৯৯৯ সালে। এ যুদ্ধ কারগিল যুদ্ধ নামে সমধিক পরিচিত। এ বছরের মে-জুলাই মাসে কাশ্মীরের কার্গিল জেলায় পাকিস্তানি ফৌজ ও কাশ্মিরী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে ডি ফ্যাক্টো সীমান্তরেখা হিসেবে পরিচিত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা লাইন অফ কন্ট্রোল পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়লে এই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি: সদ্য স্বাধীন হওয়া দুইটি দেশের মধ্যে প্রথম যুদ্ধটাই হয় দেশ দুটো ভালো করে দাঁড়ানোর আগেই। তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামো ভালোভাবে দাঁড়াতেই পারেনি। ১ বছর ২ মাসব্যাপী এই যুদ্ধে ভারতের পক্ষে সৈন্য মারা যায় ১৫০০ এবং পাকিস্তানের সৈনিক মারা যায় ৬০০০। আর আহতের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৫০০ ও ১৪,০০০। আর অর্থনৈতিক অন্যান্য ক্ষতিতো আছেই।
আবার ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারত, পাকিস্তান দুটো রাষ্ট্রই ব্যাপক সমরাস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধ বিমান এবং ট্যাঙ্ক নির্ভর হয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে দুই পক্ষ ক্ষয়-ক্ষতির ভিন্ন ভিন্ন দাবি করলেও সাধারণ মতে এ যুদ্ধে ভারতের সৈন্য নিহত হয় ৩০০০ জন আর পাকিস্তানের নিহত হয় ৩৮০০ জন। ভারতের ট্যাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত বা বিনষ্ট হয় ১৫০-১৯০ টি আর পাকিস্তানের ট্যাঙ্ক বিনষ্ট হয় ২০০-৩০০ টি। ভারত বিমান হারায় ৬০-৭৫ টি আর পাকিস্তান হারায় অন্তত ২০টি। ভারত ভূমি হারায় ৫৪০ বর্গকিমি এবং পাকিস্তান হারায় ১৮৪০ বর্গকিমি। এ যুদ্ধে দুই পক্ষই নিজেদেরকে বিজয়ী দাবি করে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশের প্রায় ত্রিশ লাখ সাধারণ মানুষ নিহত হয়। ধর্ষিত হয় প্রায় ২-৪ লাখ নারী। উদ্বাস্তু ও শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয় ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি মানুষ। অন্যদিকে ভারতের সৈন্য মারা যায় ৩৮৪৩ জন আর পাকিস্তানের সৈন্য মারা যায় ৯০০০ জন। আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ৯৮৫১ ও ৪৩৫০। আর পাকিস্তানি আত্মসমপর্ণকৃত সৈন্যের সংখ্যা প্রায় ৯৩ হাজার। ভারত হারায় ১ টি ফ্রিগেট, ১ টি নেভাল এয়ারক্রাফট, বিমান হারায় পাকিস্তানি দাবি অনুযায়ী ১৩০ টি আর ভারতের দাবি অনুযায়ী ৪৫ টি। অন্যদিকে পাকিস্তান হারায় ২ টি ডেষ্ট্রয়ার, ১ টি মাইন্সউইপার, ১টি সাবমেরিন, ৩ টি প্যাট্রোল ভ্যাসেল, ৭টি গানবোট এবং পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী ৪২ টি যুদ্ধবিমান যা ভারতের দাবি অনুযায়ী ৯৪।
১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধে ভারতের পক্ষে মারা যায় ৫২৭ জন এবং পাকিস্তানের ৩৫৭-৪৫৩ জন। আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ১৩৬৩ এবং ৬৬৫ এর বেশি। এতে ভারতের একটি যুদ্ধবিমান, ১টি হেলিকপ্টার ভূ-পাতিত, এবং একটি বিধ্বস্ত হয়।
সার্বিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় দুটো দেশ এ পর্যন্ত যুদ্ধ করে বহু হতাহত হয়েছে, যুদ্ধাস্ত্র হারিয়েছে। আর অন্যদিকে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষয়-ক্ষতি ইত্যাদি তো রয়েছেই।
তবে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই যে- বর্তমানে দুটো দেশই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। যুদ্ধ ব্যাপকহারে বেঁধে গেলে একে অপরের বিরুদ্ধে এই অস্ত্রগুলো যে কোন সময় ব্যবহার হতে পারে। পারস্পরিক হুমকি-ধামকির মাধ্যমে তারা এ অস্ত্র ব্যবহারের কথা ইতোমধ্যে প্রকাশ করে যাচ্ছে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা গেছে, পাকিস্তানের কাছে থাকা ১৩০টি পরমাণু বোমার সবগুলিই ভারতের দিকে তাক করে মোতায়েন করে রাখা হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে পেশ করা এক চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এবেলার প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
মার্কিন কংগ্রেসের স্বায়ত্তশাসিত শাখা কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস, সিআরএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের অস্ত্রাগারে থাকা ১১০ থেকে ১৩০টি পরমাণু বোমা সবকটিই যেকোনো মুহূর্তে ব্যবহারের জন্য তৈরি। পাকিস্তান যে সব সময়ই পরমাণু যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, সেটাই প্রমাণ করে এই প্রস্তুতি। অন্যদিকে পাকিস্তানের মোকাবেলায় ভারতও নিজেদের পরমাণু বোমার সংখ্যা বাড়াচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
যুগান্তরের কলাম লেখক জয়া ফারহানাসহ অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আবহ তৈরি হলে তার আঁচ বাংলাদেশের গায়ে পড়বে সবচেয়ে বেশি। যেমন নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের এক প্রান্তের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলাফল দ্রুত অন্য প্রত্যন্তপ্রান্তেও সিদ্ধান্ত বদলে ভূমিকা রাখে। অথবা বিশ্ব রাজনীতির চরিত্রই দাঁড়িয়ে গেছে এমন যে, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা কেবল মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক থাকছে না। মোদ্দাকথা পৃথিবীর যে কোনো দেশে যুদ্ধের জন্য কোনো উত্তেজনা তৈরি হলে তাতে জড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্ব। যে কারণে সিরিয়ার সমস্যা আর কেবল সিরিয়ার মধ্যে থাকে না, সেই একই কারণে কাশ্মিরকেন্দ্রিক ভারতের সমস্যাও কেবল ভারতের মধ্যেই সীমিত থাকবে না। পারমাণবিক যুদ্ধ বাধলে বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। এতে অন্তত ২০০ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে মানবসভ্যতা। সাম্প্রতিক নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অব নিউক্লিয়ার ওয়্যার এবং ফিজিশিয়ানস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি এই দুটি সংগঠন প্রকাশিত গবেষণামূলক এক প্রতিবেদনে এই আশঙ্কার কথা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই দুই দেশের মধ্যে সীমিত পর্যায়েও পারমাণবিক অস্ত্রের লড়াই হলে বিশ্বের আবহাওয়াম-লের ব্যাপক ক্ষতি ও শস্যক্ষেত্র ধ্বংস হবে। পরিণামে খাদ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে বহু গুণ খারাপ প্রভাব পড়বে। খাদ্যশৃঙ্খলায় দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা।
এ অবস্থায় যদি সত্যিই এ অঞ্চলে একটি যুদ্ধ বাধে, তাহলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের বাংলাদেশ- এতে কোনো সন্দেহই নেই। সুতরাং এরকম একটি ভয়ানক পরিস্থিতিতে আমাদেরকেও সচেতন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। কিন্তু সে বাধ্যবাধকতা কয়জন অনুধাবন করছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এ সময়টি রাজনৈতিক দলাদলি-কোন্দল, বিদেশমুখিতার সময় নয়। এখন দরকার ছিল প্রবল জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আসন্ন যে কোনো পরিস্থিতিতে দেশের ১৬ কোটি মানুষ যাতে নিরাপদে থাকে সে পদক্ষেপ নেওয়া।অন্যথায় গত ৪৫ বছর যাবৎ তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই দেশটিও ভীষণ হুমকির মুখে পড়বে। সুতরাং যে করেই হোক এই সবুজ ভূখ-টিকে রক্ষা করতেই হবে। সাধারণ মানুষকে কেবল চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য আর ক্ষেত-ক্ষামার নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে না, চারদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে, সজাগ-সচেতন থাকতে হবে। সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যেমন সোচ্চার, সজাগ ঠিক তেমনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ব্যাপারেও সরকারকে সচেতন হতে হবে। আর পার্শবর্তী দু’টি দেশের অভন্তরীণ বিষয়ে প্রতিবেশী দেশ হিসাবে আমাদের নিরপেক্ষ থাকা উচিত, কোনোভাবেই যেন এ যুদ্ধে আমাদেরকে কেউ জড়াতে না পারে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ঐক্যচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। সঙ্ককটকালে ঐক্যই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে। ১৬ কোটি মানুষকে যদি ঐক্যবদ্ধ করা যায় তবে যে কোনো পরিস্থিতি আমরা মোকাবেল করতে পারব। অভ্যন্তরীণ বাদ-বিবাদ থাকতে পারে, কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে বন্যা আসলে সাপ-বেজিরও বন্ধুত্ব হয়। আমরা তো আর সাপ-বেজি নই, আমরা হলাম আশরাফুল মাখলুকাত। তবে আমরা কেন দেশের স্বার্থে ক্ষুদ্র বিদ্বেষ পরিহার করতে পারব না?

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *