ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতায় আবদ্ধ না থেকে অপরের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে-এমাম, হেযবুত তওহীদ
নিজস্ব প্রতিবেদক: আজকে ধার্মিকরা মনে করে নামাজ পড়ব, রোজা রাখব, হজ্ব করব, কোর’আন পড়ব, ব্যস জান্নাতে চলে যাব। আর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, সমাজ কীভাবে চলছে, রাষ্ট্র কীভাবে চলছে, বিশ্ব কীভাবে চলছে সেসব নিয়ে চিন্তা নেই। যেন আল্লাহ মানুষকে কেবল নামাজ-রোজা করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আমি বলতে চাই, চোখ-কান বুঁজে থেকে ব্যক্তিগত আমল করে জান্নাতে যাবার আশা করছেন যারা তারা অনেক বড় বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন। মানুষ কখনো এমন স্বার্থপরের মতো জীবনযাপন করতে পারে না। তাকে সমাজ, সভ্যতা, বিশ্ব নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর হাজারীবাগ পার্ক মাঠে ‘’বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা এবং সন্ত্রাস দমনে জনসম্পৃক্ততার বিকল্প নেই’’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান আলোচকের বক্তব্যে হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম এসবকথা বলেন। তিনি তার বক্তব্যে দেশ ও জাতির বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। তার ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো –
মানুষকে পাঁচটি বিষয়ে ভাবতে হবে
মানুষের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আল্লাহ অন্য কাউকে প্রদান করেন নি। ওই বৈশিষ্ট্য বা গুণগুলোর কারণে মানুষের মর্যাদা অনন্য। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলিফা হিসেবে। তিনি তাঁর নিজের রূহ থেকে মানুষকে ফুঁকে দিয়েছেন। তারপর আদমকে সেজদা করার মাধ্যমে মালায়েকদের নিযুক্ত করেছেন মানুষের সেবায়, মানুষের কল্যাণে। এই যে অনন্য মর্যাদা ও ক্ষমতা আল্লাহ মানুষকে দান করলেন সেটা লাভ লাভ করার পরও মানুষ যদি কেবল পশুর মত আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর জীবনযাপন করে তাহলে তার চেয়ে নিকৃষ্ট কিছু আর হতে পারে না। আমরা যদি নিজেদেরকে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে চাই তাহলে আমাদেরকে ভাবতে হবে পাঁচটি বিষয়ে। নিজেকে নিয়ে, পরিবার নিয়ে, সমাজ নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে ও বিশ্ব নিয়ে। আমাদেরকে ভাবতে হবে- আমি কে? আমি কোথা থেকে এলাম? কোথায় যাব? পৃথিবীতে আমার কাজ কী? দায়ীত্ব কী? আমার জীবনের সার্থকতা কীসে?
ব্যক্তিগত এবাদতে মুক্তি নেই
আজকে ধার্মিকরা মনে করে নামাজ পড়ব, রোজা রাখব, হজ্ব করব, কোর’আন পড়ব, ব্যস জান্নাতে চলে যাব। আর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, সমাজ কীভাবে চলছে, রাষ্ট্র কীভাবে চলছে, বিশ্ব কীভাবে চলছে সেসব নিয়ে চিন্তা নেই। যেন আল্লাহ মানুষকে কেবল নামাজ-রোজা করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আমি বলতে চাই, চোখ-কান বুঁজে থেকে ব্যক্তিগত আমল করে জান্নাতে যাবার আশা করছেন যারা তারা অনেক বড় বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন। মানুষ কখনো এমন স্বার্থপরের মতো জীবনযাপন করতে পারে না। তাকে সমাজ, সভ্যতা, বিশ্ব নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। আমরা যদি না ভাবি, আগে থেকেই সচেতন না হই তাহলে এমন সময় আসবে যখন আমাদের কারও পায়ের নিচে মাটি থাকবে না। আমাদের বেঁচে থাকাই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। যদি মানুষই না বাঁচে, তাহলে কে যাবে মসজিদে? কে যাবে মাদ্রাসায়? মানুষের ইতিহাসে আজকের মত এত বড় বিপদ আর কখনো আসে নি। ১৬,০০০ পারমাণবিক বোমা তৈরি করে রাখা হয়েছে মানুষ মারার জন্য। আজ হোক কাল হোক ওগুলোর ব্যবহার হবে। লিবিয়া-সিরিয়ার দিকে তাকান, সেই সাথে আমাদের দেশ যে হুমকির মুখে রয়েছে তার কথা ভাবুন। লক্ষণ দেখলে বোঝা যায় বাতাস কোন দিকে। আমাদেরকে নিজেদের বাঁচার জন্য ও অন্যকে বাঁচানোর জন্য এখনই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতায় আবদ্ধ না থেকে অপরের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
ইসলামে সন্ত্রাস নেই
আজকে ইসলামকে সন্ত্রাসের সাথে একীভূত করে দেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অভিযোগ করা হয় ইসলাম নাকি জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছে। আমরা হেযবুত তওহীদ এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। ইসলামে সন্ত্রাস নেই। আল্লাহর রসুল কোনোখানে সন্ত্রাস করেন নি, তিনি যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ আর সন্ত্রাস এক কথা নয়। আমরা একাত্তরে যুদ্ধ করেই আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করেছি, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি।
জঙ্গিবাদের উদ্গাতা কারা?
জঙ্গিবাদের সূচনা করেছে কারা তা সচেতন মানুষমাত্রই জানেন। কারা এর স্রষ্টা, কারা এর ইন্ধনদাতা ও কারা এর লাভের ফসল ঘরে তোলে তা এখন পরিষ্কার। এই জঙ্গিবাদের সৃষ্টি করেছে পশ্চিমা পরাশক্তিধর দেশগুলো। আফগান যুদ্ধের সময় আমেরিকা মুসলমানদেরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদের সূচনা ঘটায়। তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ঈমানদার মুসলিম জনসাধারণকে উদ্দীপ্ত করে আফগানিস্তানের ভূমিতে নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করানো হয়। তাদেরকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয় আমেরিকা ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা। পরবর্তীতে এই জঙ্গিবাদকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়ে অস্ত্রব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো। আফগানের ওই যুদ্ধ মোটেও জেহাদ ছিল না। সেটা ছিল আমেরিকা-রাশিয়ার স্বার্থের দ্বন্দ্ব। আর সেই দ্বন্দ্বের খেসারত দিতে হয়েছে আফগানিস্তানকে। ওখান থেকে জঙ্গিবাদকে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটাও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা করেছে যা তাদের জমজমাট অস্ত্রব্যবসার বাজার তৈরির জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। আজ সেই সাম্রাজ্যবাদীরাই তাদের নিজেদের তৈরি করা জঙ্গিবাদকে ইসলামের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। আমরা যদি এখনও সজাগ না হই, সচেতন না হই, সাম্রাজ্যবাদীদের এইসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ না হই তাহলে তারা কখনোই এ ধরনের অপপ্রচার বন্ধ করবে না। তারা সফল হয়ে যাবে। আর ইসলামকে মানুষ ঘৃণা করবে সন্ত্রাসী ধর্ম অভিযোগ দিয়ে।
বাংলাদেশ কি সিরিয়ার ভাগ্যবরণ করবে?
আমাদের সরকার বারবার বলছে- বাংলাদেশকে নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে। এত বড় দুঃসংবাদ, এত বড় আতঙ্কজনক খবর শুনেও মানুষ কীভাবে নির্বিকার থাকতে পারে আমার বুঝে আসে না। মানুষ কেন সিরিয়ার দিকে তাকায় না? কেন ইরাকের দিকে তাকায় না? কেন লিবিয়ার দিকে তাকায় না? সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে দেশগুলোর লাখ লাখ মানুষের রক্ত ঝরেছে। উদ্বাস্তু হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। লাখো মসজিদ-মাদ্রাসা মাটির সাথে মিশে গেছে। আকাশ থেকে টনকে টন বোমা পড়েছে। ওই বোমা দেখেনি কে নামাজী কে বেনামাজী, কে লেবাসধারী, কে লেবাসহীন, কে আস্তিক কে নাস্তিক, কে সৎ কে অসৎ, কে মুসলিম কে অমুসলিম, কে ধনী কে দরিদ্র, কে মাদ্রাসার ছাত্র কে জেনারেল শিক্ষিত, কে মসজিদের সভাপতি কে মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। সিরিয়ার মানুষ এখন ঘাস খাচ্ছে। আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হবার দাবিদাররা ঘাস-লতা-পাতা খেয়ে বেঁচে আছে! মরেছে মানুষ, বিধ্বস্ত হয়েছে মানুষের বসতি, অনিশ্চিত হয়েছে মানুষের ভবিষ্যত। এর জন্য কে দায়ী? আল্লাহ দায়ী নয়। দায়ী মানুষ নিজেই। এ পরিণতি তাদের দু’হাতের কামাই।
মনে রাখতে হবে সিরিয়া-ইরাক-লিবিয়ার পরিস্থিতি রাতারাতি এমন হয় নি। যখন এই সঙ্কট শুরু হলো মানুষ ভাবলো এটা রাজনৈতিক সঙ্কট। সরকার ও সরকারের বিরোধিরা এর মীমাংসা করুক, আমাদের কিছু করার নেই। তারা টিভি দেখেছে, খবরের কাগজ পড়েছে। তারপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। রাষ্ট্রের অশনিসঙ্কেত অনুধাবন করে নি। ঐক্যবদ্ধ হয় নি। সকালে ঘুম থেকে জেগে কেউ চাকরিতে গেছে, কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেছে, কেউ ফসল ফলাতে গেছে, কেউ উপাসনালয়ে ঢুকেছে। কিন্তু যখন সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত সফল হলো তখন আর কেউ রক্ষা পেল না। সিরিয়া, ইরাকের সাথে আমাদের সম্পর্ক কোথায় তা ভাবতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তের টার্গেটে পরিণত হবার পরও যদি আমরা সিরিয়াবাসী, লিবিয়াবাসী ও ইরাকিদের মত নিশ্চিন্তে হাত গুটিয়ে বসে থাকি তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন আমাদের মাথার উপর উড়বে জঙ্গিবিমান, আকাশ থেকে বোমাবৃষ্টি বর্ষিত হবে, ঘর হারিয়ে রাস্তায়-পথে-প্রান্তরে ঘুরতে হবে, আমাদের সন্তান ভেসে যাবে অকুল সাগরে। বুঝতে হবে এ কেবল রাজনৈতিক সঙ্কট নয়, এ সঙ্কট আমাদের বাঁচা-মরার সঙ্কট। বাঁচতে হলে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে।
ধর্মবিশ্বাসকে হাইজ্যাক করা হয়েছে
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠির অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে আমরা একটি ভূখণ্ড পেয়েছি। কিন্তু পরবর্তী ৪৪ বছর এ জাতিটিকে আর ঐক্যবদ্ধ থাকতে দেয়া হয় নি। এ জন্য দায়ী প্রধানত বৈদেশিক ষড়যন্ত্র আর অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় ও রাজনীতিক বিভক্তি। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মতবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রাজনীতিক দলগুলো এ জাতিটিকে বহুভাগে ভাগ করে ফেলল। আর ধর্মীয়ভাবে জাতির মধ্যে মাজহাব ফেরকার বিভক্তি আগে থেকেই ছিল, উপরন্তু বিভিন্ন ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ধর্মচেতনাকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে রাজনীতিক, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে শুরু করল।
ধর্মব্যবসায়ী ও স্বার্থপর রাজনীতিকদের স্বার্থের দ্বন্দ্বের ফলে জাতি আজ সার্বিকভাবেই অনৈক্য, সংঘাত ও হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে আছে। অর্থাৎ একদিকে পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার ষড়যন্ত্র, অপসংস্কৃতির প্রসার, রাজনীতিক দলগুলোর অন্যায়, অপরদিকে ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়াবাজি, ধর্মের অপব্যবহার, দাঙ্গা, বিদ্বেষ। এইসব অপশক্তি না থাকলেই আমরা প্রিয় জন্মভূমির ষোলো কোটি মানুষ একটা শক্তিশালী জাতিসত্তা গঠন করতে পারতাম।
আকীদা-ঈমান-আমল
সত্যনিষ্ঠ আলেমরা একমত ছিলেন আকিদা সহিহ না হলে ঈমানের কোনো মূল্য নেই আর ঈমান না থাকলে আমল অর্থহীন। সেই মহামূল্যবান আকিদা যদি জনগণকে শিক্ষা দেওয়া না হয় তবে ঈমান ভুল পথে প্রবাহিত হবেই। ঈমানের মূল বিষয় হলো কলেমা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম ছাড়া অন্য কিছু না মানা এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা আর আকিদা হলো কোনো বিষয় সম্পর্কে সঠিক ও সম্যক ধারণা। আর আমল হলো সালাহ (নামাজ), যাকাত, হজ্ব, সওম (রোজা) ইত্যাদি এক কথায় সেই সমস্ত কাজ যা মানুষের কল্যাণ করে, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে তা সবই আমল। কিন্তু নিজের জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা না করলে কারও আমলই কবুল হবে না। আজ পৃথিবীজোড়া আমল হচ্ছে কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে সঠিক আকিদা না থাকার কারণে ইমান ও আমল সবই অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে।
রসুলের আগমনের উদ্দেশ্য:
আল্লাহর রসুল পৃথিবীতে এসেছিলেন সমস্ত পৃথিবীকে সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা ও রহমত দান করার জন্য। এজন্য তাঁর উপাধি ‘রহমাতাল্লিল আলামিন’, অর্থাৎ সারা পৃথিবীর রহমত। আল্লাহর রসুল আগমনের পূর্বেও মক্কার মুশরিকরা নামাজ-রোজা করত, ক্বাবা তাওয়াফ করত, তারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা-পালনকর্তা বলে বিশ্বাস করতো। তবু তাদের মধ্যে আল্লাহকে রসুল পাঠাতে হয়েছিল কারণ তাদের সমাজ ছিল অন্যায়, অবিচার, অনাচার, রক্তপাত, হানাহানি, অনৈক্যে পরিপূর্ণ। সেখানে মানবতা ছিল না। ঐক্য ছিল না। মানুষগুলো ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাই আল্লাহর রসুল আসলেন সত্যের আলো নিয়ে। ওই হানাহানিতে লিপ্ত জাতিকে শেখালেন ঐক্য, শৃঙ্খলা, মানবতা, ভ্রাতৃত্ব। ফলে যে জাতি কিছুদিন পূর্বেও ছিল চরম বর্বর, অসভ্য একটি জাতি তারাই এমন মানুষের পরিণত হলো পৃথিবীর ইতিহাসে যারা অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আমরা এখন তাদের নাম উচ্চারণ করলে বলি ‘রাদিআল্লাহু আনহুম ওয়ারাদু আনহু’।
কথা ছিল মুসলমানরা রসুলের প্রতিনিধি হিসেবে সমস্ত পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা মুসলমান নামধারী এই জাতিটিই এখন সমস্ত পৃথিবীতে সর্বাধিক অশান্তি ভোগ করছি। শত শত ফেরকা-মাজহাবে বিভক্ত হয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করছি। শিয়া হত্যা করছে সুন্নিকে, সুন্নি হত্যা করছে শিয়াকে। তারপর শিয়ারাও নামাজ পড়ছে, সুন্নিরাও নামাজ পড়ছে। তারা উভয়েই মনে করছে কেবল তারাই জান্নাতে যাবে। কিন্তু আমি বলে রাখি- তারা কেউই জান্নাতে যাবে না। জান্নাতে যাবে মু’মিনরা। মু’মিন কখনো তার ভাইয়ের রক্তে হাত রাঙাতে পারে না। আদতে প্রকৃত ইসলাম যেমন শিয়াদের কাছে নেই, তেমন সুন্নিদের কাছেও নেই। আজ থেকে অনেক আগেই পৃথিবী থেকে প্রকৃত ইসলাম হারিয়ে গেছে।
স্বার্থপরের নামাজ নাই, সমাজ নাই, জান্নাত নাই:
একটা বিষয় আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, ধর্ম কেবল নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণ করতে শেখায়। স্বার্থপরতা ধর্মের শিক্ষার অন্তরায়। স্বার্থপর মানুষ কখনোই ধার্মিক হতে পারে না। স্বার্থপরের নামাজ নেই, স্বার্থপরের সমাজ নেই, স্বার্থপরের জান্নাত নেই। আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর ব্যক্তি কখনও মু’মিন-মুসলিম হতে পারে না। কারণ পবিত্র কোর’আনের সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে মু’মিন হবার শর্ত হিসেবে জীবন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করে দিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং সমাজ তথা মানবজাতির শান্তির লক্ষ্যে নিজেদের জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে প্রচেষ্টা না করলে কারও কোনো আমলই কবুল হবে না, তারা জান্নাতেও যেতে পারবে না।
ঈমানী দায়িত্ব ও সামাজিক কর্তব্য:
আজকে দেশ ও জাতি যে সঙ্কটে পতিত হয়েছে এ সঙ্কট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে আমাদের সকলকে উদ্যোগী হতে হবে, আমাদেরকে ইসপাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ এটি একদিকে আমাদের ঈমানী দায়িত্ব অপরদিকে আমাদের সামাজিক কর্তব্য। আমরা যারা ধর্মে বিশ্বাস করি তাদেরকে বুঝতে হবে মানুষের শান্তির জন্য কাজ করাই হলো প্রধান ইবাদত, কাজেই মানুষ যখন কষ্টে থাকে, সমাজ যখন অন্যায়-অবিচারে পূর্ণ হয়ে যায় তখন প্রধান ঈমানী দায়িত্বই হয়ে পড়ে মানুষের কষ্ট দূর করা ও সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূর করা। অপরদিকে যারা ধর্মে বিশ্বাসী না তাদের উদ্দেশ্যে বলব- এই সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেকের সামাজিক কর্তব্য হলো সমাজের শান্তি নিশ্চিত করা। সমাজ ধ্বংস হয়ে গেলে আমরা কেউই বাঁচব না, আমাদের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।
মাদ্রাসাশিক্ষার ইতিহাস:
আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না আল্লাহ রসুলের সেই প্রকৃত ইসলাম বিকৃত হতে হতে যখন এমন একটি পর্যায় আসল যখন এই জাতি শিয়া সুন্নী ইত্যাদি হাজারো ফেরকা তরিকায় তারা বিভক্ত হয়ে গেল। আল্লাহ শাস্তিস্বরূপ ব্রিটিশ খ্রিষ্টানরে পদানত করে দিলেন এই জাতিকে। ব্রিটিশরা এমন একটি ব্যবস্থা করল যাতে এই জাতি আর কখনো তাদের পায়ের নিচে থেকে উঠে দাঁড়াতে না পারে। তারা ১৪৬ বছর ধরে তাদের তৈরি করা একটি বিকৃত ইসলাম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা দেওয়া হলো। সেখানে মানবতার কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করার শিক্ষা দেওয়া হয় নি, সেখানে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের মাসলা মাসায়েল ও তা নিয়ে তর্ক বিতর্ক। এই বিকৃত ইসলাম শিখে ধর্মব্যবসায়ী জনগোষ্ঠী তা সমগ্র জাতিকে ওয়াজ খোতবার মাধ্যমে এই জাতির মনে মগজে কায়েম করে দিয়েছে।
মসজিদ-মন্দির উপসনাকারী দ্বারা পূর্ণ কিন্তু সমাজ অন্যায়-অবিচারে পূর্ণ:
যে কোনো বাস্তব সমস্যার সমাধানও বাস্তবমুখী হতে হবে। আমাদের সমাজের প্রতিটি অন্যায়, অশান্তি বাস্তব সমস্যা। এগুলোর সমাধান করার কোনো পথ ধর্ম দেখাতে পারছে না। আলেম সাহেবরা ধর্মকে যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছেন সেখানে সকল সমস্যার একটাই সমাধান যে, নামাজ পড়ো, রোজা রাখো, দাড়ি রাখো, খাওয়ার আগে পরে লবণ আর মিষ্টি খাও, জোব্বা আর চেক রুমাল পরিধান করো। এগুলো হচ্ছে কাল্পনিক সমাধান। এই অযৌক্তিক ধ্যান ধারণাকে ধর্ম মনে করেই চিন্তাশীল মানুষেরা দিন দিন ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু ধর্ম তো এটা নয়। ধর্মকে এই ক্ষুদ্র বিকৃত গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিল কে? সেটা হচ্ছে ব্রিটিশদের তৈরি করা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা।
জনতার উদ্দেশে আহ্বান-
আজকের এই অনুষ্ঠানে অনেক জনসমাগম হয়েছে। আপনারা কে কেন এসেছেন, আপনাদের মনের ভেতরে কী আছে তা আল্লাহ জানেন। তবে আপনাদের কাছে আমার করজোড়ে নিবেদন যে, আপনারা ঐক্যবদ্ধ হোন। এখান থেকে অন্তত এই শিক্ষাটি নিয়ে যান যে, আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা কত জরুরি। মুক্তির পথ আমারও জানা ছিল না। আল্লাহর রহমে এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর সান্নিধ্যে এসে আমি জেনেছি কেন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যের গুরুত্ব কী, ঐক্য কেন বাধ্যতামূলক। তাঁর কাছে থেকেই আমি উপলব্ধি করেছি আল্লাহর রসুল কেন ঐক্য ভঙ্গকারীকে কাফের বলেছিলেন। কেন বারবার সতর্ক করে গেছেন মতভেদ না করতে, ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত না করতে। সকলের প্রতি আহ্বান- আপনারা আমাদের জন্য, মানবতার কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ হেযবুত তওহীদের সদস্য-সদস্যাদের জন্য দোয়া করবেন। আমরা যে সত্যের জ্ঞান লাভ করেছি, যে মুক্তির দিশা লাভ করেছি, আমরা যেন আমৃত্যু তাতে দৃঢ় থাকতে পারি। আমরা যেন কখনও পথ না হারাই। আমরা যেন প্রকৃত মু’মিন হতে পারি, সেই সাথে খাঁটি দেশপ্রেমিক হতে পারি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে হাসতে হাসতে প্রাণত্যাগ করতে পারি।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা:
পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি- হে আল্লাহ, পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা- দাজ্জাল আজ সমস্ত পৃথিবীকে অশান্তির অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করেছে। এই অশান্তি থেকে তুমি মানবজাতিকে রক্ষা করো। আমাদেরকে যেন সিরিয়া-ইরাকের মতো ভাগ্যবরণ করতে না হয়। হে আল্লাহ, আমরা স্বার্থপর হয়েছি, আমরা তোমার হুকুম অমান্য করেছি, মহাপাপ করেছি, তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করো, আমাদের উপর রহম করো। আমাদেরকে অপরের কল্যাণে কাজ করার তওফিক দান করো, সত্যের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার তওফিক দান করো।