Connect with us

ফিচার

স্কোয়াড্রন লিডার শাফায়াত সরোয়ার, যে বীরের মৃত্যু নেই 

Published

on

IMG_0005জিয়া হাবীব আহ্‌সান: শাফায়াত সরোয়ার, ডাক নাম কিশোর । ছোটবেলা থেকেই যে সাহসী কিশোর আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখতো বৈমানিক হিসাবে পেশাগত স্বীকৃতি পেয়ে সেই কিশোরকেই উড়ন্ত হেলিকাপ্টারেই জীবন দিতো হলো । ২৭ মে ২০১৫ পত্রিকার শিরোনামে মর্মান্তিক সংবাদটি চোখে পড়লো – “চলেই গেলেন স্কোয়াড্রন লিডার শাফায়াত”। প্রতিবেদক লিখেছেন, “চট্টগ্রাম শাহ্‌ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধবস্ত বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারের আহত পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার শাফায়াত সরোয়ার আর নেই । গত সোমবার ৮টা ৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল হাসপাতালে তিনি মারা যান । চট্টগ্রামে বিমান বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন । এদিকে শাফায়েতের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন । তিনি নিহতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান, গত ১৩ মে সকাল ১১ টায় শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়ের পাশেই বিমান বাহিনীর এম আই -১৭ মডেলের হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয় । হেলিকপ্টারটি নিয়ে বিমান বাহিনীর পাইলট প্রশিক্ষক স্কোয়াড্রন লিডার শাফায়াত ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার সার্জেন্ট ফেরদৌস বিমান বাহিনীর পাইলট অফিসার ফুয়াদকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন । দুর্ঘটনায় হেলিকপ্টারটিতে আগুন ধরে যায় । এই সময় প্রশিক্ষনার্থী পাইলট অফিসার ফুয়াদ হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ থেকে বেরিয়ে এলেও স্কোয়াড্রন লিডার শাফায়াত এবং সার্জেন্ট ফেরদৌসকে উদ্ধার কর্মীরা গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন । স্কোয়াড্রন লিডার শাফায়াতকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয় । ওখানে অবস্থার অবনতি ঘটলে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয় । সেখানে সোমবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি” ।

বাবা বিশিষ্ট ব্যাংকার ও মা আদর্শ শিক্ষিকা । পেশাগত কারণে তার বাবার সাথে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় ব্যাংকের মামলা মোকাদ্দমা পরিচালনা ও আইনগত অভিমত ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করতেই সন্তানের কথা মনে পড়লে চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তাঁর । উনি বললেন, ভাইয়্যা পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী জিনিস কি ? আমি বললাম জানি না । তিনি বললেন “পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ” । আজ বড় দুঃ খ ভরাক্রান্ত হৃদয়ে এ-প্রতিভাবান কিশোরকে নিয়ে দু’টি কথা পাঠকদের সামনে উৎসর্গ করবো ।

স্কোয়াড্রন লিডার মোঃ শাফায়াত সরোয়ার (কিশোর), সরওয়ার মোঃ শহীদ উল্লাহ্‌ এবং শর্মিন আকতার দম্পত্তির কনিষ্ঠ পুত্র । তিনি ২১ শে নভেম্বর ১৯৮৫ সাল, রাত ১১,২১ মিনিটে চট্টগ্রাম শহরে জন্ম গ্রহণ করেন । তাঁর বাবা সরওয়ার মোঃ শহীদ উল্লাহ্‌ বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিঃ এর খাতুনগঞ্জ শাখার শাখা ব্যবস্থাপক (ভাইস প্রেসিডেন্ট), মা শর্মিন আকতার ডাঃ খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষিকা । বড়ভাই মোঃ রুবায়াৎ সরোয়ার আইবিএ এর বিবিএ সহ এমবিএ, তিনি পেশায় একজন বিজনেস কন্সালল্টেন্ট । তিনি innovision Consulting LTD এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর । তাঁর পৈতৃক বাড়ি আনোয়ারা থানার বৈরাগ গ্রামে । তাঁর দাদা প্রয়াত সালামত উল্লাহ্‌ তদানিন্তন পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট ফার্নিচার ব্যবসাহী ছিলেন । ফার্নিচার ব্যবসায়ের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি আজও স্মরণীয় । তাঁর নানার বাড়ি পতেঙ্গা থানার কাটগড়ে । নানা প্রয়াত নজরুল ইসলাম পতেঙ্গার ২য় গ্র্যাজুয়েট । তিনি যমুনা অয়েল কোম্পানির একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন । গুনীব্যক্তি হিসাবে তিনি সমাজে সমাদৃত ছিলেন । কিশোর মা- বাবার দুই পুত্র সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ সন্তান । মা-বাবা আদরের শাফায়ত সরোয়ার ২০০২ সালে চট্টগ্রাম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে এস এস সি এবং চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে ২০০৪ সালে সালে কৃতিত্বের সাথে এইচ এস সি পাশ করেন ।

শাফায়াত সরোয়ার এর শৈশব কাটে পার্সিভ্যাল হিলে অত্যন্ত দুরন্তপনার মধ্য দিয়ে । শৈশব থেকেই অসীম সাহসের অধিকারী । ভয় শব্দটি তাঁর ছিল অজানা । ঝুঁকি পূর্ণ খেলাতেই আনন্দ পেতো সে বেশী । এক ছাদ থেকে লাফিয়ে আরেক ছাদে যাওয়া, দেয়াল থেকে লাফ দেওয়া ইত্যাদি ছিল নৈমিত্তিক কাজ । যা পরবর্তীতে কাজে লেগেছিল । কৈশোর কেটেছে প্যারেড মাঠে ক্রিকেট খেলে । প্রচণ্ড ক্রিকেট অনুরাগী ছিল । স্কুলের হয়ে খেলেছে বহুবার । জেলার হয়ে অনুর্ধ ১৭ ও খেলেছে । হয়ত ক্রিকেটীয় হওয়ার বিকল্প স্বপ্ন ছিল । তবে মুল স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার । স্বপ্নটা দেখিয়েছিলেন ছিলেন তাঁর বাবা । কৈশোর থেকে চলছিলো সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি ।

কিন্তু ২০০৪ সালে এইচ এস সি পাশ করার পরে হঠাৎ করে ঘুরে যায় তাঁর স্বপ্নের মোড় । শুরু হয় নতুন করে স্বপ্ন দেখা । শুরু হয় শাফায়াতের বৈমানিক হয়ে উঠার গল্প । বিমান বাহিনীতে যোগ দিতে হলে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করতে হয় । প্রতিটি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে আকাশে উড়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০০৫ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একাডেমীতে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেন এবং সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে দু বছরের প্রশিক্ষণ শেষে ১৩ জুন ২০০৭ সালে ৫৫ নং ফ্লাইট ক্যাডেট কোর্সে জেলারেল ডিউটিস পাইলট শাখায় কমিশন্ড লাভ করেন এবং ২০০৮ সালে ব্যাচেলার অব সাইন্স (Aeronautics) ডিগ্রী অর্জন । কমিশন্ড প্রাপ্তির পর নিয়মিত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পেশাগত জীবনেও সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখেন । তিনি দেশের উল্লেখযোগ্য পেশাগত প্রশিক্ষণ সহ বিভিন্ন উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন এবং এম আই সিরিজ হেলিকপ্টারের পাইলট ইন কমান্ড এর যোগ্যতা অর্জন করেন এবং মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি স্কোয়াড্রন লিডার পদে উন্নীত হন ফলশ্রুতিতে তিনি ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ২০১১-১২ এবং ২০১৩-১৪ সালে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক কঙ্গো ও দক্ষিন সুদানে দক্ষতার সাথে মিশন শেষ করেন । পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক অপারেশন সমূহ তিনি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করেন । সামরিক দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন কঠোর । চ্যালেঞ্জ গ্রহনে কখনো পিচ পা হতেন না এবং মৃত্যু ভয়ে কখনো শঙ্কিতও হতেন না । তাই তাঁর ডায়রীর পাতায় লিখতে পেরেছিলেন “মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত নই । যদি মারা যাই তবে মারা যাব সম্মানের সাথে” পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তাঁর উপস্থিতি ছিল সরব । তিনি একজন দক্ষ গিটার বাদক ছিলেন এবং গান ও ভালো গাইতেন । যার ফল স্বরূপ দেশে ও বিদেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রোগ্রাম অনির্বাণে দুইবার গান গেয়েছেন ।

এছাড়াও বিভিন্ন খেলাধুলা শারীরিক কর্মকাণ্ডে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন । তাঁর শখের মধ্যে অন্যতম ছিল বিদেশ ভ্রমন । সুযোগ পেলেই বিদেশ ভ্রমনে বের হতেন । ইতিমধ্যে ভ্রমন করেছেন ইউরোপের ১০ টি দেশ সহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশ । বন্ধু বৎসল হিসাবে শাফায়াত স্বল্পভাষী হলেও, ছোট বড় সবার সাথে মিশতে পারতেন এবং সবার সাথে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতেন । পরিবারের প্রতি তিনি ছিলেন অসম্ভব দায়িত্বশীল এবং মা, বাবা ও বড় ভাইয়ের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল । ২০১৪ সালে তিনি জনাব নাজিম উদ্দিন, ডেপুটি ডাইরেক্টর, মিনিস্ট্রি অব ফিনান্স(ইআরডি) ও মাহমুদা নাজিম দম্পতির একমাত্র কন্যা ডাঃ উপমা রাইসা নাজিমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । দেশ মাতৃকার সেবায় নিয়োজিত এই বৈমানিক গত ১৩ মে, ২০১৫ তারিখে নিয়মিত দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হন । জরুরীভাবে আহত অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঐ দিনই সিঙ্গাপুর নেওয়া হয় । দীর্ঘ ১২ দিন চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত ২৫ মে ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ সময় ০৮,০৫ ঘটিকায় সাহসী ও বীর বৈমানিক শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে তার প্রিয়তমা স্ত্রী, মা-বাবা, ভাইসহ অগণিত বন্ধু ও স্বজনদের রেখে না ফেরার দেশে চলে যান(ইন্নালিল্লাহে-রাজেউন)। মৃত্যুকালে মা ও বড় ভাই সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তার সহ্যা পাশে ছিলেন । তাঁর অকাল মৃত্যুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন বাহিনীর প্রধান গভীর শোক প্রকাশ করেন । ২৬/০৫/২০১৫ ইং তারিখ ১১,০০ টায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স এর বিমানে তাঁর মরদেহ ঢাকায় আনা হয় । ২৭/০৫/১০১৫ ইং তারিখ সকালে হেলিকপ্টার যোগে তাঁর মরদেহ চট্টগ্রাম আনা হয় এবং সকাল ৯.৩০ টায় প্যারেড গ্রাউন্ডে তার প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পুনরায় তাঁর মরদেহ হেলিকপ্টারে যোগে ঢাকায় নেওয়া হয় । ঢাকায় বাশার বেইস এ গার্ড অব অনার সহ তাঁর দ্বিতীয় নামাজে জানাযা শেষে মহাখালিস্থ শাহীন কবরস্থানে (বিমান বাহিনীর নিজস্ব কবরস্থান) তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় ।

স্কোয়াড্রন লিডার মোঃ শাফায়াত সরোয়ার এর এই বীরত্বের জন্য গত ১২/০৮/২০১৫ তারিখে বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল আবু ইশরার, বিবিপি, এনডিসি, এসিএসসি চীফ অব এয়ার স্টাফ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁর মা, বাবার হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন । যেখানে লিখা আছে, “We Served the Nation Together. Squadron leader Md. Shafayet Sarwar was a Hero. He will remain in our heart forever. Heroes Never Die”

চট্টগ্রামের এ কৃতী সন্তানের মৃত্যু নেই, সে বেঁচে থাকবে ততদিন যতদিন আমাদের বৈমানিকেরা দেশমাতৃকার আকাশ মুক্ত রাখার সংকল্পে দৃপ্তমান থাকবে । শাফায়াত দেশের জন্য তাঁর সম্ভাবনাময় জীবনকে উৎসর্গ করলো, অন্যদের জন্য তাঁর এ ত্যাগ পথিকৃৎ হয়ে থাকলো, তাঁর এ মহামূল্যবান ত্যাগ ও স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য “চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সড়কটির নাম তাঁর নামে অর্থাৎ ‘স্কোয়াড্রন লিডার সাফায়াত সরোয়ার সড়ক’ নামে নামকরণের জন্য চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে সদাশয় সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি । ”

লেখকঃ আইনজীবী , কলামিস্ট , মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী ।
bhrfctg@gmail.com

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *