Connecting You with the Truth

বাংলার মুসলমানদের সাহিত্য আন্দোলনে পন্নী পরিবারের ভূমিকা

করটিয়া জামে মসজিদ
মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর বাড়ি তথা করটিয়া জমিদার বাড়ির দক্ষিণে অবস্থিত এই মসজিদটি প্রায় ১৪৪ বছরের পুরনো মসজিদ। ১৮৭১ সালে এমামুযযামানের প্রপিতামহ হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। কারুকার্যশোভিত ত্রিকোণ মিনার, প্রাচীন আমলের ঝুলন্ত ঝাড়বাতি এবং সিন্দুক, তিনটি মেহরাব সকলেরই দৃষ্টি কাড়ে।

ইতিহাস একটি জাতির বর্তমান নির্মাণ করে আর বর্তমানের কর্ম নির্মাণ করে তার ভবিষ্যৎ। তাই অতীতকে অস্বীকার করে কখনোই সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। একাত্তর সনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীনতার লক্ষ্যে শাসকের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। একইভাবে পূর্বেও বহুবার বাঙালি জাতি দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে ঐক্য গঠন করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় একাত্তরের স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে আজও অম্লান থাকলেও এর পূর্বের সংগ্রামগুলোর ইতিহাস সম্পর্কে আমরা তেমন অবগত নই। সেই ইতিহাসগুলোও আমাদের জানা থাকা জরুরি, অন্যথায় আমাদের অতীতজ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং সেই ইতিহাসের শিক্ষা থেকে আমরা বঞ্চিত রয়ে যাব।
.
বর্তমানে আমরা যখন হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় এমামুযযামানের আদর্শকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করছি, আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেকেই সুলতানী যুগ থেকে শুরু করে অদ্যবধি এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ, সাহিত্য, শিল্প, শাসন, রাজনীতি প্রতিটি অঙ্গনে পন্নী পরিবারের অসামান্য অবদান সম্পর্কে অবহিত নন।
.
এ কারণে আমরা ক্রমান্বয়ে একেকটি বিষয়ে এমামুযযামান এবং তাঁর পরিবারের গৌরবময় অতীত ও বর্তমানকে তুলে ধরার প্রয়াস করব। আজ আমরা মাননীয় এমামুযযামানের প্রপিতামত হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর সাংবাদিকতা ও সাহিত্য জগতের কিছু অবদানের কথা উল্লেখ করছি।
.
জাতীয় জাগরণে জনমত সৃষ্টিতে সংবাদপত্র সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে যে দুই শতাব্দব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে তাতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে চেষ্টা করা হয়েছে। সনাতন ধর্মী ও মুসলিমদের মধ্যে বহু সংগঠন ও পত্রিকা হয়েছিল যেগুলো ধর্মীয় চেতনাকে স্বাধিকার আন্দোলনের পথে প্রবাহিত করেছে।
.
উনিশ শতকের শেষ দুই দশক এবং কুড়ি শতকের প্রথম ভাগে প্রকাশিত সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র এবং সমসাময়িক মুসলিম সাহিত্য সাধনা ও ইংরেজ ও তাদের আনুকূল্যপ্রাপ্ত বর্ণহিন্দুদের যৌথ শোষণ-লুণ্ঠন, ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রের কারণে পিছিয়ে পড়া বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
.
মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মুসলমানগণ মূলত এই জাগরণ প্রয়াসের কাণ্ডারি ছিলেন। তবে এ কাজে কয়েকজন সমাজহিতৈষী বিত্তবান মুসলমান বিশেষ যতœবান ছিলেন। তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অগ্রণী ছিলেন মোমেনশাহীর ধনবাড়ির জমিদার সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯)। তাঁর কাছে বাংলার মুসলমানেরা নানাভাবেই ঋণী। তিনি ছিলেন হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর মা মোসাম্মাৎ বিলকিস খানমের নানা।
.

দেলদুয়ার জমিদার
১৮৮৮ সালে ঢাকায় পূর্ববঙ্গের সম্ভ্রান্ত জমিদারদের সঙ্গে হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী (হলুদ বাক্স চিহ্নিত)

এমামুযযামানের পূর্বপুরুষগণ ব্রিটিশ শাসনকে কোনোদিনই হৃদয় থেকে গ্রহণ করেন নি, বরং তারা সর্ব উপায়ে চেষ্টা চালিয়েছেন বাংলার মানুষের হৃদয়ে স্বাধিকার চেতনার অগ্নিকে প্রজ্জ্বলিত করে তুলতে। মোঘল আমল থেকেই ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল-বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গের বিরাট এলাকার জমিদার ছিলেন তারা।
.
দেলদুয়ারের জমিদার গজনভী পরিবারের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার নিবিড় বন্ধন ছিল। এই উভয় পরিবারই মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার তথা ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের বিস্তারের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। সেই যুগে এমামুযযামানের দাদার বাবা করটিয়ার জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী এই লক্ষ্যে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার নাম ছিল ‘মাহমুদিয়া যন্ত্র’ বা ‘মাহমুদিয়া প্রেস’।
.
উল্লেখ না করলেই নয় যে, তিনি একজন দৃষ্টিহীন ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু দৃষ্টিহীনতা তাকে সমাজচিন্তা বা জ্ঞানসাধনা থেকে বিরত রাখতে পারে নি। তিনি সর্বদার জন্য জ্ঞানী-গুণীজনদের দ্বারা পরিবৃত থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি শারীরিকভাবে অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন, তার অন্যান্য অনুভূতিগুলো দৃষ্টিমান ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষুরধার।
.
তার মেধা, চিন্তা ও বিচারক্ষমতা আজও প্রবাদতুল্য। তার প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত প্রেস থেকে বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থ, পত্রিকা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। পন্নী পরিবারের প্রতাপ ও জনপ্রিয়তা এতই বিপুল ছিল তাদেরকে অবজ্ঞা করাও ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে সম্ভব হয় নি।
.
আব্দুল হালিম গজনভীর মা বিদ্যানুরাগী করিমুন্নেসার অর্থানুকূল্যে টাঙ্গাইল থেকে ১৮৮৬ সালে (শ্রাবণ ১২৯৩) আব্দুল হামিন খান ইউসুফজাই- এর সম্পাদনায় ‘আহমদী’ নামে অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়নিষ্ঠ একটা পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এর আগে ১৮৮৫ সনে এটি মাসিক পত্রিকা হিসাবে প্রকাশিত হয়। ১৮৮৯ সনে (১২৯৬ বাংলা সনে) স্থানীয় একটি পত্রিকার সঙ্গে একত্রিত হয়ে এটির নাম হয় ‘আহমদী ও নবরত্ন’।
.
টাঙ্গাইলের সুরুজ গ্রামের অধিবাসী মাওলানা মুহাম্মদ নঈমুদ্দিন হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর পৃষ্ঠপোষণে পবিত্র কোর’আনের টীকাসহ পূর্ণ অনুবাদ করেন যা ১৮৮৭ সনে করটিয়ার মাহমুদিয়া প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। কোর’আনের হাতে লেখা কপিটি এখনো সা’দত বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে।
.
এর প্রকাশক ছিলেন মীর আতাহার আলী। তিনি বোখারি শরিফও অনুবাদ করেন এবং আরো প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ রচনা করেন। এভাবেই হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী সর্বপ্রথম কোরা’আন ও বোখারি শরিফ অনুবাদ করিয়ে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।
.
বাংলার মুসলমানদের সাহিত্য আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী পত্রিকা ‘আখবারে এসলামিয়া’ (১৮৮৪) প্রকাশিত হয় ‘মাহমুদিয়া প্রেস’ থেকে যার সম্পাদক ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ নঈমুদ্দিন।
.
১০ বছর টানা তিনি এই পত্রিকাটি প্রকাশ করেছেন। সে সময়ে করটিয়ার ‘আখবারে এসলামিয়া’ পত্রিকাটি ছাড়া সব ক’টি পত্রিকাই প্রকাশিত হয় কোলকাতা থেকে। বলা চলে, বাংলার মুসলিম সাংবাদিকতার এটাই ছিল সূচনা পর্ব। পরবর্তীতে ১৮৯০ সালে মীর মোশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া থেকে পাক্ষিক ‘হিতকরী’ প্রকাশিত হতো সম্পূর্ণরূপে টাঙ্গাইলের হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর আর্থিক সহায়তায়।
.
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ভাষাবিদ ও রাজনীতিবিদ আবুল কালাম শামসুদ্দীন এ বিষয়ে পরবর্তীতে লিখেছেন, “বাঙ্গালি মুসলমান কর্তৃক সংবাদপত্র প্রকাশের সত্যিকার চেষ্টা হয় সম্ভবত ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। তখন কয়েকজন উদ্যমশীল মুসলমান সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়, যাদের সমাজ হিতৈষণা মুসলিম বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।” বলার অপেক্ষা রাখে না যে মাহমুদ আলী খান পন্নী ছিলেন এদেরই অন্তর্ভুক্ত।
.
তার নামের স্মৃতি বহন করছে করটিয়ার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এইচ. এম. ইনিস্টিটিউশন যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার জ্যেষ্ঠপুত্র দানবীর ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চান মিয়া সাহেব। এসএসসি পর্যন্ত এ স্কুলেই পড়াশুনা করেছেন এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী।

Comments
Loading...