Connect with us

বিশেষ নিবন্ধ

জ্ঞান কি? আলেম কে?

Published

on

Hossain Mohammad Salimহোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
আল্লাহ বলেন, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একমাত্র জ্ঞানীরাই (ওলামা) আল্লাহকে ভয় করে (সুরা ফাতির ২৮)। আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ। নবীগণ দিনার বা দিরহামের উত্তরাধিকারী বানান না। তাঁরা কেবল ইলমের ওয়ারিশ বানান। অতএব যে তা গ্রহণ করে সে পূর্ণ অংশই পায়’ (তিরমিযী : ২৬৮২)।
এখানে আল্লাহর রসুল যে ওলামাদের কথা বলেছেন তারা কারা। এটা বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে আল্লাহ ‘জ্ঞান’ বোলতে কি বুঝেন? মুসা (আ.) একবার আল্লাহকে সাতটি প্রশ্ন করেছিলেন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল- আল্লাহ! আপনার বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানী কে? আল্লাহ বললেন- যে জ্ঞানার্জনে কখনো তৃপ্ত হয় না এবং মানুষের অর্জিত জ্ঞানকেও যে ব্যক্তি নিজের জ্ঞানের মধ্যে জমা করতে থাকে [হাদীসে কুদসী আবু হরায়রা (রা.) থেকে বায়হাকী ও ইবনে আসাকির; আল্লামা মুহাম্মদ মাদানী (র.) এর ‘হাদীসে কুদসী’ গ্রন্থের ৩৪৪ নং হাদীস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে আল্লাহ জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমটি তাঁর দেয়া জ্ঞান যা তিনি সৃষ্টির প্রথম থেকে তাঁর নবী-রসুলদের মাধ্যমে তাঁর কেতাবসমূহে মানবজাতিকে অর্পণ করে আসছেন, যার শেষ কেতাব বা বই হচ্ছে আল-কোরান। এটা হচ্ছে অর্পিত জ্ঞান। আর মানুষ পড়াশোনা, চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যে জ্ঞান অর্জন করে তা হল অর্জিত জ্ঞান। মুসার (আ.) প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ নির্দিষ্ট করে ‘মানুষের অর্জিত জ্ঞান’ বললেন, শব্দ ব্যবহার কোরলেন ‘আন্-নাসু’, মানুষ। অর্থাৎ যে আল্লাহর অর্পিত জ্ঞান, অর্থাৎ দীন সম্বন্ধে জ্ঞান, এবং মানুষের অর্জিত জ্ঞান এই উভয় প্রকার জ্ঞান অর্জন করতে থাকে এবং কখনোই তৃপ্ত হয় না অর্থাৎ মনে করে না যে তার জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণ হয়েছে, আর প্রয়োজন নেই, সেই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানী, আলেম। বর্তমানে যারা নিজেদের আলেম, অর্থাৎ জ্ঞানী মনে করেন, আল্লাহর দেয়া জ্ঞানীর সংজ্ঞায় তারা আলেম নন, কারণ শুধু দীনের জ্ঞানের বাইরে মানুষের অর্জিত জ্ঞানের সম্বন্ধে তাদের সামান্যতম জ্ঞানও নেই এবং সেই জ্ঞান সম্বন্ধে পিপাসাও নেই।
মনে রাখতে হবে, জ্ঞান একটি প্রাকৃতিক সম্পদের মতো মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ দান যা তিনি মানবজাতির কল্যাণার্থে দান করেন। এর কোনো ব্যক্তিমালিকানা থাকে না, যে কোনো জ্ঞানই গোটা মানবজাতির সম্পদ। তাই যারা জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখে তারা মানবতার শত্রু। যার জ্ঞান মানবতার কল্যাণে কাজে লাগে না, সেই জ্ঞান আখেরাতে তার কোনো কাজে আসবে না।
জ্ঞান একটি হাতিয়ার যা ভালো কাজেও ব্যবহার করা যায়, মন্দ কাজেও ব্যবহার করা যায়। যাদের জ্ঞান কেবল তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে বা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহৃত হয়, তা মানবজাতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনে। ইসলামের ধারণামতে আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির অস্তিত্ব নেই। অথচ আমাদের সমাজে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা একটি পুরোহিত বা মওলানা শ্রেণি আমরা দেখছি যারা কেবল কিছু শরিয়তি মাসলা মাসায়েল, দোয়া কালাম জেনে আরবি লেবাস ধারণ করে নিজেদেরকে ধর্মের কর্তৃপক্ষ বা ওলামা বলে দাবি করেন। তারা তাদের ধর্মীয় জ্ঞানকে (যদিও সেটা ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান নয়) বৃত্তি হিসাবে, পণ্য হিসাবে ব্যবহার করছেন। আল্লাহর মানদ-ে তারা আলেম নন। কারণ প্রকৃত আলেম তো নিজেদেরকে আলেম বলে মনেই করবেন না। আল্লাহ আলেমের যে মানদ- দিয়েছেন তাতে বলেছেন যে আলেমরাই একমাত্র আল্লাহকে ভয় করেন। আল্লাহকে ভয় করার অর্থ তারা আল্লাহর প্রদত্ত সীমারেখাকে জানবেন, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবেন এবং সেগুলোকে মান্য করবেন। তারা জীবন সম্পদের কোনো পরোয়া না করে সত্যের পক্ষ অবলম্বন করবেন, কারণ তারা আল্লাহর অসন্তোষকে ভয় করবেন। দীনের বিনিময়ে যারা সম্পদ ও স্বার্থ হাসিল করেন তারা জীবিকার স্বার্থে সমাজের হর্তা কর্তাদের হাজারো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে মেরুদ-হীন জীবনযাপন করেন। সুতরাং কোনো দিক দিয়েই তারা ইসলামের আলেম নন। তাদের দ্বারা মুসলিম জাতি মুক্তির দিশা পাবে না, কোনো কল্যাণকর জায়গায় গিয়ে পৌঁছতেও পারবে না।
তাদের চৌহদ্দি মসজিদের চার দেওয়াল আর মাদ্রাসা। কেউ মারা গেলে, দোকান উদ্বোধন, মুসলমানি, বিয়ে পড়ানোর জন্য তাদের ডাক পড়ে। আর আছে নামাজের ইমামতি। এবার দেখুন ইমামতির হাল। খ্রিষ্টানদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও জীবনব্যবস্থার ফলে আমাদের সমাজেও দুই ধরনের নেতা সৃষ্টি হয়েছে – ধর্মীয় নেতা এবং অ-ধর্মীয় নেতা। আজ মসজিদে যে নামায হয় তাতে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত কয়েকশ’ টাকার বেতনভোগী ‘ধর্মীয়’ ইমাম সাহেবের পেছনে তার তকবিরের (আদেশের) শব্দে ওঠ-বস করেন সমাজের ‘অধর্মীয়’ অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারা। নামাজ শেষ হলেই কিন্তু ঐ ‘অধর্মীয় নেতারা’ আর ‘ধর্মীয় নেতা’র দিকে চেয়েও দেখেন না। কারণ তারা জানেন যে ঐ ‘ধর্মীয়’ নেতার দাম কয়েকশ টাকা বেতনের বেশি কিছুই নয়, জাতীয় জীবনে তার কোন দাম নেই। ঐ ‘ধর্মীয় নেতারা’ অর্থাৎ ইমামরা যদি ‘অধর্মীয় নেতাদের’ সামনে কোন ধৃষ্টতা-বেয়াদবি করেন তবে তখনই তাদের নেতৃত্ব অর্থাৎ মসজিদের ইমামতির কাজ শেষ। খ্রিষ্টানদের পায়রবি কোরতে করতে এই জাতি এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে, ঐ খ্রিষ্টানদের পাদ্রীদেরও তাদের জাতির উপর যেটুকু সম্মান ও প্রভাব আছে, এই ‘ইমাম’দের তাও নেই।
আমরা চাই আমাদের ইমাম সাহেবরা যেন প্রকৃতপক্ষেই ইমাম (নেতা, Leader) হন, সমাজে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক, তাদের মেরুদ- সোজা হোক, শির উন্নত হোক, সমাজ তাদের আনুগত্য করুক। পরাশ্রয়ী মর্যাদাহীন জীবন থাকার চেয়ে জীবন না থাকা ভালো। এই উন্নত জীবন লাভ করার একটাই শর্ত, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সত্যের উপর দন্ডায়মান হতে হবে। লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *