Connect with us

খেলাধুলা

যেভাবে বদলে গেলো বাংলাদেশের পেস বোলিং

Published

on

স্পোর্টস ডেস্ক:
হাশিম আমলার স্বপ্নেও সম্ভবত দৃশ্যটা দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেবে। ক্রিকেট জীবনে ভালো-মন্দ অনেক কিছুরই মুখোমুখি তিনি হয়েছেন কিংবা হবেন। কিন্তু রুবেলের বলে যেভাবে তার স্ট্যাম্প শূন্যে ভাসল আর বার কয়েক গোত্তা খেয়ে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে আছড়ে পড়ল, সেটা সারা জীবনে তিনি ভুলবেন কি করে? আমলার জন্য দুঃস্বপ্ন হতে পারে, কিন্তু রুবেলের ওই ডেলিভারিটা যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের পেস অ্যাটাকের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন! কিংবা তৃতীয় ওয়ানডেতে যেভাবে কুইন্টন ডি কককে বোল্ড করে স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিলেন মুস্তাফিজুর রহমান, সেটাকেও তো বিজ্ঞাপনের একটি দৃশ্য কল্পনা করে নিতে পারেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের ঝুলিতে একজন ওয়াসিম আকরাম, একজন গ্লেন ম্যাকগ্রা কিংবা একজন কোর্টনি ওয়ালস নেই। অথবা হালের পেস সেনসেশন ডেল স্টেইন, মিচেল স্টার্ক কিংবা লাসিথ মালিঙ্গা নেই; কিন্তু যে দলটি তিলে তিলে বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থানকে পোক্ত করে নিচ্ছে, ক্রিকেটাকাশে নিজেদের সূর্য উদয়ের লগ্নে ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে যাদের হাত ধরে, তারাই যে এক সময় ইতিহাসে বিশ্ব কাঁপানো পেসারদের কাতারে ঠাঁই করে নেবে না, সেটাই বা এড়িয়ে যাবেন কিভাবে?
ভারতের বিপক্ষে মুস্তাফিজের প্রতিটি ডেলিভারিকে ধারাভাষ্যের মাইক্রোফোন হাতে কপিল দেব কিংবা ব্রায়ান লারারা ওয়াসিম আকরামের সঙ্গে তুলনা করে যাচ্ছিলেন। মাত্র ২০ বছর বয়সী এই পেসার সত্যিকারার্থেই ওয়াসিম আকরামের চেয়ে কম কিছু নন। ওয়াসিম ওভারের ছয়টি বলকে ছয়রকম ডেলিভারি দিতে পারতেন। মুস্তাফিজও ঠিক একইরকম। বরং, তার হাতে রয়েছে অফ কাটার, স্লোয়ারের মত মারাÍক সব অস্ত্র। ওয়াসিম আকরামেরও হয়তো ছিল, কিন্তু এসব অস্ত্রের সঠিক প্রয়োগ আজ পর্যন্ত আর কোন পেসার ঘটাতে পেরেছেন কি না সন্দেহ। আমলার স্ট্যাম্প উড়ে যাওয়াই প্রথম নয়, বাংলাদেশের পেস অ্যাটাক যে ধীরে ধীরে একটা বিশ্বমানের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, সেটা তো ভালো করে টের পেয়েছে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড কিংবা ভারতের মতো দলগুলো। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ যে দুটি ডেলিভারি রুবেল দিয়েছিলেন ব্রড আর অ্যান্ডারসনকে, সেটা তো স্বপ্নেই কল্পনা করা যায় শুধু। বিশ্বকাপ থেকে ফিরে মানিক মিয়া অ্যাভেনিউতে ক্রিকেটারদের সংবর্ধনা সভায় বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেছিলেন, ‘রুবেলের সেই দুটি ডেলিভারির কথা আমি সারা জীবনেও ভুলবো না।’ বাংলাদেশের পেস অ্যাটাকের পরিবর্তিত রূপ দেখে তো বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়েছিল ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির। বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই দেখলেন সর্বনাশ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের কাছে হেরে বসেছে ক্রিকেটের মোড়ল ভারত। বিশ্লেষণ করতে বসে গেলেন ধোনি-শাস্ত্রিরা। দেখলেন, বোলিংয়ে বাংলাদেশের অভাবনীয় পরিবর্তনই তাদের এই পরাজয়ের কারণ।
শুধু কি মহেন্দ্র সিং ধোনি! বাংলাদেশের ক্রিকেট বোদ্ধা থেকে বিশ্লেষক, সবারই মাত্রা ছাড়ানো অবাক হওয়ার জোগাড়। পরিসংখ্যান খুঁজতে বসে গিয়েছিলেন বিশারদরা। নাহ, এমন ঘটনা তো এর আগে আর কখনও ঘটেনি! একসাথে চারজন পেসার নিয়ে খেলতে নামার সাহস তো ভারতও জীবনে কখনও দেখাতে পাারেনি। সেখানে চার পেসার নিয়ে বাংলাদেশ!
অধিনায়ক মাশরাফি, রুবেল হোসেন, তাসকিন আহমেদ এবং মুস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চার পেসার নিয়ে খেলতে নেমে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিলেন মাশরাফি। অনেকেই নাক সিঁটকেছিল, মিরপুরের এমন ফ্ল্যাট উইকেটে চার পেসার!
কিন্তু চোখে আক্সগুল দিয়ে সমালোচকদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। রুবেল, তাসকিন আর মাশরাফিরা বরাবরের মতই ভয়ঙ্কর। পেস সহায়ক উইকেট নয়, তবুও গতির ঝড় তুলেছেন বাংলাদেশের পেস চতুষ্টয়। ডান হাতি-বাম হাতি পেস অ্যাটাকে দিশেহারা ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের ব্যাটিং লাইনআপ। সেটা এমনই যে, বাংলাদেশে আসার আগে স্কুল-কলেজ ছাত্রের মতো নিয়মিত অধ্যাবসায় করে আসতে হয়েছিল প্রোটিয়াদের। কিন্তু ফল! ভারত-পাকিস্তানের পরিণতিই বরণ করতে হলো তাদের!
নিজের পেস অ্যাটাক নিয়ে দারুণ উচ্ছসিত অধিনায়ক মাশরাফিও। ভারত সিরিজের সময়ও বলেছিলেন। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ চলাকালেই একবার বলেছিলেন, ‘ম্যাচ জেতায় বোলাররা।’ তামিম-সৌম্য-মাহমুদুল্লাহরা ব্যাট হাতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করছেন ঠিক; কিন্তু অধিনায়ক মাশরাফির চোখ দিয়ে দেখলে আপনি ঠিকই বুঝে যাবেন এর গুড় রহস্য। রুবেল-মুস্তাফিজরা কাজ সহজ করে দেয় বলেই চাপ নিয়ে খেলতে নামতে হয় না তামিম-সৌম্যদের এবং অনায়াস জয় পেয়ে যায় বাংলাদেশ। কিংবা তাদের মতো বোলার থাকার কারণেই চাপমুক্ত থেকে ব্যাট করতে পারছেন রিয়াদ-মুশফিকরা।
কোন যাদুকাঠির বলে এভাবে বদলে গেলো বাংলাদেশের পেস অ্যাটাক? খোঁজার জন্য যাওয়া হলো সাবেক পেসার এবং ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক হাসিবুল হোসেন শান্তর কাছে। জানতে চাওয়া হয়েছিল, আসলে এমন বদলে যাওয়ার পেছনে মূল রহস্যটা কি?
শান্ত মনে করেন, এই পরিবর্তনটা একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে অর্জিত হয়েছে। যার সমন্বিত রূপটাই দেখা যাচ্ছে এখন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বকাপের সময়টাই ধরুন। বাংলাদেশ টানা হারছিল। অনেকগুলো ম্যাচে জয়ের একেবারে দারপ্রান্তে গিয়েও হেরেছি। তবে পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকে। তখনও কিন্তু স্পিন নির্ভর বোলিং আক্রমণ আমাদের। পেস অ্যাটাক নির্ভর বোলিং আক্রমণের ধারণাটাই এসেছে মূলতঃ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির সময় থেকে।’ কোচ হাথুরুসিংহের কৃতিত্ব দিতেও ভুললেন না বাংলাদেশ দলের সাবেক এই পেসার। তিনি বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বাউন্সি উইকেটের কথা চিন্তা করেই মাশরাফি, রুবেল আর তাসকিনদের দিয়ে আলাদাভাবে নিয়মিত অনুশীলন চলেছে। রুবেল-তাসকিনরা বোলিং করেছেন মেটাল উইকেটে। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন তৈরী করা হয়েছিল। যেখানে বোলিং করে নিজেদের আরও পাকাপোক্ত করে তুলতে পেরেছেন মাশরাফিরা।’
বোলারদের এই অনুশীলনে শুধু যে বোলাররাই লাভবান হয়েছে, তা নয়। লাভ হয়েছে ব্যাটসম্যানদেরও। কারণ, এমন বাউন্সি উইকেটে, গতিময় পেসারদের কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে, তা প্রস্তুতিতেই রপ্ত করে ফেলেছে ব্যাটসম্যানরা। যার সফল বাস্তবায়ন বিশ্বকাপ থেকে এবং এর ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে বিশ্বকাপের পরও। শান্ত কিন্তু পেস বোলারদের এমন পরিবর্তনের জন্য পুরো কৃতিত্ব দিতে রাজি পেস বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিককে। তিনি মনে করেন, মাশরাফি-রুবেলদের সাফল্যের পেছনে পেস বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিকের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তার পরিকল্পনা এবং প্রশিক্ষণের ফলেই এতটা সফল পেস অ্যাটাক গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ দলে।
কোচরা যতই শেখাক কিংবা প্রশিক্ষণ দিক, মাঠে ব্যবহারের ওপরই পেস অ্যাটাকের সাফল্য নির্ভর করে সবচেয়ে বেশি। সেই দায়িত্বটা অসাধারণ দক্ষতায় পরিচালনা করছেন মাশরাফি। এ বিষয়ে শান্ত বলেন, ‘মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশের পেস ডিপার্টমেন্ট এখন অনেক শক্তিশালী। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে খেলতে পারলেও ইনজুরির কারণে ভারত ও প্রোটিয়া সিরিজে খেলতে পারেননি তাসকিন। তবে তার না থাকার ঘাটতিটা কোনোরকম বুঝতে দেয়নি মুস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশ দলটির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো, এই দলে বামহাতি ও ডানহাতি পেস অ্যাটাকে সমৃদ্ধ। যা সবচেয়ে বেশি দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষের কাছে।’
তবে, আশার মধ্যেও শঙ্কার কালো মেঘ জমে উঠছে শান্তর হৃদয়ে। পেস অ্যাটাকের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ চিন্তায় রয়েছেন তিনি। ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশ ভালো করলেও এখনও টেস্টে একমাত্র রুবেল ছাড়া ভালো বোলার নেই। মোহাম্মদ শহিদকে দিয়ে কতদিন চলবে, তার ঠিক নেই। মুস্তাফিজকে টেস্টে নেয়া হলেও, সে এখনও তরুণ। তার যতœ নেয়া খুবই প্রয়োজন। তাই এ দিকটা নিয়ে বিসিবিকে ভাবতে হবে। বিশেষ করে ইনজুরির সঙ্গে পেসারদের যে দারুণ একটা সখ্যতা রয়েছে! সুতরাং বিসিবির উচিত হবে, পেসার সংকট মোকাবেলায় পেস একাডেমী করা। যেখান থেকে ভালো মানের পেসার উঠে আসবে নিয়মিত।’
প্রত্যেকটি ক্রিকেট উন্নত দেশেরই পেস একাডেমী রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে নেই। যদিও বর্তমানে বিসিবির হাই পারপরম্যান্স ইউনিট পেসাদের নিয়ে কাজ করার একটা ভালো উদ্যেগ নিয়েছে। তবে এটা বছরে তিন থেকে চার মাসের বেশি না হওয়ায় বেশ খানিকটা হতাশ হাসিবুল হোসেন শান্ত, ‘শুনেছি বিসিবি হাই পারফরম্যান্স ইউনিটে পেসারদের নিয়ে কাজ করছে। তবে সেটা বছরে তিন থেকে চার মাসের বেশি না। বর্তমানে বাংলাদেশ দলে পর্যাপ্ত পারিমানে ব্যাকআপ ব্যাটসম্যান রয়েছে। সে অনুপাতে বাড়তি পেসার নেই বললে চলে। তাই অবশ্যই এদিকটা বিসিবিকে একটু ভেবে দেখতে হবে।’
বেশ কয়েকবার ইনজুরি থেকে ফিরে এসে মাশরাফি তার পেস বোলিংয়ের যোগ্যতা দিয়েছে। কিন্তু মাশরাফির অনুপস্থিতিতে পেস ডিপার্টমেন্টের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক বলে মনে করছেন জাতীয় দলের সাবেক এ ডানহাতি পেসার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাশরাফি তো এখন আর টেস্ট ম্যাচ খেলছে না। সে তো শুধু ওয়ানডে ম্যাচ খেলছে। সে যখন অবসরে চলে যাবে তখন পেস বোলিংয়ের অবস্থা খুব একটা ভালো থাকবে না। তাই এখন থেকে বিসিবিকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে।’
হাসিবুল হোসেন শান্ত মনে করেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টেও ভালো করবে মুস্তাফিজুর রহমান। তার যে যোগ্যতা রয়েছে। তবে তার মতে, মুস্তাফিজের মতো বিরল প্রতিভার সঠিক যতœ নিতে না পারলে খুব অল্প সময়েই হারিয়ে যেতে পারেন এই বিস্ময়কর পেস প্রতিভা।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *