Connect with us

বিশেষ নিবন্ধ

এখন কী করবে সরকার?

Published

on

Jongi Hamla In Gulshan Cafe _এখন কী করবে সরকার

রিয়াদুল হাসান


সরকার দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশে আই.এস-এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী বার বার বলেছেন, ‘আমাদের উপর বৈদেশিক চাপ আছে আই.এস-এর অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়ার জন্য।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আর আইজিপি-সাহেবও বারবার বলেছেন, কিছু হোমগ্রোন জঙ্গি আছে। তাদের সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল, তারা তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়, তারা ঈড়হঃৎড়ষষবফ।
ঠিক আছে। ধরে নিলাম বিদেশি জঙ্গি আমাদের দেশে নেই, কিন্তু এদেশের যারা জঙ্গিবাদী তারাই এদেশে আইএস-এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কারণ আদর্শ তো একই। বাস্তবে আমরা সেটাই দেখছি। সরকার যতই অস্বীকার করুক, এ পর্যন্ত আস্তিক, নাস্তিক, ধর্মবিদ্বেষী, সমকামী, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিয়া, হেযবুত তওহীদ, বিদেশি নাগরিক সব মিলিয়ে ৪৮ জনের মতো দীর্ঘ একটি তালিকা তৈরি হয়েছে যেগুলোর মোটিভ জঙ্গিবাদের দিকেই ইঙ্গিত করে।
আইএস তাদের মুখপত্র দাবিক পত্রিকার মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ভারত আক্রমণ করতে চায় এবং সেজন্য বাংলাদেশকে তারা ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করবে। এদেশের সরকারকে তারা শত্রু মনে করে এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে ন্যায়সঙ্গত জেহাদ মনে করে। এ সমস্ত কিছুই সরকার নাকোচ করে দিয়েছে, উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু গতকালের ঘটনাটি আমাদের দেশে মানুষকে একটি বড় ধরনের নাড়া দিয়ে গেছে, আমাদের সরকারের চিন্তাধারাতেও হয়তো নতুন মাত্রা (Nwe dimention) যোগ করেছে। এটা সুস্পষ্ট যে সরকারের কাছে এমন হামলা কল্পনাতীত ছিল। আমাদের দেশে যেভাবে পুলিশি অভিযান হয়, ঠিক সেভাবেই ঘটনাটি শুরু হয়েছিল। রেস্তোরায় জঙ্গিরা অতিথিদের জিম্মি করেছে শুনেই অস্ত্র হাতে করে সেখানে ঢুকে পড়েছেন ওসি সালাহউদ্দিন ও তার ফোর্স। জঙ্গিরা তো অ্যামবুশ করেই ছিল। ঢোকার সাথে সাথে হামলা করে তারা। এটা ছিল সত্যিকারের বন্দুকযুদ্ধ। ওসি নিহত হন, প্রথম চোটেই আহত হন অনেক পুলিশ সদস্য। এরপর আরো একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা জঙ্গিদের হাতে নিহত হন। তাদের উভয়ের সাহসিকতা পুলিশ বিভাগের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করার জন্য গ্রেফতার করা এবং জঙ্গি বলে চালান দেওয়ার অনেক অভিযোগ পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে রয়েছে। কিন্তু সত্যিকারের জঙ্গি ও জিম্মি সন্ত্রাসের মুখোমুখি বাংলাদেশ পুলিশ এই প্রথম হলো। তাই কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই মাত্র সাতজন মানুষের কাছে থাকা সামান্য কিছু অস্ত্রের সামনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক শক্তি নিয়োগ করতে হলো। সেই সিলেট থেকে ফোর্স আনতে হলো। তারা সারারাত ধরে আসলেন, এদিকে জঙ্গিরা ধীরে সুস্থে কোর’আন তেলাওয়াতের ইন্টারভিউ নিয়ে এক এক করে অন্তত ২০ জনকে হত্যা করল। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাব সহযোগে সম্মিলিতভাবে অপারেশন চালায়। তারা চেয়েছে জিম্মিদের প্রাণ রক্ষা করতে কিন্তু জঙ্গিরা যে উদ্দেশ্যে এসেছে সেটা হলো হত্যা করতে এবং নিজেরা নিহত হতে। সিভিলিয়ানের উপর আত্মঘাতী হামলাকে মোকাবেলা করার সাধ্য কারো নেই।
সরকারের আত্মবিশ্বাস কিছুদিন থেকে খুব তুঙ্গে ছিল। কারণ এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুকে হত্যার পর পুলিশ বিভাগ অল আউট ওয়ার ঘোষণা করে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। প্রধামন্ত্রীও তাদেরকে অনেকটা স্বাধীন করে দেন। মাত্র এক সপ্তাহে তের চৌদ্দ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করেছেন, শুধুই যে ঈদ বাণিজ্য করেছেন সেটা আমি বলব না। তারা বলেছে এর মধ্যে দু আড়াই শ নাকি সত্যিই জঙ্গি। ক্রসফায়ারে কয়েকজন মরে গেল পর পর। বাকিরা আটক আছে। সুতরাং জঙ্গিবাদ মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে এমন আত্মতৃপ্তির আভাস পুলিশ বাহিনীতে পাওয়া গেল। কিন্তু আবারও সকালে পুরোহিত হত্যা, দুপুরে বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যা আর রাতের বেলায় গুলশানে ২০ জন বিদেশিকে একসাথে জবাই করে হত্যা। বাবুল আক্তারের প্রসঙ্গ ঢাকা পড়ে গেল। এমতাবস্থায় এদেশে আইএস নেই, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সফল এমন কথা আর ধোপে টিকবে না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি, সিএনএন সবাই গুরুত্ব দিয়ে ঘটনাটি লাইভ সম্প্রচার করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এখন সরকার কী করবে? তাদের হাতে ছিল দুটো উপায়। শক্তিপ্রয়োগ আর আলেমদের দিয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী ফতোয়া প্রদান ও গ্রামে গ্রামে ওয়াজে খোতবায় তার প্রচারণা। সরকার প্রকল্প নিয়ে একলক্ষ আলেমের স্বাক্ষর সংবলিত বই তৈরি করেছে। বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গি অভিযুক্ত ব্যক্তি নিহত হলে ভারত তার প্রশংসা করেছে। ফতোয়ার বই দেখে মডারেট মুসলিম আর সুশীলরা উল্লসিত হয়েছেন। কিন্তু গুলশানের ঘটনায় সব ফতোয়া অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। সরকার পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকায়ন করেছে, বিশেষ বাহিনী তৈরি করেছে, উন্নত অস্ত্র-শস্ত্রে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু প্রথম আঘাতেই সেই নিয়মিত পুলিশ বাহিনী সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় নি। তো এমন পরিস্থিতি এদেশে নতুন কিন্তু এটা হওয়াটা অনিবার্য ছিল সেটা কি তারা জানতেন না? না। তারা তো জঙ্গিদের ধরেই ফেলেছেন। তাই নামাতে হলো সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব সবাইকে। অর্থাৎ একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির আবহ সৃষ্টি হয়ে গেল। সাঁজোয়া বহর, জাতিসংঘের ট্যাঙ্ক ইত্যাদি প্রস্তুত করা হলো, নিয়মিত পুলিশ বাহিনী অকার্যকর হয়ে গেল।
এখন পরিত্রাণের একমাত্র যে পথটি খোলা আছে সেটার উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, জাতিকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে জাতি তার কথায় সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত কিনা? বঙ্গবন্ধুর ডাকে পাকিস্তানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এগিয়ে এসেছিল, রক্ত দিয়েছিল। এখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা ডাকছেন জঙ্গিবাদ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ষোল কোটি বাঙালিকে এগিয়ে আসার জন্য। কিন্তু ৪৫ বছরে পদ্মা মেঘনায় বহু জল গড়িয়েছে। জাতি এখন হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত, সর্বপ্রকার অনৈক্যকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের প্রকাশ্য শত্রু, বিএনপি চায় যে কোনো মূল্যে সরকারের পতন, পীর সাহেবরা অনেকেই সরকারকে নাস্তিক ফতোয়া দিয়ে রেখেছে, ৫ মে’র পরে হেফাজত সরকারের বিরুদ্ধে বিরাট শক্তিশালী চেতনা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের হাতে মানুষের ধর্মীয় আবেগের নিয়ন্ত্রণ। সরকার জনপ্রিয় এমন কথা সরকারও বলবে না। সরকারি দলের মধ্যেই অন্তর্কোন্দল বিকট রূপ ধারণ করেছে। এই মূহূর্তে বঙ্গবন্ধু কন্যার আকুল আহ্বান বাঙালির হৃদয়কে আদৌ কতটুকু আন্দোলিত করবে সে প্রশ্ন ওঠা অত্যন্ত যৌক্তিক।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা জাতিকে নিয়ে একটি সত্যিকারের বিপদের মুখোমুখী হয়েছেন যা মোকাবেলার হাতিয়ারগুলো ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে। গত রাতে মার্কিন সেনাবাহিনী জিম্মি উদ্ধারে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছিল যাকে ভয় করার উপযুক্ত কারণ রয়েছে। কিন্তু কতদিন তাদের সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হবে সেটাই দেখার বিষয়। পাশাপাশি জাতিকে কীভাবে তিনি ঐক্যবদ্ধ করবেন বা জাতি তার ডাকে কতটুকু সাড়া দেয় তার উপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই নির্ভর করছে। (লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি ও নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশেরপত্র ডটকম)

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *