Connect with us

ফিচার

মাও সে তুং

Published

on

Mao_89906934_177359c

মাও সেতুংকে বলা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা পিতা। দেশে সমাজতন্ত্রের সাম্য প্রতিষ্ঠায় তার অবদান চিরস্মরণীয়। এ কারণেই ৩৯ বছর আগে মারা গেলেও এখনো তিনি দেশের অগণিত মানুষের মনে জাজ্বল্যমান। মাও সেতুং এমন এক সত্তা, যা তার মৃত্যুকে ছাপিয়েও তার ব্যাপ্তিকে পৌঁছে দিয়েছে এক নতুন উচ্চতায়। যে সত্তা আজীবন বিপ্লবী, মানব মুক্তির সংগ্রামে যে সত্তা সদা জীবন্ত।

কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও নিজ প্রচেষ্টায় তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যানের শীর্ষ পদে পৌঁছাতে পেরেছিলেন এবং সফলভাবে গণচীনের রাষ্ট্রনায়ক হয়েছিলেন।

মাও সেতুং ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৯ সালে সমাজতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চীন শাসন করেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদে তার তাত্ত্বিক অবদান, সমর কৌশল এবং তার কমিউনিজমের নীতি এখন একত্রে মাওবাদ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধে জাপানি আক্রমণ প্রতিহত করতে সেকেন্ড ইউনাইটেড ফ্রন্টের নেতৃত্ব দেন মাও। চীনের গৃহযুদ্ধে কুমিনটাং দলের বিরুদ্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জয় ছিল মাওয়েরই অবদান।

মাওয়ের জন্ম ১৮৯৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর হুনান প্রদেশের শাওশানে এক গরিব কৃষক পরিবারে। ৮ বছর বয়সে গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শুরু। ১৩ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে পারিবারিক খামারে যোগ দেন। পরে অবশ্য মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। বারবার ইতিহাসের চাকা বদলে দিয়েছেন চৈনিক এই মানুষটি। তিনি শ্রমিকের বদলে কৃষককে চিহ্নিত করেছেন বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে, গড়ে তুলেছেন সশস্ত্র রেড আর্মি, প্রচলন করেছেন আরণ্যক গেরিলা যুদ্ধের।

অবাক সত্যি এই যে, মাও সেতুং এর রয়েছে সোনায় মোড়ানো মূর্তি। ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর এএফপি পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়, দ. চীনের গুয়াংডং প্রদেশের শেনঝেনে আপাদমস্তক সোনায় মোড়ানো মাও সেতুং মূর্তিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চীনের কিংবদন্তি নেতার এই মূর্তিটির মূল্য ১৬ লাখ মার্কিন ডলারেরও বেশি।

১৯১১ সালে হুনান প্রদেশের রাজধানী মাও চাঙশা-য় পড়তে চলে এলেন। ভর্তি হলেন হুনান টির্চাস কলেজে । এখানেই প্রথম পাশ্চাত্য দর্শন সম্বন্ধে জানতে পারেন। সে সময়টায় চিনে চলছিল কিঙ রাজতন্ত্রের দুঃশাসন। তার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদীদের তীব্র গনআন্দোলন হচ্ছিল। সান ইয়াত সেন ছিলেন জাতীয়তাবাদীদের নেতা। তিনি রাজতন্ত্র ভেঙ্গে গঠন করতে চান প্রজাতন্ত্র। তার ডাকে মাও উদ্ধুদ্ধ হলেন। যোগ দিলেন প্রজাতন্ত্রের সৈন্যবিভাগে।

১৯১৮ তে হুনান টির্চাস কলেজে থেকে পাস করে চাকরির খোঁজে বেইজিং পৌঁছলেন মাও। কাজ জুটল। বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। এখানেই জানলেন মাকর্সবাদকে, মাকর্সবাদের তত্ত্বকে ।

১৯১৯ সাল। তখন চীনকে আধুনিকায়ন করার লক্ষে চীনের বুদ্ধিজীবিদের তরফ থেকে একটি আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনে মাও যোগ দিলেন। ১৯২০ সালে চাঙশায় ফিরে এলেন মাও। হুনান প্রদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য উদ্যোগী হলেন । ব্যর্থ হলেন। ১৯২১ সালে সাঙহাই এলেন। সে সময় চিনের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হচ্ছিল ওখানে। সেই গোপন মিটিং-এ উপস্থিত হলেন মাও। তারপর হুনান ফিরে এসে হুনানে কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক শাখা খুললেন। কী ভাবে ধর্মঘট করতে হয়- শ্রমিকদের তাই শেখালেন।

১৯২৫ সালে জন্মগ্রাম শাওশানে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন মাও। ১৯২৭ সালে কৃষক আন্দোলন নিয়ে লিখলেন। ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিলেন। কেননা মাও লিখলেন যে, বিপ্লবে কৃষকরাই মূল চালিকা শক্তি, শ্রমিকরা নয়। মার্কসবাদবিরোধী বক্তব্য। কাজেই নিজের দলে হইচই পড়ে গেল। ফলে জাতীয়তাবাদী ‘কুমিনটাং’ দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কুমিনটাং দলের নেতা চিয়াং কাই সেক প্রবল কমিউনিষ্টবিরোধী দমননীতি অনুসরন করলেন। সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিয়ে আরেকবার ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিলেন মাও। হুনান প্রদেশের কৃষকদের নিয়ে সৈন্যবাহিনী গঠন করলেন মাও। অবশ্য পরাজিত হলেন।

দক্ষিণে পার্বত্য এলাকায় সরে এলেন। জায়গাটার নাম জিয়াংজি প্রদেশ। এখানে তিনি গ্রামীন ভূমি সংস্কারে উদ্যোগী হলেন। ওদিকে অসংখ্য তরুণরা দলে দলে মাও নিয়ন্ত্রিত কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগ দিচ্ছিল। মাও তাদের সংগঠিত করেন। ইতিহাসে এই সশস্ত্র দলটি রেড আর্মি। এদের লক্ষ একটাই-কৃষকের মুক্তি। আর সে লক্ষ অর্জনে অভিনব গেরিলা যুদ্ধের পথ অনুসরণ করে আরেকবার ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিলেন মাও।

১৯৩৪ সালে চিয়াং কাই সেক জিয়াংজি প্রদেশ ঘিরে ফেলল।এক বিস্ময়কর ও অপ্রতিরোধ্য গতিবেগে সে বেড়াজাল ছিন্ন করে রেড আর্মিকে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন মাও। এরপর তিনি আরম্ভ করলেন এক দীর্ঘ পদযাত্রা। যা ইতিহাসে লং মার্চ হিসেবে পরিচিত। রেড আর্মির সঙ্গে ৬ হাজার মাইল দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে উত্তরের ইয়ানান প্রদেশ পৌঁছে গেলেন মাও।
হাঁটতে হাঁটতে অগনন কৃষকের সমর্থন পেলেন মাও; পেলেন অগনন কৃষানীর ভালোবাসা ।

মৃত্যুর পরও মাও সেতুং চীনাদের জীবনজুড়ে কতখানি মিশে আছেন এর উজ্জ্বল উদাহরণ হেনান প্রদেশের ‘নানজিকুন’ গ্রাম। ওই গ্রামে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরোটা সময় দীপ্যমান থাকেন মাও সেতুং।

বিবিসি অনলাইনের তথ্য অনুযায়ী : রোদ-বৃষ্টি যা-ই থাকুক না কেন, প্রতিদিন সকাল সোয়া ছয়টায় চীনের সাবেক নেতা মাও সেতুংয়ের স্তবগান বাজে। সবার কাছে মাওয়ের সে গুণগান পৌঁছাতে রাস্তার প্রতিটি বাতির খুঁটিতে লাগানো হয়েছে লাউড স্পিকার। নানজিকুনে গেলে মনে হবে, হয় সেখানে মাও সেতুংয়ের সময়টা থমকে আছে অথবা গ্রামটা সেই ফেলে আসা সময়ে চলে গেছে।

মাওয়ের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি শাসকেরা রাষ্ট্রের মালিকানাধীনে নেওয়া এখানকার জমি গত শতকের আশির দশকে কৃষকদের কাছে ফিরিয়ে দেন। তবে কৃষকেরা জমিগুলো গ্রাম কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়ে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে সবার অংশীদারত্ব আছে।

এ ব্যবস্থায় চাষাবাদ করায় গ্রামবাসী উপকৃত হয়েছে, দ্বন্দ্ব-দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পেয়েছে। সমষ্টিগতভাবে গ্রামের সবারই অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এক সময়ের বস্তি ঘরগুলোর জায়গায় হয়েছে আধুনিক ভবন। গ্রামের বিরাট প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সেসব দেখছে মাও সেতুং, লেনিন ও স্তালিনের বড় ভাস্কর্যগুলো। চারদিকে ঝুলছে লাল ব্যানার।

বাইরের বিনিয়োগে এখানে গড়ে ওঠেছে নুডলস, বিয়ার আর ওষুধ তৈরির কারখানা। স্থানীয় লোকজনের খবরের তৃষ্ণা মেটাতে আছে একটি পত্রিকা অফিস। বিনোদনের জন্য রয়েছে একটি বেতারকেন্দ্র, সেখান থেকে প্রতিদিন সকালে মাও সেতুংয়ের গান প্রচার হয়। টেলিভিশন স্টেশনটি জনপ্রিয় অনেক অনুষ্ঠান প্রচার করে। নানজিকুনে ব্যক্তিগত গাড়ি নেই বললেই চলে। আছে কিছু ইলেকট্রিক স্কুটার আর তিন চাকার ট্রাক।

এখানকার মানুষের মূল বেতন খুবই কম, মাসে মাত্র ৩২ ডলারের মতো। তবে সামাজিকভাবে দলবদ্ধ এসব মানুষ বিনা ভাড়ায় ভবনগুলোতে থাকেন। খাদ্যপণ্য, শিক্ষাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। ঝকঝকে পরিপাটি বাসায় সুন্দরভাবে টাঙানো ছবি, ফ্ল্যাট স্ক্রিন টেলিভিশন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ফোন সব মিলিয়ে যেন মাওয়ের স্বপ্নের সুখী সংঘের বাসিন্দা নানজিকুনের বাসিন্দারা।

বাংলাদেশেরপত্র/এডি/আর

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *