জাতীয়
ইসলাম ও দেশের স্বার্থে আলেমদেরকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে -হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
মানুষ হিসেবে প্রত্যেককে তার নিজেকে নিয়ে, পরিবার নিয়ে, সমাজ নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে ও বিশ্ব নিয়ে ভাবতে হবে। কোথায় কী হচ্ছে, সেটা ন্যায় হচ্ছে নাকি অন্যায় হচ্ছে, লাভ হচ্ছে নাকি ক্ষতি হচ্ছে তা বুঝতে হবে। এটা মানুষের প্রথম বৈশিষ্ট্য। মানুষ পশু নয় যে, জন্ম নিবে, খাদ্যগ্রহণ করবে, বংশবিস্তার করবে তারপর মরে যাবে। এর বাইরেও মানুষের অনেক কিছু করার আছে। আর যারা আলেম তাদের পক্ষে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার কোনো সুযোগই নেই। আলেমদের উপর জনগণের অগাধ আস্থা। আলেমরা যা বলেন ঠিকই বলেন এমনটাই মানুষ মনে করে। সুতরাং জাতির ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলেমদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
জঙ্গিবাদ এমন সঙ্কট যাকে এড়িয়ে যাবার অবকাশ নেই। বাংলাদেশও আজ আক্রান্ত। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন কেবল অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে না, মানুষকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা দিতে হবে। এই কথাটিই আমরা হেযবুত তওহীদ প্রথম থেকে বলে আসছি। জঙ্গিবাদ একটি বিকৃত আদর্শ, ইসলামের অপব্যাখ্যা থেকে এর সৃষ্টি সুতরাং একে প্রকৃত আদর্শ দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে, অন্য কিছু করে পারবেন না। আমাদের এই বক্তব্যটিই এখন বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করে অনেকেই বলছেন। সবাই বলছেন ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু সেটা কোথায়? আজকে একেকজন একেকভাবে ইসলামের ব্যাখ্যা করছেন। পীররা করছেন একভাবে, জঙ্গিরা করছে একভাবে, গণতান্ত্রিক ইসলামীরা করছেন অন্যভাবে। ফেরকা-মাজহাবের অভাব নাই, দল-উপদলের অভাব নাই। মানুষ কোনদিকে যাবে? আল্লাহ এক, রসুল এক, দ্বীন এক, আল্লাহর দেওয়া পথও একটাই হবে, তাই নয় কি? সেটা কোনটা? রাইট ডাইরেকশন কোনটা? সুরা ফাতিহাতে প্রতি ওয়াক্তে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ আমাদেরকে সেরাতুল মোস্তাকিমে চালিত কর। সেই সেরাতুর মোস্তাকীম বা সহজ-সরল পথ জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে এবং এমন পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে যেন তা নিয়ে মতভেদের, মতানৈক্যের কোনো সুযোগ না থাকে। নইলে জাতির অস্তিত্ব টিকবে না, ধর্ম টিকবে না, তরুণদেরকে রক্ষা করা যাবে না। ইসলামের বিরুদ্ধে, মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে, সর্বোপরি আমাদের প্রাণপ্রিয় দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। মো’মেন আলেমদেরকে এর প্রতিবাদ করতে হবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। হীনম্মন্য হলে চলবে না। আমার ইসলামেই বুঝি সমস্যা আছে এমনটা ভাবলে হবে না। বর্তমানে যে অযৌক্তিক কর্মকা- হচ্ছে, আল্লাহু আকবার বলে মানুষ জবাই হচ্ছে, এতে করে দুনিয়াজোড়া ইসলাম সম্পর্কে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে যে, কোর’আন সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। ফলে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন ইসলামবিদ্বেষ অনেক বেড়েছে। এটা আমার কথা নয় বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিষয়টি। এই ইসলামবিদ্বেষ সৃষ্টি করার জন্যই সাম্রাজ্যবাদীরা জঙ্গিবাদের জ্বালানি যোগায়। সুতরাং জঙ্গিবাদকে সাইডে রেখে দিয়ে, এ নিয়ে নিশ্চুপ থাকলে চূড়ান্তভাবে ইসলামেরই ক্ষতি হবে। ইসলামের স্বার্থে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আমরা যখন এ কথাগুলো বলি তখন কেউ কেউ বলেন, সাম্রাজ্যবাদীরা আকাশ থেকে বোমা ফেলে মুসলিম নর-নারী-শিশুদেরকে নির্বিচারে হত্যা করছে, তাতে কিছু হচ্ছে না, কিন্তু জঙ্গিরা মাত্র বিশজন মানুষকে হত্যা করলেই সবাই তেড়ে আসে। পশ্চিমারা করলে সমস্যা নাই, মুসলমানরা করলেই দোষ? এমন অভিযোগ তোলার আগে আমাদেরকে বুঝতে হবে- অন্যায়ের মোকাবেলা কখনও অন্যায় দিয়ে হয় না। তারা আমাদেরকে নির্বিচারে দেশসমেত ধ্বংস করে ফেলছে বলে আমরাও তাদেরকে যেখানে পাব নির্বিচারে হত্যা করব- এটা না কোনো যৌক্তিক কাজ হবে, না ইসলামসমর্থিত কাজ হবে। এতে আমাদের নিজেদেরই ক্ষতি, ইসলামের অপমান হয় মাত্র।
মুসলমানদেরকে হীনম্মন্য হওয়া চলবে না। কারণ, আমার রসুলে পাক কেমন ছিলেন তা ইতিহাস হয়ে আছে। তিনি সন্ত্রাস সৃষ্টি করেন নি। তিনি তাঁর নবুয়্যতি জীবনে কখনই কোনো অন্যায় কাজ করেন নি, অন্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নি। তিনি ছিলেন আল্লাহর সত্য রসুল, ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। চরম শত্রুও তাঁকে নিশ্চিন্তে ভরসা করত কারণ সবাই জানত মোহাম্মদ (সা.) অন্যায় করতে পারেন না। প্রকৃত ইসলাম কেমন ছিল, কীভাবে সেই ইসলাম মানবজীবনে ঐক্য, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছিল তা সম্মানের সাথে বলতে হবে। ন্যায়কে ন্যায় আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে হবে দ্বিধাহীনভাবে। বর্তমানে ইসলামের নামে যত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থোদ্ধার চলছে সেটা যে আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয় তা দ্ব্যর্থহীনভাবে উচ্চারণ করতে হবে। আজ সারা পৃথিবীতে মুসলিম জাতির জীবনে অমানিশার ঘোর অন্ধকার বিরাজ করছে। মাত্র দু’ মুঠো অন্নের জন্য মুসলিম মা-বোনরা নিজেদের ইজ্জত বিক্রি করছে। পেটের দায়ে নারীর শরীরবিক্রির উদাহরণ বহু আছে, কিন্তু মুসলিম পুরুষরাও দেহব্যবসায় নামতে বাধ্য হচ্ছে যখন, তখন বোঝা যায় কতটা নিরুপায় এই জাতি। ধর্ম ত্যাগ করা লাগলেও তারা ইউরোপে পাড়ি জমাতে দ্বিধা করছে না। এসব আপনাদের অজানা নয়। উম্মাহর জীবনের এতবড় অমানিশার অন্ধকার আগে কখনও আসে নাই। এ অন্ধকারের ছায়া পড়েছে আমাদের এই দেশের মাটিতেও। যে মাটিতে আমরা সেজদা করি, যে মাটির ধুলিকণায় মিশে আছে আমাদের পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা, যে মাটিতে ফসল ফলিয়ে আমাদের জীবিকা চালাই সেই মাটিকেও ইরাক-সিরিয়ার মত বিরাণভূমি বানাতে চায় ষড়যন্ত্রকারীরা। তাদের পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত হয়ে যায় তবে কেবল জন্মভূমিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, একইসাথে আমাদের ধর্মও যাবে, ঈমানও যাবে, কিছুই থাকবে না। এই আশঙ্কা অনুধাবন করে আমরা সারা দেশে ছুটে বেড়াচ্ছি। জানি না আমাদের দুর্বল কণ্ঠ কতখানি আলোড়ন তুলবে, কয়জনের ঘুম ভাঙাবে। কিন্তু চেষ্টা আমাদেরকে করতে হবে।
সরকারকে বলতে চাই- আপনারা জেল, জরিমানা, ফাসি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু শক্তির পাশাপাশি আদর্শও লাগবে। আদর্শ দিয়ে তাদেরকে সঠিক পথে ধাবিত করতে না পারলে ভুল পথ থেকে ফেরানো সম্ভব নয়। আকীদা শিক্ষা দিতে হবে। আকদ থেকে আকীদা, অর্থাৎ ইসলাম কি, কেন, কীভাবে ইত্যাদি সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা শিক্ষা দিতে হবে। যেমন ধরুন একটি কলম। আমি যদি বলি এটা কলম, এটা দিয়ে লিখতে হয়, লেখার জন্য তৈরি করা হয়েছে, এই যে এইভাবে লিখতে হয় ইত্যাদি, তাহলে কলম সম্পর্কে আমার আকীদা পরিষ্কার হলো। কিন্তু যদি বলি এটা দিয়ে মানুষকে আঘাত করতে হয়, তাহলে এর সম্পর্কে আকীদা ভুল হলো। যার আকীদা ভুল তাকে যখন এই কলম দেওয়া হবে সে এটা দিয়ে লেখালেখির কাজ করবে না, এটা দিয়ে মানুষকে আঘাত করতে চাইবে, অর্থাৎ তার আমলও ভুল হবে। এ কারণেই আকীদা অত্যন্ত জরুরি। যার কলম সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা আছে সে জানে একটি কলমের অনেকগুলো অংশ বা পার্টস থাকে। এই সবগুলো নিয়েই কলম হয়। তাকে যদি কেউ কলমের যে কোনো অংশ দেখিয়ে বলে এটাই কলম সে প্রতারিত হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তির কলম সম্পর্কে ধারণা নেই তাকে কলমের হেড দেখিয়েও কলম বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। একইভাবে যখন কোনো ব্যক্তির ইসলাম সম্পর্কে আকীদা পরিষ্কার থাকে তখন সে ইসলামের যে বিধান যে প্রেক্ষাপটের জন্য যেভাবে আমল করতে হয় সেভাবে আমল করতে পারে। তাকে কেউ ভুল বোঝাতে পারে না। কিন্তু যার ইসলাম সম্পর্কে আকীদা পরিষ্কার নেই, সামগ্রিক ধারণা নেই, তাকে কোর’আনের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন অর্থবোধক আয়াত দেখিয়ে খুব সহজেই বিভ্রান্ত করা যায় এবং মানবতার জন্য অকল্যাণকর কাজ তাকে দিয়ে সহজে করানো যায় ইসলামের নাম ব্যবহার করে। এই ব্যক্তিকে যখন বোঝানো হয় আল্লাহর রসুল এই যে এতগুলো যুদ্ধ করেছেন, কোর’আনে এতগুলো জিহাদের নির্দেশ আছে, কাফেরদের কতল করতে বলা হয়েছে ইত্যাদি, তখন ঐ লোক স্বভাবতই জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। হ্যাঁ, আল্লাহর রসুল নিজে জেহাদ করেছেন, কিতাল করেছেন, ৭৮টি যুদ্ধ করেছেন, এগুলো তো অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আপনাকে জানতে হবে কখন করেছেন, কোন প্রেক্ষাপটে করেছেন, কেন করেছেন। আল্লাহর রসুল অনেক বড় বড় দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। তিনি একাধারে রসুল ছিলেন, উম্মাহর নামাজের ইমাম ছিলেন, রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, সামরিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন, এমনকি প্রধান বিচারপতি ছিলেন। সুতরাং তাঁর অনেক সিদ্ধান্ত ছিল রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে, অনেক সিদ্ধান্ত ছিল সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে। আবার অনেক সিদ্ধান্ত ছিল বিচারপতি হিসেবে। সুতরাং কোন সিদ্ধান্ত তিনি কোন অবস্থান থেকে কোন প্রেক্ষাপটে কী কারণে নিয়েছিলেন তার সামগ্রিক জ্ঞান না রেখে, রসুলের সম্পূর্ণ জীবনের বিভিন্ন পর্যায় থেকে কেবল একটি ঘটনা বা একটি বর্ণনাকে আলাদা করে নিয়ে ওইটাকে ভিত্তি করে কর্মপন্থা স্থির করতে গেলে ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। জঙ্গিবাদ আর কিছু নয়, রসুলের সামগ্রিক জীবনকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার ব্যর্থতা।
আদম (আ.) থেকে মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর আল্লাহ পাঠিয়েছেন হেদায়াহ অর্থাৎ রাইট ডিরেকশন দিয়ে সত্য মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার জন্য। সবাইকেই তিনি দিয়েছেন তওহীদ। একটাই দাবি আল্লাহর। আল্লাহ বললেন মানুষ পৃথিবীতে আমার খলিফা, প্রতিনিধি। সুতরাং আমরা আল্লাহর খলিফা। আল্লাহ আমাদেরকে পৃথিবীতে পাঠালেন। আল্লাহর একটাই দাবি, তোমরা শুধু আমার হুকুম মানবে, লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ, আমার হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম মানবে না। আল্লাহর রসুল বলেছেন, যে বলবে লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ সেই জান্নাত যাবে। এই কথাটার অর্থ হলো আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া, আল্লাহর বিধান ছাড়া, আল্লাহর আদেশ নিষেধ ছাড়া আমরা কারো হুকুম, বিধান, আদেশ, নিষেধ মানব না। এটা হল কলেমার দাবি।
আল্লাহ যে মুহূর্তে আদমকে (আ.) পৃথিবীতে পাঠালেন সেই মুহূর্ত থেকে শুরু হলো পৃথিবীতে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব। এ কথাই আল্লাহ বলেছেন, আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি তাদের কেউ মো’মেন কেউ কাফের। মো’মেন তারা যারা সত্যের পক্ষে, আর মিথ্যার পক্ষ নিবে যারা তারা কাফের। পরিণতিও দুইটি। সত্যের পক্ষ নিলে আসবে শান্তি, অসত্যের পক্ষ নিলে অশান্তি। আল্লাহ শান্তির পক্ষে। তাই যারা শান্তি কায়েম করবে তাদেরকে তিনি সাহায্য করেন, পুরস্কৃত করেন। অন্যদিকে ইবলিশের প্রচেষ্টা হচ্ছে মানুষকে তওহীদ থেকে বিচ্যুত করা। কারণ তওহীদ ছাড়লেই মানুষ অশান্তিতে পতিত হবে।
আদম (আ.) থেকে এ পর্যন্ত সমস্ত নবী রাসুল কোন না কোনো বিশেষ এলাকা গোত্র বংশের জন্য এসেছেন, আর শেষ নবী যিনি এসেছেন আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিলেন এমন একজন নবী পাঠাবেন সারা বিশে^র জন্য, জাতি হবে একটা এবং সমস্ত বিশে^র সকল মানুষ পরিচালনার জন্য এমন একটা বিধান হবে যে বিধান হবে প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সঙ্গতিশীল। তাই এর একটি নাম দ্বীনুল ফেতরাহ। এই দ্বীন প্রাকৃতিক নিয়মে কার্যকরী হবে। মরু অঞ্চলে মেরু অঞ্চলে, উষ্ণ অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে সর্বত্র সমভাবে প্রযোজ্য হবে। এ লক্ষ্যে তিনি শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) কে পাঠালেন যিনি এসেছেন সমস্ত বিশে^র মানবজাতির জন্য এবং তাঁর উপর যে কেতাব নাজিল হয়েছে সেই কেতাব সমস্ত মানবজাতির জন্য। আল্লাহ রসুলকে (স.) বলেছেন, রসুল আপনি বলুন, হে মানবজাতি! আমি সকলের জন্য আল্লাহর রসুল (সুরা আরাফ ১৫৮)। এখানে রসুল (স.) বলেন নি ইয়া বনি ইসরাইল, ইয়া আরব, ইয়া কোরাইশ, বলেছেন হে মানবজাতি অর্থাৎ সমস্ত মানবজাতির জন্য তিনি নবী। তাঁকে কী করতে হবে? সুরা ফাতাহর ২৮, সুরা সফ ৯, সুরা তাওবা ৩৩- এই তিনটি আয়াতে আল্লাহ পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন রসুলের দায়িত্ব কী। আল্লাহ রসুলকে হেদায়াহ ও সত্যদিন দিয়ে পাঠিয়েছেন এই জন্য যে, তিনি যেন অন্যসমস্ত দ্বীনের উপর এই দ্বীনকে বিজয়ী করেন, প্রতিষ্ঠা করেন।
আরবে চলছিল -মাইট ইজ রাইট, শক্তিমানের কথাই বিবেচিত হত ন্যায় হিসেবে। সেখানে বঞ্চিত জনগণের কোন অধিকার ছিল না, সেখানে সুবিধাভোগীরাই ছিলেন সমাজের হর্তাকর্তা, সেখানে ধর্মের নামে চলত অধর্ম, আল্লাহর নির্দেশনা ভুলে গিয়ে তারা নিজস্ব মনগড়া বিধান দিয়ে সমাজ পরিচালনা করত। এই অবস্থায় মানুষের না ছিল সামাজিক নিরাপত্তা, না ছিল ঘরে নিরাপত্তা, না ছিল বাহিরে নিরাপত্তা। সেই অবস্থা নিরসনকল্পে রসুলল্লাহ ন্যায়ের ঘোষণা দিলেন। যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের ঘোষণাই হল কলেমা তওহীদের মূল কথা। এক আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম চলবে না, তোমাদের কারো মত চলবে না, কারো মাতব্বরি চলবে না, কারো মনগড়া কথা চলবে না। যেটা ন্যায় সেটা ন্যায়, যেটা হক সেটা হক, যেটা সত্য সেটাই সত্য। আল্লাহ হলেন সেই ন্যায়ের ধারক। তার হুকুম চলবে। এই কথাটা বলার সাথে সাথে সমাজপতিরা দেখল- সর্বনাশ, আমাদের কায়েম করে রাখা এই সমাজ ব্যবস্থা তো থাকবে না, আমাদের ভোগ বিলাসিতা শেষ হবে, আমরা জনগণকে বোকা বানিয়ে রেখেছি এটা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই তারা রসুল (স.) কে প্রতিহত করা শুরু করে দিল। এটা ইতিহাস যে, কি অত্যাচার হয়েছিল খাব্বাব, বেলাল, সুমাইয়া, জায়েদের উপরে, তারা তৎকালিন আরব সামজের গোলাম দাস ছিলেন। আর সম্ভ্রান্ত বংশের আবু বক্কর (রা.), ওমর (রা.), উসমান (রা.) এর উপরেও অত্যাচার হয়েছে। মক্কাবাসীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করল, মদীনাবাসী গ্রহণ করল।
মদীনায় ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত হলো। মদীনা সনদের মাধ্যমে ইহুদি, পোত্তলিক, সবাইকে নিয়ে আল্লাহর রসুল একটি উম্মাহ বা জাতি গঠন করলেন। ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হলো। আল্লাহর রসুল ছিলেন ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। তারপর রসুল (সা.) একটি জাতি গঠন করলেন উম্মতে মোহাম্মদী। জাতিকে বারবার সতর্ক করে গেলেন ঐক্যবদ্ধ থাকবে। দেয়ালে সুঁইও প্রবেশ করার মত জায়গা রাখা যাবে না। মতভেদ করা যাবে না। মতভেদ করলে অনৈক্য সৃষ্টি হবে। অনৈক্য হলে দুর্বল হয়ে যাবে। এভাবে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। সাড়ে বার লক্ষ বর্গমাইল এলাকায় সত্যদ্বীন, ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা হল। কেমন শান্তি হয়েছিল তা ইতিহাস।
উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব পালন
এবার দায়িত্ব পড়ল আবু বকরের উপর। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। ভ- নবীদের আবির্ভাব হল, আবু বকর প্রতিরোধ করলেন। পৃথিবীময় সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বেরিয়ে পড়ল উম্মতে মোহাম্মদী। তারা স্ত্রী-পুত্র, সহায়-সম্বল বাড়ী ঘর ক্ষেত খামার সব কিছু কোরবান করে, পেছনে ফেলে রেখে বেরিয়ে পড়লেন দুনিয়ার বুকে। ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত অল্পকিছুৃ দিনের মধ্যে দুই দুইটি সুপারপাওয়ার রোমান সাম্রাজ্য আর পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করলেন। তৎকালীন বিশাল বিশাল বাহিনী তুলার মতো উড়ে গেল উম্মতে মোহাম্মদীর সামনে। উম্মতে মোহাম্মদী এতই গতিশীল ও বিস্ফোরণমুখী ছিল যে, তাদের সামনে দাঁড়াবার মত কোনো শক্তি তখন ছিল না। যাবতীয় অন্যায়কারী, অত্যাচারী শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে তারা ছুটে চলছিল ন্যায় ও সত্যের মশাল হাতে। তাদের ছিল না কোন শিয়া-সুন্নি-শাফেয়ী-হাম্বলী ফেরকা মাজহাবের দেয়াল, ছিল না তাফসিরের পাহাড়, ফেকাহর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। নবী নূরের তৈরি নাকি মাটির তৈরি, দোয়াল্লিন হবে না জোয়াল্লিন হবে- এ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলত না, আলোচনা উঠত না। এসব নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। উম্মাহ ছিল এক দেহ এক প্রাণ এক লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য নিয়ে উম্মাহ বিদ্যুৎ এর ন্যায় ছড়িয়ে পড়লেন পৃথিবীর বুকে। এ যেন এক সুনামি, এক প্লাবন আরব থেকে উৎপন্ন হয়ে পৃথিবীময় উপচিয়ে পড়ল। পৃথিবীর যাবতীয় অত্যাচার, যুলুম, রক্তপাত, অন্যায়, জালেমদেরকে বিনাশ করে দিয়ে রাসুলের সেই জাতি, তাঁর হাতে গড়া উম্মতে মোহাম্মদী ন্যায় প্রতিষ্ঠা করল। অর্ধদুনিয়ায় ইসলামের পতাকা উঠল। তখন পৃথিবীর কোনো শক্তি নাই এজাতির উপর চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলে। তখন তারা জ্ঞানে বিজ্ঞানে সামরিক শক্তিতে সাহিত্যে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে পৃথিবীর শীর্ষে। মুসলিমদের বাগদাদ, কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, বুশরা একেকটা তখন সামরিক গ্যারিসন। মুসলিমরা তখন বিশ্বের শিক্ষক। তারপর ঘটল মহাদুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি। জাতি তাদের লক্ষ্য ভুলে গেল, কি জন্য এই উম্মতে মোহম্মদী জাতি তৈরি করা হয়েছিল তারা ভুলে গেল। ফলে আল্লাহও তাদেরকে পরিত্যাগ করলেন।
খলিফা হয়ে গেল ভোগবিলাসের রাজা। যে খলিফারা গাছের নিচে ঘুমাতেন। নিজে আটার বস্তা মাথায় করে নিয়ে মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করতেন। যে খলিফা মানুষকে ন্যায় সাম্যের কথা শুনাতেন। সেই খলিফারা ভোগ বিলাসে মত্য হয়ে পড়ল। একেকজনের ভোগ-বিলাসিতার সীমা-পরিসীমা নাই। হেরেমের কোনো অভাব নেই। অন্যদিকে আলেম শ্রেণি, প-িত শ্রেণি, জ্ঞানি শ্রেণি দ্বীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে মাসলা মাসায়েলের পাহাড় গড়ে তুললেন। বিশ্লেষণ, পাল্টা বিশ্লেষণ, ফতোয়া, পাল্টা ফতোয়া সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ফতোয়া শুরু করলেন, এটার উপরে মতভেদ গড়ে তুললেন। তফসির হল, ফেকাহ হল। তারপর যখন সুফিবাদ শ্রেণি এলেন, জাতির সংগ্রামি চরিত্র বাদ দিয়ে তারা ঘরমুখি চরিত্র হয়ে গেল। যেই জাতির উত্থান করা হয়েছিল ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য সেই জাতি ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করে ঘরের দরজা বন্ধ করে তারা আত্মার ঘসামাজা করতে শুরু করল। তাদের বিরাট বিরাট সুফি মতবাদের বই নিয়ে গবেষণা শুরু করল। সাধারণ জনগণ এই সব মতভেদে বিভক্ত হয়ে গেল। ঘরসংসার করে জীবন পার করতে লাগল। উম্মাহ বসে পড়ল। তখনও আমেরিকা ইউরোপ জার্মানি ফ্রান্স রাশিয়া সেই বিস্তৃণ পূর্ব এশিয়া চায়না জাপান অষ্ট্রেলিয়াসহ বাকি দুনিয়া তখনও দীনের আওতার বাহিরে। কিন্তু তখন সেখানকার নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা উম্মতে মোহাম্মদীর ওপর দায়িত্ব ছিল কিন্তু তারা বসে পড়ল।
আল্লাহর শাস্তি:
আর তখনই জাতির ওপর আল্লাহর শাস্তি এসে পড়ল। ততদিনে বাগদাদের একেকটা মসজিদ সোনার গম্বুজ হল, সোনার দরজা হল। মসজিদের নববীর খেজুর পাতার ছাউনি বদলে সোনার মসজিদ হল। তারপর আমাদের বদাশাহদের শত শত হেরেম, শত শত স্ত্রী, বিশাল বিশাল তাদের বালাখানা গড়ে উঠল। আমাদের প-িতরা, আলেমরা সংগ্রাম ত্যাগ করে অধ্যক্ষ হলেন অধ্যাপক হলেন, একেকজন আলেম মাদ্রাসার অধ্যাপনা করছেন, খানকাতে তিনি তার তালিম দিচ্ছেন। এরপর ইতিহাসের শাস্তি এসে পড়ল। সমুদ্র পিষ্ঠ থেকে সেই ১২০০ মাইল উপর থেকে হালাকুরা এসে বাগদাদ লুণ্ঠন করল। মাথা কেটে খলিফাসুদ্ধ সবাইকে হত্যা করা হল। আলেমদের হত্যা করা হল। মাদ্রাসা মসজিদ সবকিছু বিনাস করা হল বই পুস্তক সব পুড়িয়ে দেয়া হল। কালি দিয়ে সমুদ্র কালো করে ফেলল। মুসলিমদের সব শেষ হয়ে গেল। কাটা মাথা দিয়ে পিরামিড বানানো হলো। সমুদ্রের পানি কালো হয়ে গেল। আমার প্রশ্ন হলো- এই হালাকু খান কেন বাগদাদে এলো, আমরা কেন হালাকু খানের দরজায় গেলাম না? এই শিক্ষা আল্লাহ রসুল আমাদেরকে দিয়ে গিয়েছিলেন যা জাতি ভুলে গিয়েছিল। আমরা তখন শিয়া সুন্নির হাম্বলির মধ্যে মতভেদে বিভক্ত হয়ে গেছি। মুসলিমরা তাদের দৃষ্টিশক্তি, তাদের আকিদা হারিয়ে ফেলল। পৃথিবীময় সত্য, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠার আকিদা তখন আমাদের ছিল না। তখন এ জাতিকে রক্ষা করার কেউ ছিল না। তারপর একশত বছরের মধ্যে দুয়েকজন উল্কার মত এ জাতির মধ্যে এসেছে। গাজি সালাউদ্দিন নুরুদ্দিন দুই চারজন এসেছেন উল্কার মতন কিন্তু জাতিকে রক্ষা করতে পারেন নি। চেষ্টা করেছিলেন তারা জাতিকে উদ্ধরের কিন্তু তারপরও তারা পারেন নি। তারপর চূড়ান্ত গজবের পালা এলো, সেই অন্ধকার যুগের ইউরোপিয়ানরা যারা ভূতপ্রেতের পূজা করত, সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান কিছুই যারা জানত না, সেই ইউরোপিয়ানরা আছড়ে পড়লে এই জাতির উপর। মুসলমানদেরকে পরাজিত করে তাদের পায়ের নিচে ফেলে দিল। তাদের গোলাম হয়ে গেল মুসলিমরা।
ব্রিটিশরা সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র করল যাতে এ জাতি যেন জীবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। তারা দু’মুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করল। একটা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা, আরেকটা মাদ্রাসা। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় জেহাদের আয়াত রাষ্ট্র পরিচালনরা আয়াত সিল করে রাখা হয়েছিল, এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল কোনোভাবে কেউ যেন পড়তে না পারে। তারপরে শেখানো হলো ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, এবাদত-উপাসনা আর মাসলা-মাসায়েল, কিন্তু জাতির ঐক্য গঠনের শিক্ষা শেখানো হয় নাই। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা দেয়া হয় নাই। আবদুস সাত্তার রচিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস’ নামক বিরল তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জনাব মোহাম্মদ ইয়াকুব শরীফ (তাং- শবে বরাত ১৪০০ হেজরি)। আমরা তার সেই মহামূল্যবান লেখা থেকে কিছু অংশ পাঠক-পাঠিকার জন্য তুলে ধরছি।
“এটি কোনো একটি প্রতিষ্ঠান বিশেষের ইতিহাস নয়, এটা মূলত তদানীন্তন সুবায়ে বাংলার আরবী শিক্ষা তথা গোটা মুসলমান জাতির শিক্ষা, মর্যাদা এবং আপন বৈশিষ্ট্য রক্ষার সংগ্রাম বিধৃত একটি করুণ আলেখ্য। আজ এই লেখাটি লিখতে স্বভাবতই মন কতগুলো বিশেষ কারণে আবেগ-আপ্লুত হয়ে ওঠে। আর তা হলো অতীতে প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অনৈক্য। মুসলমানরা ছিল বীরের জাতি, ইংরেজ বেনিয়ারা ছলে-বলে-কৌশলে তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাদের প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা, ও মর্যাদা হরণ করার জন্য পদে পদে যেসব ষড়যন্ত্র আরোপ করেছিল, আলিয়া মাদ্রাসা তারই একটি ফসল। বাহ্যত এই প্রতিষ্ঠানের পত্তন করা হয়েছিল আলাদা জাতি হিসাবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্ত, যাতে মুসলমাদের ধর্ম, কৃষ্টি ও আদর্শ রক্ষা পায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়াই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য।”
কী ধোকা? কোন ধোকা? মারটা কোন জায়গায় খেয়েছি তা আমাদেরকে জানতে হবে। এদিকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম সম্পর্কে একটা হীনম্মন্য ধারণা সৃষ্টি করে দেওয়া হলো। ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক আইডিয়া শিক্ষা দেওয়া হলো। সাধারণ ব্যবস্থায় ভলিয়ম ভলিয়ম বই শিখে যারা বেরিয়ে আসলো, তারা না পেল ধর্মজ্ঞান, না পেল দেশপ্রেম। আমার দেশের কৃষক-শ্রমিক মানুষের রক্ত পানি করা টাকা বিদেশে পাচার করে কারা? সাধারণ
কৃষক-শ্রমিকরা কিন্তু করে না। করে এই শ্রেণিটি।
সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় লক্ষ লক্ষ মানুষ শিক্ষিত হয়ে বের হয় ইসলাম ও রসুল (সা.) সম্পর্কে সীমাহীন বিদ্বেষ নিয়ে। তারা এই ধারণা নিয়ে বের হয় যে, ইসলাম ব্যাকডেটেড আর সাইন্স টেকনোলজি জ্ঞান বিজ্ঞান সব ইউরোপিয়ানদের আবিষ্কার। অথচ এর ভিত্তিপ্রস্তর মুসলিম জাতির বিজ্ঞানিরা স্থাপন করেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের গোড়াপত্তন হয়েছে মুসলিমদের হাতে। স্পেনের গ্রানডা, কর্ডোভা শহর ছিল তখন জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি। জ্যামিতি, আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান, আমাদের মহাকাশ বিজ্ঞান, আমাদের নৌবিদ্যা আমাদের সমস্ত বিদ্যার সেই ভলিউম ভলিউম বইগুলি লুট করে নিয়ে আজকের এই সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব ইতিহাস আমাদের বর্তমান সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত ছেলেরা জানে না। মুসলমানরা ছিল অজ্ঞ জাতি, মুসলমানরা অযৌক্তিক জাতি, বিজ্ঞানহীন জাতি, বিজ্ঞানমনষ্ক না, অন্ধজাতি, এই ধারণা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আমাদের সাধারণ শিক্ষিত লোকদেরকে। ব্রিটিশ রাজা-রাণীর ইতিহাস, সুদভিত্তিক অঙ্ক, যেই সুদ আল্লাহ মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারের তুলনা দিয়েছেন, সেই সুদভিত্তিক অঙ্ক আমাদেরকে শেখানো হয়েছে। এই সাধারণ শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসছে একটা গ্রুপ, মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে আসছে একটা গ্রুপ। দুই গ্রুপ এখন মুখোমুখি। মুসলিম জাতিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল পরিকল্পিতভাবে।
বলা হয় গণতন্ত্র, ‘‘সমাজতন্ত্র ইত্যাদি কুফরী শাসনব্যবস্থা, আব্রাহাম লিংকন, ম্যাকেয়াভেলি, কার্ল মার্কস এরা কাফের।’’ কিন্তু আমেরিকার জনগণ যখন নিষ্পেষিত হচ্ছিল, রাজা ও পোপের অত্যাচারে যখন ফ্রান্সের জনগণ নিষ্পেষিত হচ্ছিল, রাশিয়ার জনগণ যখন পশুর মত খাটা-খাটনি করেও অনাহারী থাকত, কোনো অধিকার ছিল না, চীনের জনগণ যখন মুক্তির নেশায় পাগল, তখন আমরা উম্মেতে মোহাম্মদীরা কোথায় ছিলাম? আমরা তখন কিতাব রচনা করেছি। কে কত বড় পীর হব সেই সাধনা করেছি। মুসাল্লা বিছিয়ে আকাশে উড়ার সাধনা করেছি। অন্যদিকে আমাদের সুলতানরা, কত জঘন্য ভোগ-বিলাসিতায় লিপ্ত ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। এদের ভোগ-বিলাসিতা দেখে সাদ্দাদ, ফেরাউনরাও বলবে- আল্লাহ তুমি আমাদেরকে পাপের কারণে শাস্তি দিয়েছো, কিন্তু এই রাজা-বাদশাহরা তো আমাদেরকেও ছাড়িয়ে গেছে। আমরা নিপীড়িত আমেরিকান, রাশিয়ান, ফরাসি ও চীনাদের পাশে দাঁড়াই নাই। দাঁড়িয়েছে কে? ঐ কার্ল মার্কস, ঐ আব্রাহাম লিংকন, ঐ রুশো, ঐ লেনিন, ঐ মাও সে তুঙ। তারা জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল- আমরা সবাই সমান, আমরা সবাই স্রষ্টার সৃষ্টি। কেউ খাবে কেউ খাবে না তা হবে না তা হবে না। মানুষের মুক্তির জন্য যারা দাঁড়ায় তাদেরকে নিপীড়িত মানুষ অবতার মনে করে। তাদেরকেও তাই মনে করা হলো। আর তাদের তৈরি তন্ত্র-মন্ত্রকে মানুষ মুক্তির পথ ভেবে সশ্রদ্ধচিত্তে আলিঙ্গন করে নিল। কই, তখন তোমরা উম্মতে মোহাম্মদীরা যাও নাই কেন? তোমরা গিয়ে বললে না কেন যে, ইসলাম আজ থেকে হাজার বছর আগেই দাসপ্রথাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে, ইসলাম মো’মেনের সম্মান দিয়েছে কাবারও ঊর্ধ্বে। আমরা অর্ধ উলঙ্গ বেলালকে ক্বাবার ঊর্ধ্বে উঠিয়ে হাজার বছর আগেই সাম্য ও মানবতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি তা তোমরা কল্পনাও করতে পার না। আল্লাহর রসুল দাস যায়েদকে পালকপুত্র করে নিয়েছেন, পরবর্তীতে তার তালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন। ইসলামের খলিফারা, অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তারা আটার বস্তা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে কোথাও কেউ ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে কিনা দেখার জন্য। দুর্ভিক্ষের সময় মানুষ খাদ্যাভাবে কষ্ট পাচ্ছে, খলিফা তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যতদিন দেশের মানুষ পেট পুরে খেতে না পাচ্ছে ততদিন আমি কেবল শুকনো রুটি খেয়ে থাকব। খলিফাকে রাষ্ট্রীয় কাজে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, সাথে একজন সহকারী, একটি উট। ইসলামের খলিফা, অর্ধপৃথিবীর সর্বসের্বা প্রতাপশালী শাসক অর্ধেক রাস্তা নিজে উটের পিঠে চড়ার পর বাকি পথ উটের লাগাম ধরে চললেন আর সহকারীকে উঠের পিঠে চড়িয়ে বসালেন। এই ছিল ইসলাম। এই আমাদের ধর্ম। আমরা ঐ জাতি। এই সাম্যের বাণী, এই মুক্তির বাণী নিয়ে তোমরা কেন গেলে না ঐ নির্যাতিত মানুষগুলোকে মুক্তি দিতে? ঘরে বসে থাকলে কেন? সুতরাং মানুষ আজ গণতন্ত্রকে, সমাজতন্ত্রকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে। আর ধর্মকে আখ্যা দিয়েছে আফিম। ধর্ম যখন বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান করতে পারল না, তখন সে ধর্মের কী দাম আছে? মানুষের পরনে যখন কাপড় থাকে না তখন তাদেরকে টাখনুর হাদীস শুনিয়ে কী লাভ? মানুষের পেটে যখন খাবার থাকে না তখন তাকে খাওয়ার আগের আর পরের সুন্নত শেখানো অর্থহীন। বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান যেহেতু সেদিন আমরা করতে পারি নাই, আমাদের জাতি যেহেতু মানুষের বিপদের মুহূর্তে এগিয়ে যায় নাই, কাজেই এখন মাথা গরম করে লাভ নেই। কাফের, মুরতাদ লম্ফঝম্ফ করে লাভ হবে না। একইভাবে আল্লাহ, রসুলকে গালি দিয়েছে বলে মাথা গরম করে চাপাতি নিয়ে ছুটে চলেছো, খবরদার! ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর, ভুল কোথায়। যা করবে ভেবে চিন্তে কর।