ঠাকুরগাঁও রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড গার্লস ক্লাবের উজ্জল সম্ভাবনা
রাণীশংকৈল(ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি:
ঠাকুরগাঁও জেলার মনোরম বিজড়িত সবুজ সমাহারে ঘেরা প্রকৃতির এক অপরূপে সৌন্দর্য মন্ডিত রাণীশংকৈল উপজেলার এক নিভৃত পল্লীতে গড়ে উঠেছে রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড গার্লস ক্লাব। এ সংবাদটি আমার কানে আসার পর থেকেই মনটা যেন আনাচান হয়ে উঠে। কাজের ঝামেলা আর সময়ের অভাবে সরেজমিনে হাজির হতে পারিনা। একদিন সব কাজ, বাধা বিপত্তি এড়িয়ে মনের জোরে ছুটে গেলাম সেখানে। সত্যিই শীতের বিকেল বেলা প্রচন্ড শীতের আক্রমন। একটুও কর্নপাত নেই তার প্রতি। শীতকে উপেক্ষা করে মাঠ জুড়ে চলছে ভলিবল, ক্রিকেট ও মেয়েদের ফুটবল প্রশিক্ষণ। এখানে এসে নিজেকে ধন্য মনে করলাম।
খেলোয়াড়দের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম রাণীশংকৈল ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ আর্থিক যোগান দিয়ে আসছেন। তিনি এদের গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন মোঃ সেতাউর রহমান, জয়নুল ইসলাম, সুগা মুর্মু ও আব্দুর রাজ্জাক নামের এই চার কিংবদন্তি ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের। মহিলা ফুটবলারদের সাথে আলাপচারিতায় তারা জানালো, একদিন তাজুল স্যার আমাদের ফুটবল খেলার কথা জানালেন তাতে আমরা উৎসাহের সাথে রাজি হয়ে গেলাম। তবে প্রথম দিনগুলোর কথা মনে পড়লে খুব হাসি পায়। কারণ দুই একজন ছাড়া বল পায়ে লাগাতে পারতাম না। বিশেষ করে প্রথম যেদিন জার্সি এবং হাফ প্যান্ট পড়ি। সেদিনের শারীরিক অভিজ্ঞতা অন্যরকম। অনেকের সামনে এধরনের পোশাকে অভ্যস্ত ছিলামনা। এ ক্ষেত্রে সেতাউর স্যার, জয়নুল স্যার ও সুগা আন্তরিক উৎসাহ ও সাহস যোগান দিয়েছেন। আমরা প্রথম খেলি বনগাঁও আবু জাহিদ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাথে। তারা ইতিমধ্যে উপজেলা, জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে খেলার গৌরব অর্জন করেছে। প্রথম খেলায় অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম। খেলাটি ড্র হয়েছিল। তাদের গোলকিপার সাগরিকার জন্যই সেদিন জিততে পারিনি। সাগরিকা এখন আমাদের দলের খেলোয়াড়। এরপর আমরা জগদল জমিদার বাড়ি ঘুরতে যায়। সেখানে ঢোলপুকুর স্কুলে দু’ভাগ হয়ে খেলি। লোকজন আমাদের বেশ উৎসাহ দিয়েছিল। আমরা প্রতিদিন নিয়মিত মাঠে আসি, অনুশীলন করি, একে অন্যের খোজ খবর রাখি।
অনুশীলনের মাঝেই স্যার আমাদের অভিভাকদের সঙ্গে আলপ আলোচনা করাই অভিভাকরাই নিজ নিজ মেয়েকে মাঠে আসার জন্য তাগিদ দেন। এরই মধ্যে আমরা জনগাঁও মাঠে দুইবার প্রীতি ম্যাচে অংশগ্রহণ করি। প্রথমবার আমরা ২-১ গোলে জয়লাভ করি। দ্বিতীয় খেলায় অবশ্য ড্র হয়। আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য দিনাজপুর ষ্টেডিয়ামে দিনাজপুর জেলা দলকে ১ শূন্য গোলে হারায়। গোলটি করে হান্ন। তবে বলটি তৈরী করেছিল শিল্পী। আমাদের কনিষ্ট খেলোয়াড়ের মধ্যে আদুরী সকল দর্শককে মুগ্ধ করার মতো খেলেছে। সবাই তাকে মেসি মেসি বলে চিৎকার করে ডাকছিলো দিনাজপুর ষ্টেডিয়ামে। সত্যিই অসম্ভব খেলেছিল সে। অল্প সময়ের মধ্যে স্যার আমাদের তিন দফায় বুট জার্সি ট্রাওজার কিনে দিয়েছেন। আমরা সবাই অনেক দুরে যাবার স্বপ্ন নিয়ে ড্রেস আপ করে নিয়মিত অনুশীলন করে যাচ্ছি। আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য কতভাবে প্ররিশ্রম করে যাচ্ছেন সেতাউর স্যার, জয়নুল স্যার, সুগা স্যার ও রাজ্জাক স্যার। আমরা এখন শারীরিক ও মানসিকভাবে কতটা এগিয়ে যাবার চিন্তা সাহস সঞ্চয় করেছি সেটা এখনও প্রকাশ করার সময় আসেনি। আমাদের আশা একদিন সেই কথা বলার সময় আসবে। তাজুল স্যার আমাদের প্রত্যেকের জন্য কি করছেন কি করতে চান সময়েই তার উত্তর পাওয়া যাবে। সকল বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় আমদের লক্ষ। আমাদের স্যার, অভিভাবক ও প্রতিবেশীদের উৎসাহ সহযোগিতায় মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলায় অংশ নেওয়া সহজ হয়েছে। এজন্য স্রষ্টার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা।
মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তারা জানায়, যখন বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে নারীর যৌগক ভূমিকা খুব প্রয়োজন ছিল। শিক্ষায় নারীর অংশ গ্রহণ নিশ্চিত হলেও নারীর মধ্যে কু সংস্কার নারীর আত্মবিশ্বাসকে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে এখনও অনেক বাঁধা তাকে পেছনদিকে টানছিল। শিক্ষার সূচনা হলেও বাল্য বিবাহ, নারীর স্বাস্থ্য, নারীর জীবন এবং জীবীকার জন্য তাকে ভাগ্যের উপরেই নির্ভর করতে হয়। আমাদের ফুটবল খেলা আমাদের বিশিষ্ট ফুটবলার হওয়ার চেয়েও আমাদের নারীর চিন্তার জগতে এরকম প্রত্যন্ত গ্রামে নারীর শক্তি, সময়ের পাশাপাশি নারীর স্বপ্ন সাফল্যের ক্ষেত্রে নতুন আশা জাগাবে বলেই আমার সবাই বিশ্বস করি। সত্যি বলতে কী আমাদের এই চিন্তার জগতে নতুন খেলার নতুন স্বপ্ন বুনলে কোন এনজিওর কর্তব্য নয় বরং বলা যায় নিখাদ তাজুল স্যারের ব্যক্তিগত উদ্যোগ সেতাউর স্যারের প্রচেষ্টাই মূল প্রেরণা।
প্রশিক্ষক সেতাউর রহমান জানান, সারা দেশে মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিকাল বেলার সময়টুকু খেলাধুলার মাঝে কাটালে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা মাদকের সাথে জড়াবেনা। মেয়েদের নিয়ে দল গঠন করা হয়েছে যাতে করে ছেলেরা এইসব মেয়েদের দিকে দেখে মাদককে না বলে খেলার মাঠে ফিরে আসে। সুস্থ সবল সুশীল সমাজ গঠনে সহায়তা করে এই প্রত্যয় নিয়ে তাজুল স্যারের সহায়তায় মেয়েদের খেলাধুলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড গার্লস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা তাজুল ইসলাম জানান, স্কুল থেকে খেলার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এখন এলাকায় পেশার কারণে থাকি। মনে প্রাণে বিশ্বাস করি সুস্থ্য সমাজ গড়ার জন্য সংস্কৃতি চর্চা পড়ালেখার পাশাপাশি সহপাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে খেলাধুলার সাথে ছেলে-মেয়েদের যুক্ত করতে হবে। উপদেশ দিয়ে ছেলে মেয়েদের শুধুমাত্র স্বপ্নবান করা যায়না, স্বপ্ন পূরণের জন্য নিরোগ, নেশাবিরোধী, মানবিক গুন সম্পন্ন আগামীর প্রজন্ম প্রস্তুত করতে হলে ছেলে-মেয়ে, যুবকদের খেলার মাঠের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে হবে। বিশেষত নারীকে আরো আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে তোলার জন্য অন্যান্য কর্মযজ্ঞ্যের পাশাপাশি খেলার মাঠে তাদেরকে নিয়ে আসতে হবে। খেলার মধ্যে তাদেরকে নিবিষ্ঠ করতে পারলে একজন ভাল বা সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় হওয়ার সাথে সাথে সে তার স্বাস্থ্য, মন, বিশ্বাসের দৃঢ় পরিবর্তন ঘটাবে, ঘটতে বাধ্য। সেই চিন্তা থেকে ফুটবল যেহেতু গ্রুপ খেলা তাই, মেয়েদের ফুটবল খেলা দিয়ে শুরু করেছি। কারণ একই সঙ্গে অনেক মেয়ে খেলায় অংশ নিতে হয় বলে। ধীরে ধীরে একটি গ্রুপ গড়ে উঠবে। যারা শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয় মানুষ হিসেবেও প্রচলিত বিশ্বাসকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয় অবশ্যই ঘোষনা করবেই।
বাংলাদেশকে একটি আধুনিক উন্নয়নশীল রাষ্ট্র নির্মানে নারীর সর্বক্ষেত্রে স্বতোঃস্ফুত অংশগ্রহণ অনিবার্য। সময় বলে দিবে কী ঘটবে ভবিষ্যতে।