নড়াইলে অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন গরীবের ডাক্তার কল্পনা
উজ্জ্বল রায়, নড়াইল: কেউ ডাকেন ডাক্তার আপা, কেউ বৌদি, কেউ দিদি, আবার কেউবা মাসি। একটি এলাকার নারীদের জীবন চলার সঙ্গী এ মানুষটি। তাঁকে ছাড়া যেন অস্বস্তি গৃহিনীদের। মা ও শিশু স্বাস্থ্যের পরিচর্যা এবং পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সেবা দেন তিনি। সবার আপনজন হয়ে উঠেছেন। জানা যায়, যেন আত্মার আত্মীয়। এ মানুষটির নাম কল্পনা রানী সরকার। সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের ‘পরিবার কল্যাণ সহকারী’ হিসেবে কর্মরত। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার লাহুড়িয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড তাঁর কর্মস্থল। গত ৩৯ বছর ধরে এখানেই চাকরি করছেন। শ্বশুর বাড়ি এ ওয়ার্ডেই। আগামী ২৬ জানুয়রিতে অবসরে যাবেন। এ কাজপাগল মানুষটিকে ছাড়া যেমন এলাকার মানুষের চলে না। তেমনই পরিবার পরিকল্পনা বিভাগও দিয়েছে তাঁকে ভালো কাজের স্বীকৃতি। ১১ বার হয়েছেন উপজেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্মী। জেলায় শ্রেষ্ঠ হয়েছেন দুই বার। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মহাপরিচালক বেশ কয়েকবার তাঁকে সনদ দিয়েছেন। সনদগুলো এ রকম: ‘আপনি পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের একজন অগ্রসৈনিক। আপনার এলাকায় মা ও শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বাস্তবায়নে আপনি পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং অনুকরণযোগ্য।’ ২০০২ সালের অক্টোবরের এক শুক্রবারের বিকেল। বাচ্চাদের পোলিও টিকা খাওয়াতে হবে। তাই বাড়ি বাড়ি খবর দিচ্ছিলিন টিকা কেন্দ্রে আসার জন্য। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। পা পিছলে পড়ে গিয়ে ডান হাতের কবজি ভেঙে যায়। কিন্তু হাতটি আর ভালো হয়নি। এখন ডান হাতটি অকেজো। লিখেন দুই হাতের সাহায্যে। সমস্যা হয় খাবার খেতে এবং নিজের অন্যান্য কাজে। কিন্তু দমে যাননি। এ অবস্থায় ঘরে বসে থাকেননি। এরপরও তার উপস্থিতি এলাকার ঘরে ঘরে। এ অবস্থায়ও জেলার এবং উপজেলার শ্রেষ্ঠ কর্মী হয়েছেন। লাহুড়িয়া ইউনিয়নের কচুবাড়িয়া, ছাইমনারচর, পশ্চিমপাড়া, হিন্দুপাড়া ও মোল্লাপাড়াÑএই পাঁচটি এলাকা নিয়ে তাঁর কাজ। এখানে বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। সক্ষম দম্পতি ৯০৮ জন। এলাকার নারীরা জানালেন, মেয়েলি রোগের সব কথা নিজের আপনজনকেও বলা যায় না। লজ্জা লাগে। ডাক্তার আপাই তাঁদের ভরসা। তাই দুই-একদিন তাঁকে না দেখলেই অস্বস্ততিতে ভোগেন নারীরা। ওই এলাকার গৃহিনী দিপালী বেগম, কনক বেগম ও লাভলী জানালেন, গর্ভাবস্থায় এবং শিশুর যত্ন নিতে এলাকার নারীরা তাঁর ওপরই ভরসা করেন। তাঁর পরামর্শে সবাই লাভবান হয়েছেন। তিনি নিজের মায়ের মত পাশে থাকেন। অনেক পরিবারের স্বামী ও অন্য সদস্যদের অবহেলা সহ্য না করে নিজেই গর্ভবতীকে নিয়ে ছোটেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। উপজেলা বা জেলা শহরের হাসপাতালে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সেখানে পরিবারের সদস্যরা সঙ্গে নেই। বাচ্চা প্রসব করিয়েছেন নিজ দায়িত্বে। কল্পনা রানী বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় গর্ভবতীর পেটে বাচ্চার অবস্থান ভালো নেই। অশিক্ষিত পরিবার। কবিরাজি বা ঝাঁড়-ফুঁকে নজর তাঁদের। এ অবস্থায় আল্ট্রাসোনগ্রাম করানো ও অন্যান্য চিকিৎসা এবং সিজারিয়ান অপারেশন না করালে মা ও শিশু মুত্যু মুখে পতিত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। এ অবস্থায় নিজে দায়িত্ব নেই। পরে সবাই খুশি হয়। লাহুড়িয়া ইউনিয়র পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম নজরুল ইসলাম বললেন, কল্পনা রানী এলাকায় ‘গরীবের ডাক্তার আপা’ বলে পরিচিত। চাকরি নয় সেবাই তাঁর ধর্ম। কল্পনা বলছিলেন, চাকরি জীবনের প্রথম দিকে ৭০-৮০ এর দশকে পরিবার পরিকল্পনার কর্মী শুনে অনেক বাড়িতেই ঢুকতে দেয়নি। না জায়েজ কাজ বলে তাড়িয়েছে। দমে যায়নি। এলাকার শিক্ষক ও সচেতন মানুষের সাহায্য নিয়ে সেসব পরিবারে সফল হয়েছি। এখনের পরিবেশ এমন মনে হয়, সবার যেন অভিভাবক হয়ে গেছি। এসএসসি পাস
কল্পনা রানী ১৯৭৪ সালে বেকার স্বামীকে বিয়ে করেছিলেন। অর্থাভাবে বাধ্য হয়ে দুই বছর পর তাঁকে এ চাকরি নিতে হয়েছিলো। তিন ছেলে তাঁর। সবাই বিয়ে করেছেন। সকলেই ব্যবসায়ী। স্বামী ও সংসারের অন্যদের নিয়ে এখন সচ্ছল পরিবার। এখন তাঁর ভাঙা হাতটিতে ব্যাথা, উচ্চরক্তচাপ ও হাটুতে ব্যাথা। কিন্তু বুঝা যায় না। সেবায় রত সর্বক্ষণ। তিনি বললেন, এলাকার পরিবারগুলোর খোঁজ রাখতে না পারলে সুখ পাই না। মনে হয়, অজ্ঞতার কারণে যদি কোনো মা ও শিশু মৃত্যু মুখে পতিত হয় ! লোহাগড়া উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ প্লাবনের মতে, উপজেলা সদরের শেষপ্রান্তে (২০ কিলোমিটার দূরে) প্রত্যন্ত গ্রামের একটি এলাকার সাধারণ মানুষের সুচিকিৎসার পরামর্শে অন্যতম ভরসাস্থল হয়ে উঠেছেন কল্পনা রানী।