Connect with us

জাতীয়

চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৫২

Published

on

কয়েক দিনের টানা প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে ও পানিতে ডুবে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫২ জন। খবর চট্টগ্রাম অফিস ও সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের।

চট্টগ্রাম অফিস জানায়, গতকাল বুধবার পর্যন্ত কয়েক দিনের টানা বর্ষণের ফলে সৃষ্ট পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪-এ উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলাতেই ২৫ জনের লাশ উদ্ধারের কথা গতকাল নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম। একই উপজেলায় এখনো দুজন নিখোঁজ রয়েছে। নিহতদের মধ্যে চন্দনাইশে ৪ জন, রাউজানে ২ জন, বাঁশখালী, ফটিকছড়ি ও নগরীতে ১ জন। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হক চৌধুরী মায়া গতকাল রাঙ্গুনিয়ায় দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধার ও ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। মন্ত্রী এরপর রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

সর্বশেষ তথ্য মতে, রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড় ধসে ১৬ জন, পাহাড়ি পানির ঢলে ৬ জন, চন্দনাইশে পাহাড় ধসে ৪ জন, রাউজানে পাহাড়ি পানির তোড়ে ১ জন এবং আকস্মিক টর্নেডোয় বাঁশখালীতে ঘরের দেয়াল ধসে ১ জন, চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর হালিশহর ২৬নং ওয়ার্ডে ঘরের দেয়াল ধসে ১ জনসহ সর্বমোট ৩৪ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া, চন্দনাইশে দুইজন, উত্তর হালিশহরের ২৬নং ওয়ার্ডে দেয়াল ধসে পাঁচজন, বাঁশখালীতে দুইজনসহ মোট নয়জন আহত হয়েছেন এবং রাঙ্গুনিয়ায় নিখোঁজ চারজনের মধ্যে গতকাল আরো তিনজনের লাশ পাওয়া যায়।

এদিকে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির পরিবারকে নগদ ২০ হাজার টাকা এবং ত্রিশ কেজি করে চাল প্রদান করা হয়েছে। প্রত্যেক আহত ব্যক্তিকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে রাঙ্গুনিয়া ও রাউজান উপজেলার জন্য দশ টন করে ২০ টন, চন্দনাইশ উপজেলার অনুকূলে পাঁচ টন এবং লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলার অনুকূলে তিন টন করে ছয় টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।

রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্নস্থানে পাহাড় ধস এবং বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ জনে। নিখোঁজ রয়েছে ২ জন। আহত হয়েছে ৬২ জন। বন্যা কবলিত হয়েছে উপজেলার ৬ ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রাম। উপজেলার উত্তরাঞ্চলে রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম কাপ্তাই মহাসড়কের বিক্ষিপ্ত এলাকায় পানি উঠেছে। উপজেলার উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে উপজেলা সদরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যা কবলিত এলাকায় মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এখনও কোনো প্রকার সরকারি ত্রাণ সাহায্য পৌঁছানো হয়নি।

হোসনাবাদ ইউনিয়নের কানুরখীল গ্রামে বন্যার পানিতে ভেসে নিখোঁজ হওয়া স্বামী স্ত্রী মেয়ে ও অপর একজনের লাশ গতকাল গুমাই বিলে বন্যার পানিতে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। কানুরখীল গ্রামের সড়কে যাওয়ার সময়ে কন্যা তুষি দে (১২) পানিতে পড়ে গেলে তাকে বাঁচাতে পিতা আশীষ দে (৪৮) ও মা অন্জনা দে (৩০) পর পর ঝাঁপিয়ে পড়লে তারা বন্যার স্রোতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। এ সময় একই গ্রামের ডাক্তার দিলীপ দে (৫৫) বন্যার পানিতে ভেসে নিখোঁজ হয়।

ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, রাতে পাহাড় ধসে ও পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত তিনজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সেই সাথে ফটিকছড়ির এখনো ৬০ ভাগ এলাকা পানির নিচে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছে। এছাড়া উত্তর ফটিকছড়ির সাথে উপজেলা সদরের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ফটিকছড়ি-হেয়াকো সড়কের বেশ কিছু অংশ এখনো পানির নিচে থাকায় এবং বন্যায় উত্তর ফটিকছড়ির ফেনী-রামগড় সড়ক হেয়াকো এলাকায় ভেঙে যাওয়ায় উক্ত এলাকার মানুষ অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানান, রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড় ধসের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০৫ জনে দাঁড়িয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম খেকে বুধবার সন্ধ্যায় এ তথ্য জানানো হয়। বুধবার দ্বিতীয় দিনে উদ্ধার কর্মীরা ১০টি মৃত দেহ উদ্ধার করে। এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।

এর মধ্যে রাঙ্গামাটি শহরে ৪ সেনা সদস্যসহ ৫৮ জন, কাউখালী উপজেলায় ২৩ জন, কাপ্তাই উপজেলায় ১৮ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় ৪ জন ও বিলাইছড়ি উপজেলায় ২ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শিশু হচ্ছে ৩৩ জন, মহিলা ৩০ জন পুরুষ ৪২ জন। এর মধ্যে নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ২০ জন। আহত হয়েছে ৮২ জন। প্রাথমিক চিকিত্সা নিয়ে বেশ কয়েকজন চলে গেলেও ৩৯ জন রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।

এদিকে বুধবার সকালে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রাঙ্গামাটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এর আগে তিনি সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের জানান, রাঙ্গামাটি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন ও সহায়তায় সরকার সব রকম সহযোগিতা করবে।

তিনি ত্রাণ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে তাত্ক্ষণিকভাবে রাঙ্গামাটির দুর্গত মানুষের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা নগদ ১০০ মেট্রিক টন চাল, প্রত্যেককে ৫শত বান্ডিন টিন ও ৩ হাজার করে টাকা প্রদানের ঘোষণা দেন। তিনি রাঙ্গামাটির চট্টগ্রাম সড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনস্থাপনের জন্য এবং রাঙ্গামাটি শহরে বিদ্যুত্ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করতে যা কিছু করার দরকার দ্রুত সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।

এসময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহাবুবুল আলম হানিফ, আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক সুচিত্ কুমার নন্দী, সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক অসিম কুমার উকিল, চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার উপস্থিত ছিলেন।

পরে তারা রাঙ্গামাটি শহরের মানিকছড়ি, শিমুলতলী, ভেদভেদী এলাকায় পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।

দুপুরে রাঙ্গামাটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে আসেন ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে তিনি জেলা প্রশাসনে অনুষ্ঠিত সভায় যোগ দেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সব সকম সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

কাপ্তাই (রাঙ্গামাটি) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার ৩৩টি স্থানে ছোটবড় পাহাড় ধস হয় বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। পাহাড় ধসের ফলে ১৩ জুন নারী পুরুষ শিশুসহ ১৮ জন নিহত হয়। ইকবাল নামক ১ যুবক কর্ণফুলী নদীতে পানির তোড়ে ভেসে যায়। গত ৪৮ ঘণ্টায়ও তার লাশ পাওয়া যায়নি। এদিকে পাহাড় ধসের ফলে কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটি সড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় আকারের ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তার বিরাট অংশ ভেঙে কর্ণফুলী নদীতে পড়েছে। ফলে কাপ্তাইয়ের সাথে চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বান্দরবানে পাহাড় ধস ও বন্যা দুর্গত এলাকা গতকাল পরিদর্শন করেছেন সড়ক পরিবহন-সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি।

প্রশাসন জানায়, গত কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণে পাহাড় ধস ও বন্যায় দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে দুপুর আড়াইটায় হেলিকপ্টারযোগে রাঙ্গামাটি থেকে বান্দরবানে এসে পৌঁছান পরিবহন-সেতু মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি। পরে সড়কপথে মন্ত্রী শহরের কালাঘাটা আগাপাড়াসহ আশপাশের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন।

লামা (বান্দরবান) সংবাদদাতা জানান, বান্দরবানে পাহাড় ধসে নিহত পরিবারগুলোর মাঝে চলছে শোকের মাতম। পরিবারের সদস্য ও স্বজন হারানোর বেদনায় পরিবারের জীবিত সদস্যরা বাকরুদ্ধ। বান্দরবান জেলা শহরের লেমুঝিরি আগাপাড়া এলাকায় পাহাড় ধসে বসতঘরে মাটিতে চাঁপা পড়া মা ও মেয়ের লাশ বুধবার দুপুরে উদ্ধার করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম বর্মাছড়ি ইউনিয়নে পাহাড় ধসে এক নারীসহ ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত ১৩ জুন মঙ্গলবার টানা বর্ষণে বর্মাছড়ি এলাকায় পাহাড় ধসে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ খবর নিশ্চিত করেছেন। সাবেক লক্ষ্মীছড়ি ইউনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র চাকমা এ প্রতিনিধিকে বলেন, বর্মাছড়ি ইউনিয়নের ফুত্যাছড়া পাড়ার প্রাণকৃত্য চাকমার ছেলে পরিমল চাকমা (৩০) পাহাড় ধসে মাটি চাপায় মৃত্যু হয়। একই পরিবারের শিশু ও নারীসহ আরো ৭ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।

এদিকে বর্মাছড়ি ও কাউখালী সীমান্তে হলুদ্যা পাড়া বড়ইতলী এলাকার পুতুল্যা চাকমার স্ত্রী কালেন্দ্রী চাকমা (৪৫) মাটি চাপায় মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় পতুল্যা চাকমা আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এব্যাপারে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ ইকবাল পাহাড় ধসের ঘটনায় ২ জনের মৃত্যুর খবর শুনেছেন।

ইউপিডিএফের শোক

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানসহ বিভিন্নস্থানে পাহাড় ধসে শতাধিক লোকের প্রাণহানি ও শতশত আহত হওয়ার ঘটনাকে স্মরণকালের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় উল্লেখ করে গভীর শোক প্রকাশ করেছে। ইউপিডিএফ আজ বৃহস্পতিবার থেকে তিন পার্বত্য জেলায় তিন দিনব্যাপী শোক পালনের কর্মসূচি ঘোষণা দেন।

টেকনাফ (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড় ধসে পিতা ও শিশু কন্যা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বুধবার রাত ২টায় টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং মডেল ইউনিয়নের পশ্চিম সাতঘরিয়াপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পাহাড় ধসে নিহতরা হলেন— আমির হোসেনের পুত্র মো. সেলিম (৪২) এবং তার শিশু কন্যা কিশোমণি (৩)। এদিকে পাহাড় ধসে নিহত পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সংসদের পক্ষে নগদ নব্বই হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *